বাল্যবিবাহ কী শুধু আইন দিয়ে রোধ করা সম্ভব?

বর্তমান সরকার নতুন আইনে ছেলেদের বিয়ের বয়স ১৮, মেয়েদের ১৬ করার কথা ভাবছে। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত আইনে বর্তমানে নারীদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ২১ বছরের কম হলে নাবালক বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইন কিংবা আর্ন্তজাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত বাল্য বিবাহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাল্য বিবাহের শিকার মূলত মেয়েরাই। বলা হয়ে  থাকে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের  মস্তিষ্ক অপরিপক্ক ও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাহলে কথা আসে কেন আমাদের সমাজে বাল্য বিবাহ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না?

আমাদের সমাজে বাল্য বিবাহ বিশেষ করে মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এই কারণগুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া সমীচীন বলে বোধ করছি। আইনের পাশাপাশি সামাজিক সমস্যা বা জঞ্জালগুলো পরিষ্কার না করতে পারলে কোন ভাবেই বাল্য বিবাহ রোধ করা সম্ভব হবে না। সোজা কথায় অতীতে সরকারের আইন করা মেয়েদের ১৮ বছর যেমন কেউ মানেনি তেমনি ১৬ বছর করলেও কেউ তেমন খেয়ালে নেবে না। প্রধানত দুই-তিনটি কারণে আমাদের সমাজে মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়া হয়।

সামাজিক নিরাপত্তার অভাব- গ্রামের গরীব পরিবারের অভিভাবক মেয়ে বড় ( ১৫ বছর হলেই) হওয়ার সাথে সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এর প্রধান কারণ সামাজিক নিরাপত্তা অভাব। গ্রামের উর্ত্তি বদমাইশদের হাতে বা মোড়লের বখাটে ছেলেদের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এই ভয়টা ভিন্নধর্মালম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো বেশি বিরাজমান। কারণ  মেয়েদের সম্মানের সাথে পরিবারের সম্মান জড়িত থাকে। এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিহিংসার শিকারও হয় অসহায় মেয়েরা।  সমাজে কোন মেয়ে ইভটিজিং বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েও দুটর্ঘনা বা ঐ অপরাধের জন্য প্রধান অপরাধী হয় ভিকটিম মেয়েটিকেই। এসব সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নিরাপত্তার অনিশ্চিয়তার কারণেই পরিবার দ্রুত মেয়েদের বিয়ে দিতে চায়।

অর্থনৈতিক কারণ- পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা দূর্বল হলে; কেউ ভাল কোন পরিবার প্রস্তাব নিয়ে আসলেই মেয়েদের দিয়ে দেয়। পরিবারের অভিভাবক মেয়ের ভরণপোষণ চালাতে হিমশিম খেলে বিয়েই হয় মুক্তির একমাত্র পথ। এছাড়াও পরিবারে মেয়েরা যেহেতু উপার্জন করার ক্ষমতা কম রাখে বা করতে দেওয়া হয় না সেহেতু পরিবার তাদের বোঝা হিসেবে দেখে থাকে। সেহেতু বিয়েই হয় পরিবারের মেয়েটির মুক্তির একমাত্র পথ।

আমি যে ছোট শহরটায় বড় হয়েছি সেখানে এই  কারণগুলোই জন্যই মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়া হতো। আমার পরিবারেও একই বিষয় দেখেছিলাম। আমার এক বন্ধুর বোনের বিয়ে হয় ক্লাশ এইটে থাকতে। মূল কারণ সামাজিক নিরাপত্তা। অনেক পরিবারকে দেখেছি যারা কণ্যা বড় হলে আর হাই স্কুলে পাঠায় না। কলেজ তো অনেক দূরের বিষয়। কারণ সামাজিক নিরাপত্তা। আর কিছুটা নিরাপদ নিম্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা ভার্সিটি পড়ুয়া অবস্থায় কন্যার বিয়ে দিয়ে দেয়। ভার্সিটির আগে দিতে চায় না তার কারণ- বর্তমান ছেলে ভার্সিটি পড়ুয়া ছাড়া বিয়ে করতে চায় না তো আর ভার্সিটির শেষ করে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না- যদি মেয়ের বয়স বেশি হয়ে যায় এই ভয়ে।

তবে এখানে দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে সরকারের এমন নীতিমালায় বাল্য বিবাহের হার আরো বেড়ে যাবে। বর্তমানে বহাল যে নীতিমালা রয়েছে তা খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে; মেয়েরা সরকারের আইনে ফলে বান্ধবীর বাল্যবিবাহ রোধে এগিয়ে এসেছে। আইনের কারণ তারা কিছুটা প্রতিবাদ করার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের রক্ষণশীল সমাজে মেয়েদের বয়স কমানোর ফলে বাল্য বিবাহে অনেকে যেমন উৎসাহিত হবে তেমনি মেয়েরা স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়ে যাবে। কারণ ১৮ বছর আগে মেয়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে শারীরিক অনেক সমস্যায় ভুগতে হয়।এছাড়াও অনেক মেয়ে ১৮ বছরের আগে মানসিকভাবে যৌন সম্পর্কের জন্য তৈরি থাকে না। এ ক্ষেত্রে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ হলে বাকি জীবনে যৌনতা নিয়ে তারা একটি নেতিবাচক ধারণা বয়ে বেড়ায়।

সুতরাং বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমাদের  শুধু সরকারের ১৬ বছর করা আইনের বিরোধিতার পাশাপাশি সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। সামাজিক সমস্যাগুলোর কারণে অনেক পরিবার শুধু আইনকে নয়, অনেক মেয়ের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নকেও বিবেচনায় আনে না। তাই সামাজিক নিরাপত্তা আর অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া শুধু আইন করে বাল্য বিবাহ বন্ধ করা যাবে না, যেমনটি যায়নি শিশুশ্রমকেও।

সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৪

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.