ধর্মরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও জঙ্গিবাদ

৭১-এ বাংলাদেশে রাষ্ট্র বিপ্লব হলেও সামাজিক বিপ্লব হয়নি। এই সমাজের মানুষগুলো পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওবার লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুনতে হয়তো খারাপ লাগতে পারে যে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি ভাবে অথবা কোন পথে চলবে তা নিয়ে আমাদের কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা আগের মতনই রয়ে গেল। যাকে নতুন বোতলে পুরাতন মদ বলা হয়। একাত্তরের পরে ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বাংলাদেশ ভ্রমণ করে লেখেন যে; পরাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ অসাম্প্রদায়িক ছিল কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে (মূল কথাটা মনে হয় এমনই ছিল)। সেদিন কুলদীপ নায়ারের বক্তব্যে অনেকে ক্রুদ্ধ হয়েছেন অনেকের কাছে আবার হাস্যকর ঠেকেছে!

পাকিস্তান আমলের শোষণ বঞ্চনার, ধনী গরিবের মধ্যে বৈষম্যের, নাগরিক পরাধীনতার অবসান ঘটেনি স্বাধীন বাংলাদেশেও। সংবিধানে বাংলাদেশের জনগণকে বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যা নৃ-গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। কারণ বাঙালি ছাড়াও এই দেশে চাকমা, মনিপুরী ইত্যাদি সম্প্রদায় রয়েছে। ৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সংবিধানে বিসমিল্লাহ যুক্ত করেন। প্রতিটি রাষ্ট্রের ধর্মরাষ্ট্র হয়ে উঠার পেছনে বা ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকে। যেমন- অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, দুর্নীতিপরায়ণটা, অর্থের অসম বণ্টন। যার কেউ নেই তার যেমন শুধু খোদা থাকে তেমনি যে রাষ্ট্রে সুশাসন, গণতন্ত্র নেই সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ধর্ম থাকে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকে!

জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার যেহেতু অবৈধ সেহেতু তা জায়েজ করার জন্য ধর্মই শেষ অস্ত্র। যেমনটি স্বৈরাচার এরশাদের ছিল। এরশাদ সাহেব শুধু রাষ্ট্র ধর্ম বানাননি স্বপ্নেও ধর্মীয় আদেশ পাওয়া শুরু করেছিলেন। এতো কিছু করার একটাই কারণ তাহলো; অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। বিএনপি সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ চরম আকার ধারণ করে। জেএমবি’র প্রধান নেতাদের রাষ্ট্রীয় ভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলেও জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যায়নি। এর মূল কারণ সকল দলের কমবেশ পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদ এখনো টিকে আছে। রাষ্ট্রে যখন অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও লুটপাট চলে তখন ধর্মীয় দলগুলো মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০টির বেশি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। জেএমবি, হিজবুত তাহরী’র মতন জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বা রাষ্ট্র দখলের পথ আলাদা হলেও উদ্দেশ্য কিন্তু এক! আর তাহলো ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েম করা। জেএমবি জঙ্গি সংগঠনটি মূলত গ্রাম পর্যায়ের দরিদ্র মানুষগুলোকে দলে যুক্ত করে অন্যদিকে হিজবুত তাহরী শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ছেলেগুলোকে দলে ভেড়ায়। ধনী গরিবের শ্রেণি বৈষম্য, সমাজের অনাচারগুলোকে সামনে এনে তারা তাদের জঙ্গি কার্যক্রম চালায়। যেহেতু সমাজে বৈষম্য ও অনাচারগুলো দীর্ঘদিন ধরেই রয়ে গেছে সেহেতু অনেক দরিদ্র গোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। জঙ্গি সংগঠনগুলোর লক্ষ্যই যেহেতু বিশুদ্ধ ইসলামিক ধর্মরাষ্ট্র যেখানে কোন বৈষম্য থাকে না সেহেতু প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে তাদের অনেক সমর্থক রয়েছে। তা না হলে এতো বছরেও কেন জঙ্গি সমস্যা দূর হয়নি! আর কেনই বা জঙ্গি সংগঠন বেড়েই চলছে। যদিও এটা পরীক্ষিত যে, পৃথিবীর কোন ধর্মরাষ্ট্র অন্যকোন ধর্মীয় মানুষদের প্রতি সমান মর্যাদা বা অধিকার দিতে পারেনি। বরং সমাজে বৈষম্য ও অনাচার আরও বাড়িয়ে তোলে। তারপরও এক শ্রেণির মানুষ এই ধর্মীয় রাষ্ট্রের মোহে জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। হিজবুত তাহরী’র ছেলেরা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনেকে ধনী ঘরের সন্তান সেহেতু তারা জেএমবির মতন মোটা মাথার চিন্তা করে না। তাই তারা বন্দুক ও বোমার পাশাপাশি তত্ত্ব ও আদর্শের লড়াই করে চলছে।

পৃথিবী ব্যাপী যেখানে জঙ্গিবাদ মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে আমাদের সমাজে ক্রমাগত জঙ্গিবাদ বেড়েই চলছে। এর প্রধান কারণ সুশাসনের অভাব। জঙ্গিবাদগুলোর পেছনে বিদেশী অর্থ, ধর্মীয় হুর-পরীর লোভ যেমন কাজ করে তেমনি রাষ্ট্রের দুর্নীতি, দুঃশাসনও দায়ী। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে প্রতিবার খৎনা করিয়ে ইসলামিক রাষ্ট্র বানানো হচ্ছে। যতবার খৎনা করা হয়েছে সেই সময়কার শাসনদের শাসনামলের দিকে তাকালে প্রতিবারই স্পষ্ট হয় যে, অবৈধ শাসনকে বৈধ করার জন্য বা ক্ষমতার জন্য রাষ্ট্রটিকে ধর্মরাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সকল রাজনৈতিক দল মাথায় টুপি পরে কে কতো বড় মুসলমান তা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তার একমাত্র কারণ দলগুলোর দুর্নীতির নোলা জলে ঢুকে রয়েছে। বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের আরেকটি কারণ বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোর মৃতপ্রায় অবস্থার কারণ। ষাট, সত্তরের দশকে সৎ ও মেধাবী তরুণরা বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হতো। কিন্তু বামদলগুলোর মৃতপ্রায় অবস্থাসহ নানা কারণে ইসলামি বিপ্লবের স্লোগানের তলে সমাজ পরিবর্তন-কামী তরুণরা আকৃষ্ট হচ্ছে।

জঙ্গিবাদের জন্য বেহেস্তের হুর-পরীকে যতোই দায়ী করি না কেন সামাজিক এই অনাচার ও সংকটগুলোকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না। তাই দেশে জঙ্গিবাদ মুক্তি, দেশকে ধর্মরাষ্ট্র বানানো থেকে রক্ষা পেতে চাইলে রাষ্ট্রে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে ক্ষমতা টিকেয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আমাদেরকে ধর্মরাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দেবে আর আরেক পক্ষ ইসলামিক বিপ্লবের স্বপ্নে দেশে জঙ্গিবাদের চাষ করতেই থাকবে তাতে বলি হবো আমরা সাধারণ মানুষগুলো!

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.