মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের ভূমিকা

একাত্তর বা মুক্তি সংগ্রামে বাঙালিদের অংশ গ্রহণের পাশা-পাশি এদেশের আদিবাসীরাও অংশগ্রহণ করে। এদেশে পঁয়তাল্লিশটি আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে। অত্যাচার-নির্যাতনের দিক থেকেও আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা কোন অংশে কম ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আদিবাসীদের অবদান সবসময় অবহেলিত। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আদিবাসী নারী-পুরুষ প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। কিন্তু পরিতাপের বিয়ষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আদিবাসীদের অবদান সে রূপভাবে স্থান পায় নি। এতো বছরেও সম্মান মেলে নি সেই সব লড়াকু সৈনিকদের।

একাত্তরে পাকিস্তান সেনা বাহিনী সাঁওতালদের হিন্দু গণনা করে যখন নির্বিচারে হত্যা করা শুরু করছিল তখন জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে বাংলাদেশে থেকে পালাতে হয় ৩০ হাজার সাঁওতালকে। ভারতের শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযুদ্ধের অংগ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা জাগান আদিবাসী সাঁওতাল নেতা সাগরাম মাঝি। এভাবে তিনশর বেশি সাঁওতাল তরুণ প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। রাজশাহীর বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বনাথ টুডু ছিলেন একজন প্লাটুন কমান্ডার। এছাড়াও অনেক বীর আদিবাসী তরুণ মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের নৈপুণ্য দখাতে সক্ষম হন।

এভাবে রক্তে হুলের চেতনা নিয়ে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন সম সরেন, চাম্পাই সরেন সহ প্রমুখ আদিবাসী সাঁওতাল। ফাদার লুকাশ মারান্ডি ছিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। একাত্তরে ভারতে পলায়নপর শিক্ষার্থীদের রুহিয়া মিশনে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করার অপরাধে ২১ এপ্রিল পাক সেনারা ফাদার লুকাশ মারান্ডিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

নাচোল বিদ্রোহ সহ ভারতে উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে সাঁওতাল নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। রাজশাহীর গোদাগাড়ি থানায় গোদাড়পাড়া গ্রামের কিছু পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামেই থেকে যায়। মুক্তিযুদ্ধ সময়ে এই পরিবারগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও আশ্রয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এর ফলে, দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন পূর্বে স্থানীয় রাজাকারদের প্ররোচনায় এই সব সাঁওতালদের পরিবারে হানা দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এসব পরিবারগুলোয় অপূরণীয় ক্ষতি করার পাশাপাশি লাঞ্চিত করা হয় সাঁওতাল নারীদের।

৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন সাগরাম মাঝি। জেলে শহিদ ৪ মহান নেতার অন্যতম কামরুজ্জামানের রাজনৈতিক সহকর্মীও ছিলেন সাগরাম মাঝি। তিনি ৭১ এ ভারতে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু তৎকালীন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অনাস্থার কারণে মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ দেখায় নি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের প্রধান শর্ত ছিল- মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ভারত। স্বভাবতই আদিবাসী প্রধান পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ন্তভুক্তির সম্ভাবনা ছিল ভারতের সাথে। দেশ বিভাগের তিন দিন পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় পতাকা উড়ে। অথচ পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলের আদিবাসীদের বিশেষ করে চাকমাদের পাকিস্তান পন্থী বলে বিবেচিত করা হয়।
বাঙালিদের মধ্যে যেমন রাজাকার আছে তেমনি চাকমা গোত্রের মধ্যেও রাজাকার ছিল। চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় পাকিস্তান পক্ষ অবলম্বান করে। অথচ রাজা ত্রিবিদ রায়ের জন্য সমগ্র চাকমা সম্প্রদায়কে রাজাকার বা পাকিস্তানি দালাল উপাধি দেওয়া হয়। চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় পাকিস্তানিদের পক্ষ নিলেও চাকমা রাজপরিবারের অন্যতম সদস্য কে. কে রায়ের মুক্তিযুদ্ধে সহায়না ও সর্বাত্মক সহযোগিতার ছিল। শেখ মুজিবের ৭ই মার্চ ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সংকল্পবন্ধ হন রসময় চাকমা। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে গেলে তাকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও তিনি দমে যান নি। দেশে ফিরে এসে খাগড়াছড়ির এক পাঞ্জাবির বাড়িতে তিনি আগুন জ্বালিয়ে দেন। চাকমাদের থেকে অভিযোগ করা হয়; মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক তরুণ, যুবক ও সাধারণ মানুষ যোগ দিতে চাইলেও তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ষড়যন্ত্রের কারণে চাকমারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ থেকে দূরে রাখা হয়। রসময় চাকমার মতন আরেক আদিবাসী ছিল নাম তাতিন্দ্রলাল চাকমা। ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাহেন্দ্রক্ষণে আগেভাগেই ট্রেনিং সম্পন্ন আরো কয়েক আদিবাসীদের যুবকদের সঙ্গী করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। কিন্তু তাকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে সুযোগ দেওয়া হয় নি। মুক্তিযুদ্ধে সুযোগ না দেওয়ার একটাই কারণ তা হল অবিশ্বাস। কারণ রাজাক ত্রিবিদ রায় যেহেতু পাকিস্তানদের পক্ষ নিলেন সেহেতু চাকমাদের আর বিশ্বাস করা যায় না। এই একি সূত্র কিন্তু অন্যদের বেলায় চলে নি। এমন অবহেলা বা বাঁধা সত্ত্বেও অনেক আদিবাসী তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশে নেয় কিন্তু যুদ্ধে অংশে নিলেও তাদের সাথে শিতল আচরণ করা হয়। ফলে পরবর্তীতে অনেকেই আর মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিতে আগ্রহ বোধ করেন নি।
একাত্তার পরবর্তী সময়ে চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায় কিংবা চাকমাদের পাকিস্তান প্রীতি ফলাও করে প্রচার করা হলেও চাকমা বা আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও মুক্তিযুদ্ধের অবদান তেমন ভাবে বলা হয় না। এক চাকমা রাজার কারণে যদি সকল চাকমা রাজাকার হয় তাহলে তো সেই সূত্রে প্রতিটি বাঙালি রাজাকার। যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনজন চাকমা তরুণকে যুদ্ধকালীন বীরত্বের জন্য স্বীকৃতির খেতাবে ভূষিত করা সিদ্ধান্ত হলেও, পরবর্তীতে তা রহিত করা হয়। স্বীকৃতি বা পুরষ্কার না দিলেও একাত্তরে আদিবাসীদের অবদান কোন ভাবেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

একাত্তরে পাকিস্তানিদের আরেক আতঙ্ক ছিলেন রাজা মপ্রু। রাজা মপ্রু হয়ে উঠেন এক বিপদজ্জনক ব্যক্তি। পাকিস্তানিরা বিভিন্ন ভাবে রাজাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পাকিস্তানিরা মিজো বিদ্রোহ কাজে লাগান ফলে রাজার অবস্থান বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠে। তিনি তার পরিবারকে আগরতলায় পাঠিয়ে দেন। তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিশ্চুপ থাকেন নি। তিনি সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কিছু অপারেশনে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে পরিবারের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিবাহিনী এবং পরে মিত্রবাহিনীর সাথে সর্বত্মক যুদ্ধে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।

এই দেশের রাখাইন গোষ্ঠীও মুক্তিযুদ্ধে সর্বত্মক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ করেন। জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সবার অংশ গ্রহণ ছিল। রাখাইনদের এক সময় সমৃদ্ধ জনপদ, স্বতন্ত্র-স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য ছিল। বর্মি সম্প্রদায়ের নিষ্ঠুর ছোবলে সব হারিয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়। অভিজ্ঞতায় স্বাধীনতা হারানোর বেদনা, চেতনায় পরাধীনতা থেকে মুক্তির আখাঙ্কায় অসংখ্য তরুণ মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে অন্যতম- বীর মুক্তিযোদ্ধা উ-মংয়াইন, উ-ক্যহ্রাচিং, উ-উসিতমং প্রমুখ। এছাড়াও অসংখ্য সাধারণ রাখাইন রয়েছে যারা মুক্তির আখাঙ্কায় মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারা “মুক্তিযোদ্ধা” নাম বিকিয়ে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেন নি। এবং সরকার ও প্রশাসন পক্ষ থেকেও তাদের প্রতি তেমন কোন প্রচেষ্টা মেলে নি।
একাত্তরে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবাহ করেছিল চিন। ফলে চিনের প্রতি পাকিস্তানের কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল। অনেক রাখাইন পাকিস্তানিদের কাঝে নিজেদের “চায়না বৌদ্ধ” বলে পরিচয় নিয়ে মুক্তি পেলেও পাকিস্তানীদের নৃশংসতায় স্তব্ধ হয়ে যায় রাখাইন জনপদ। ৭১-এর মে মাসে একদিন মহেশখালির ঠাকুরতলা বৌদ্ধ বিহারে অনুপ্রেবেশ করে পাকিস্তানিরা। হত্যা করা করা অসংখ্য মানুষকে। ৬২টি রৌপ্য মুর্তি লুট ও হত্যার এক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে পাকিস্তান হানাদাররা।

৭১-এ মণিপুরী সম্প্রদায়ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। সংগ্রাম ও যুদ্ধে নিজেদের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত করে মণিপুরী সম্প্রদায়। মুণিপুরীদের মধ্যে অন্যতম সৈনিক ছিলেন; সাধন সিংহ, অনিতা সিনহা, বাণী সিনহা সহ প্রমুখ। এছাড়াও যাদের নাম বিশেষ শ্রদ্ধায় অবশ্যই স্মরণীয় তারা হলেন; মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক নীলমনি চট্টোপাধ্যায়, নন্দেশ্বর সিংহ, বিজয় সিংহ প্রমুখ। এদের মধ্যে নীলমনি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ১২০০ মুক্তিসেনার এক প্রতিরোধ বাহিনীর।

অথচ মুক্তি সংগ্রামে বা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শুধু বাঙালিদের অবদান ও সাহসীকতার পরিচয় দেখানো হয়। বাঙালিদের সাথে সাথে অসংখ্য আদিবাসীদের অবদান তেমন ভাবে প্রচার করা হয় না। আমাদের দেশের পাঠ্য বই গুলোতে আদিবাসীদের অবদানের কোন কথা নেই বললেই চলে। একটি দেশে স্বাধীন হওয়ার পেছনে ঐ দেশের সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের অবদান থেকে। সকলের অবদানেই তো জন্ম নেয় একটি স্বাধীন দেশ। আদিবাসী, মিত্রবাহিনী সহ অসংখ্য মানুষের অবদানেই জন্ম হয়েছিল আমাদের বাংলাদেশের। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ইতিহাসে আদিবাসীরা প্রতিবারই থাকে উপেক্ষিত। প্রচারিত ইতিহাসে হয়তো তাদের নাম নেই, মানুষের মনে হয়তো আদের অবদানের স্থান নেই কিন্তু এই মাটি জানে; এই মাটিকে মুক্ত করতে কতোটা ত্যাগ করেছিল আদিবাসীরা।

সমগ্র তথ্য সূত্র- মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী- আইযুব হোসেন ও চারু হক

সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৩

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.