ভোর ৫.৩৬ টায় ভিডিওটি ফেসবুকের হোম পেইজে আসে। ভিডিওটি দেখে আর দেরি করলাম না। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সমস্ত কথাই (ভিডিও) তুলে দিলাম এখানে।
প্রথমেই ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর পরিচিতি-
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (জন্ম:১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ ) বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাস্কর। যিনি কপালে লাল টকটকে সিঁদুর টিপ দিয়ে লাল-বৃত্ত ধারণ করেন। যার জীবনের সাথে মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস, মিশে আছে বীরাঙ্গনাদের দুর্বিষহ জীবন কাহিনী। তার জীবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধ খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছে।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, যুদ্ধের শিকার হয়েছে যে নারী তার তো নিজের কোনও লজ্জা নেই। তিনিই প্রথম বীরাঙ্গনা যিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতন সম্পর্কে মুখ খোলেন। তিনি আশা করেছিলেন; তার দেখা-দেখি হয়তো অনেকেই মুখ খুলবেন কিন্তু তিনি তেমন কাউকে পাশে পান নি।
“একাত্তরের ভয়াবহ ধর্ষণ সম্পর্কে একমাত্র জবানবন্দি-দানকারী সাহসিক ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার সাক্ষাৎকারে (একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির) জানান, “রাতে ফিদাইর (উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা) চিঠি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুলতান, লে. কোরবান আর বেঙ্গল ট্রেডার্সও অবাঙালি মালিক ইউসুফ এরা আমাকে যশোরে নিয়ে যেত। যাওয়ার পথে গাড়ির ভেতরে তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে। নির্মম, নৃশংস নির্যাতনের পর এক পর্যায়ে আমার বোধশক্তি লোপ পায়। ২৮ ঘণ্টা সঙ্গীহীন ছিলাম”।
একাত্তরে পুরো ৯ মাস পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঘটনাস্থলে, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বাঙালি নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন আটকে রেখে ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটিয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা গণ-ধর্ষণ। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষ সদস্য, স্বামীদের হত্যা করার পর নারীদের উপর ধর্ষণ নির্যাতন চালাতো পাকিস্তানী সৈন্যরা। ৯ থেকে শুরু করে ৭৫ বছরের বৃদ্ধা কেউই পাকিস্তানী সৈন্য বা তাদের দোসরদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। সুসান ব্রাউনি মিলার তার গ্রন্থের ৮৩ পাতায় উল্লেখ করেছেন, কোনো কোনো মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এক একটি গণ-ধর্ষণে ৮/১০ থেকে শুরু করে ১০০ জন পাকসেনাও অংশ নিয়েছে। “
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী—————-
আমি তো সহসাই ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম। মানুষ যেমন ঝড়ের কবলে পড়ে রাস্তা থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায় তবে একা একজন পড়ে যায়। আমিও ঠিক যে কোন ভাবে একা হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমি সেখানে; আমার বয়স তখন তেইশ বছর। আমি এই যুদ্ধের কবলে যে কোন ভাবে একা হয়ে পড়েছিলাম। এই একা হয়ে যাওয়ার কারণেই আমি পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত এবং এসব সেনা বাহিনীকে যারা সহায়তা করেছিল তাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।……
.
.
আমাকে ধরে নিয়ে গেল এবং ছুটল গাড়ি। আমি যেহেতু জায়গা গুলো চিনি। তো নওয়া পাড়ার কাছে এসে তখন আমি গ্যাং রেপ হলাম। ওখানে একটা নওয়া পাড়া জায়গাতে থামি।…(নীরবতা)….. এগুলো বলতে যত সোজা কিন্তু ভাবতে গেলে অনেক ব্যাপার হয়ে যায়। (কাঁদছিলেন)…
.
.
নারকীয় ভাবে নির্যাতন করল। আমি শুধুই হাতে পায়ে ধরি শুধুই হাতে পায়ে ধরি, অনেক কষ্টে যখন কনসানটেশান ক্যাম্পে ফাইনালি নিয়ে যাওয়া হল সেখানে গিয়ে আমি আর ঠিক থাকতে পারি নি। একটা ব্যারাকে মতন আমাকে ঢুকিয়েই গেটটা বন্ধ করে দিল। তখন খুব কান্নাকাটি ও চিৎকার করতে করতে দেখি একজন আর্মি অফিসার বেরিয়ে আসল।তিনি আমার ইন্টারভেশান নিচ্ছিলেন সন্ধ্যা বেলায়।
তো উনি বলছিলেন যে; তুমি কান্না কাটি করো না আমি দেখছি। কী চাচ্ছ?
আমি বললাম-আমাকে বের কর।
আমি অবশ্য জানতাম না কনসানটেশন ক্যাম্প কী কখনো দেখিও নাই। ওখানে যাওয়াতে বুঝলাম যে একটা বীভৎস জায়গা, বীভৎস।
আমাকে কয়েক পা হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। দুই পাশে দেখতে পাই ঘরের মেয়েরা বিবস্ত্র পরিস্থিতি, বিবস্ত্র একটা জীবন্ত কবরের মতন জায়গাটা মনে হচ্ছিল। যাই হোক। সকলেই তো। কিছু তো মানুষের মধ্যে মানুষ থাকতে পারে। এই ভদ্রলোক আমাকে বললেন তোমাকে নেব………
পরে ঐ রাতে কোন রকম থেকে কোন রকম থাকলাম। ।ঐ রাত তো নিরাপদ না তাই কোন ভাবে থাকি নি। পরে বহু কষ্টে আমি বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। কিন্তু ঐ আর্মি অফিসার হেল্প করেছিল বেরিয়ে আসার ব্যাপারে।
.
.
এটা বাদেও আমি সারাটা বছর প্রায় নয় মাসের রেশিও যদি আমি চিন্তা করি তাহলে যেমন হত্যা হয়েছে তেমনি আমার অফিসে প্রতিটি পলে পলে নির্যাতিত হয়েছি। আমাকে প্রত্যেকদিন অনেককেই রিসিভ করতে হতো! এটা একটা নির্যাতন।এটা আমি বর্ণনা করতে পারি না এজন্য আমি হিসাব দিলে হিসাবটা আপনাদের সাথে মিলবে না। কী অত্যাচার হতে পারে সেটা…………………..(কাঁদছেন)
.
.
.
আমরা সভ্যতাকে মানছি বলেই- গোলাম আযমের বাড়িতে গোলাম আযম সুন্দর আরামে থেকে গেছেন। তার জন্য কিন্তু কোন গণতন্ত্র অপেক্ষা করছে না।এসব যুদ্ধাপরাধীদের জন্য গণতন্ত্র নয় এবং এদেরকে যারা পবিত্র সংসদে পতাকা উড়িয়ে পাঠিয়েছে তাদেরও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে কিনা, হোক আমরা দাবী করব এটা।..আমি তো দাবী করব এটা। আমাদের দাবী হচ্ছে এসব যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তা দিচ্ছে এবং সেদিন সহায়তা দিয়েছিল তাদের প্রত্যেকের শাস্তি হওয়া উচিত। যুদ্ধাপরাধীরা যেভাবে হত্যা লুণ্ঠন, ধর্ষণ সব কিছু ঘটিয়েছে, গ্রাম থেকে গ্রাম জ্বালিয়েছে; এতো সহজে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ হত্যা হতে পারে না। নয় মাসের রিসিওতে হিসাব করে দেখলে প্রতি মিনিটে পাঁচজন করে হত্যা হয়েছে।.
.
.
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যেহেতু প্রতিটি জাতি সোচ্চার সেখান থেকে আমি অবশ্যই স্টংলি বলব; আমরা কঠিন শাস্তি দাবী করছি। এই আদালত ট্রাইব্যুনাল আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হবে, অনেক বেশি ঐতিহাসিক হবে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক হবে। রাতের আঁধারে চুপি চুপি দুইজনকে শাস্তি দিলাম আর একজনকে ছেড়ে দিলাম, একজনের সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। এটা আমরা মানতে পাচ্ছি না। তাহলে এটা কিছুতে-ই আমরা মানব না। ( সমাপ্ত )
আমরা কেমন মায়ের সন্তান যারা চোখের সামনে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে দেখি। আমাদের ক্ষমা করুণ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আমরা আপনার ত্যাগের মূল্য দিতে পারি নি। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতার শত্রুরা দেশে বুক উঁচু করে হাঁটে, ৭১’এর হায়েনারা পবিত্র সংসদে গিয়ে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে, স্বাধীন দেশের পতাকা গাড়িতে নিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়েই্ তারা ঘোরে। এই বাঙলার জনগণই তাদের নির্বাচিত করেছিল। আমারা আপনার মান রাখতে পারি নি। আমরি সব বিক্রি হয়ে গেছি প্রিয়ভাষিণী। অর্থ ও স্বার্থের কাছে আমারা ধর্ষকের সাথে হাত মিলিয়েছি, নিজের মা-বোনের ধর্ষককে প্রতিনিয়ত সালাম ঠুকে যাচ্ছি। নিজের পিতার খুনির কাছে সুপাত্র হওয়ার জন্য কী না করছি।…..বিশ্বকবি ঠিকই বলেছিলেন- বাঙ্গালী করেছ, মানুষ করনি।
কয়েকদিন বাঙলা নিউজ ২৪ এ একটি সংবাদ ছাপে-
” যাদের ত্যাগে স্বাধীনতা একাত্তরে সব হারিয়ে এখন বইয়ের ফেরিওয়ালা ” রমা চৌধুরী, একাত্তরের বীরাঙ্গনা। বাড়ি চট্টগ্রাম। তিনি জুতা পায়ে দিয়ে এই পবিত্র বাঙলার মাটিতে হাঁটেন না কারণ এই বাঙলার মাটিতে তার দুইটা সন্তানের রক্ত মিশে আছে। শহীদের খাতায় তাদের নাম উঠে নি কিন্তু ঐ মায়ের কাছে তারা মুক্তিযুদ্ধের বলি। তাই এই পবিত্র মাটিতে তিনি কীভাবে জুতা পায়ে দেবেন।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মা, বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন, রমা চৌধুরী তাদেরই একজন। শুধু সম্ভ্রমই হারাননি তিনি, এরপর থেকে সামাজিক গঞ্জনা সয়ে আর কখনোই মাথা তুলেও দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু এই দেশেই যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রী হচ্ছে, এমপি হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। অথচ এই এদেশে মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।
কয়েকদিন আগে কাঁদের মোল্লা (কসাই কাদের) অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত (আদালতে) হওয়ার পরেও বিচারকরা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় নি। বরং এই কাদের মোল্লাই ১৬ কোটি মানুষকে রায়ের পর ভি চিহ্ন দেখিয়ে ধর্ষণ করল এই দেশকে, ধর্ষণ করল এই দেশের বীরাঙ্গনাকে, ধর্ষণ করল এই ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, রমা চৌধুরীর মতন মায়ের আবেগকে।
তাই অবিলম্বে, প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জনগণের দাবী পূরণ করতে হবে।
বাঙালির প্রাণের দাবী-
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই।
পক্ষ নিলে রক্ষা নাই।
জয় বাঙলা।
ভিডিও লিংক- এখানে