পশুর সম্মানহানি

মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ট জীব। তবে ডারউইন-এর বিবর্তনবাদ আসার ফলে মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়। যাই হোক মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাকি অশ্রেষ্ঠ সেই বির্তকে না যাই। আজকে আমাদের বিষয় পশুর সম্মান অসম্মান নিয়ে। পৃথিবীর সকল কিছুর ধর্ম আছে। মানুষের যেমন আছে তেমনি পশুও আছে, আছে জড় বস্তুরও। তবে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কিনা নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে তার নিয়ম-নীতিতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আনে। যেমন- মিথ্যা বলা মহাপাপ কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তি বা মৃত্যুর পথ যাত্রী ব্যক্তির কাছে সবসময় সত্য বলতে নেই। সেই যাই হোক, কীভাবে সত্যবাদী যুধিষ্ঠি হবো তা নিয়েও আজকের বিষয় নয়। আজকের বিষয় পশুর সম্মান অসম্মান নিয়ে। আমরা প্রতিনিয়ত এক জন আরেকজনকে নিচে নামাতে গিয়ে অহেতুক পশুদের টেনে আনি। সাথে তাদের সন্তানদেরও নিয়ে আসি! আজকের বিষয় গালি বিশেষ করে সেই গালি যেগুলোতে পশুরা যুক্ত থাকে! যা মূলত আমাদের এক প্রকার অসহায় প্রাণীর প্রতি বিদ্বেষ।

শূয়রের বাচ্চা

বাসর ঘর থেকে শুরু করে সিনেমার পর্দা সব জায়গায় হর হামেশাই এই গালিটির অধিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়! বিরুদ্ধ ব্যক্তি বা সামাজিক অপরাধীদের বিরুদ্ধে এই গালিটি ব্যবহার করা হয়। অথচ শূয়র খুবই ভাল প্রাণী। শূয়রের মাংস খেয়ে মানুষ নিজের পেট ভর্তি করে। শূয়র মাংস দিয়ে ব্রাজিলে তৈরী হয় বিখ্যাত খাবার ‘কার্নে দ্য ফুমেইরো। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শূকরের মাংস দিয়েই তৈরি হয় বিখ্যাত সব খাবার। শূকরের নাদুসনুদুস শরীরটা যে পরিমান মাংস বহন করে তা অন্য কোন পশু বহন করে কিনা সন্দেহ। শূকরের নাদুসনুদুস গোস্ত সকলের প্রিয় হলেও গালি দেওয়ার সময় শূকরই সবচেয়ে আগে আসে। শুধু বাংলায় নয় ইংরেজিতে পিগ বা শূকরছানা গালি হিসেবে বেশ প্রচলিত। সেই পশুর মাংস সবচেয়ে প্রিয় সেই পশুটাই কিনা সবচেয়ে কমন গালি। এয়ে কেসা ইনসাফ হে?

কুত্তার বাচ্চা

বলা হয়, কুকুরই মানুষের প্রথম গৃহপালিত প্রাণী। সিনেমার পর্দা থেকে সামাজিক পর্দা কোথাও কুকুরের খারাপ গুণ দেখিনি। পাগলা কুকুরের কথা আলাদা কারণ মানুষও তো পাগল হয়। অথচ এমন প্রভুভক্ত প্রাণীকেই কিনা গালি হিসেবে ব্যবহার করি। কুকুর তার মালিকের কখনো অপকার করছে বলে শুনিনি। অতীতে গ্রামে বাড়ি মহল্লা পাহারার কাছ তো করতো এই কুকুরই। বর্তমানে রাষ্ট্র প্রধানদের নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব এই কুকুরের উপরই। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর আমদানি করে। আমাদের পাহাড়ের অনেক জনগণের কাছে প্রিয় মাংস হল কুকুরের মাংস। কোরিয়ায় একেকটা কুকুরের দাম নাকি আমাদের দেশের গোটা একটা গরু থেকেও বেশি। এটাই তাদের প্রিয় খাবার। একসময় মোবাইল কোম্পানির কাজ করতে আসা কোরিয়ানরা কুকুর খেয়ে আমাদের এলাকা সাফ করে ফেলেছিল। চিনেও কুকুর মাংস দিয়ে বিভিন্ন মজাদার খাবার খাওয়া হয়। অথচ আমরা এই সুস্বাদু ও উপকারী প্রাণীটির নামে গালাগালির চর্চা করি। আমার তো মনে হয় কোন উপকারী মানুষকে কুকুরের বাচ্চাই বলা উচিত বা কুকুর বলা উচিত।

শালায় গরু

শালায় গরু! এই গালিটি যদি সরল ভাবে ভেঙ্গে দেখি তাহলে দেখব শালা ও গরু। শালা হল পরম আত্মীয়। বৌয়ের ছোট ভাইকেই শালা বলা হয়। যে কিনা বিয়ের পর হানিমুন প্যাকেজের ফটোগ্রাফার হিসেবে থাকে। আর গরু তো উপকারী শান্ত প্রাণী। যে কিনা মানুষকে কখনো বিরক্ত বা আহত করে না। গরু থেকে আমরা দুধ, মাংস, চামড়া, খুর, চুল, শিং, জ্বালানির জন্য গোবর, ইন্ডিয়ার কিছু ধার্মীক আমার হিসুও পায়। ফেসবুকে দেখেছিলাম গরুর হিসু খাচ্ছে। যাই হোক এমন উপকারী প্রাণীকে আমরা মানুষের বেলায় আহাম্মক হিসেবে চিত্রিত করি! আহাম্মাক মানুষকে কিন্তু কোন কাজেই ব্যবহার করা যাবে না। উল্টো সব জায়গায় গোলমাল বাঁধাবে। অথচ গরু কারো কোন ক্ষতি না করে আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কাজ করে যাবে, সারা দিন আপনার কাজে খেটে আবার সকালে দুধ, চুলায় জ্বালানি হিসেবে গোবর দিয়ে যাবে। অথচ এই নিরীহ প্রাণীটিকে মানুষ কিনা আহাম্মক হিসেবে উপস্থাপন করে। ঈদের সময় ট্রাকে করে আসার সময় শরীরের অনেকখানি চামড়া গরুর খসে পড়ে তারপরও মানুষের প্রতি একটুও অভিযোগ নেই। গরু মূলত দুই সময় খায়। দুঃখ পেলে কেঁদে কেঁদে খায় আর খুশি থাকলে মাথা নেড়ে নেড়ে মজা করে খায়। সৌদি আরবে যেমন উট তেমনি আমাদের সবচেয়ে উপকারী প্রাণী হল গরু। তাই কাউকে গরু বলে গরুকে অম্মান করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

গাধার বাচ্চা

এই গাধা মানুষের উপকার ছাড়া কখনো অপকারে লাগে নাই। তারপরও মানুষ একে গালি দেওয়ার সময় নামনে নিয়ে আসে। গাধা পানি ঘোলা করে খায়! এভাবে খেতে ভাল লাগে তাই খায় আমরা যেমন পানির সাথে একটু ভদকা বা একটু লেবু চিপে খাই। কোই তখন তো সমস্যা হয় না। কিন্তু গাধা একটু গানি খোলা করে খেলেই সমস্যা। গাধার পিঠে যতো বোঝাই চেপে দেওয়া হোক না কেন গাধা তা বিনা অভিযোগে বহন করে। পরিশ্রমি একটা প্রাণী হল এই গাধা। অথচ নির্বোধ কাজ না পারা মানুষকে আমরা গাধা বলি। অথচ অফিসের সবচেয়ে পরিশ্রমি বা যে সবচেয়ে বেশি অফিসিয়াল চাপ নেয় তাকে গাধার সাথে তুলনা করা উচিত। যেমন অফিসের জিএম বা এমডিদের গাধা বলা উচিত। কারণ অফিসের সবচেয়ে বেশি কাজের চাপ তাদেরই।

বেজি

বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গালিটি বেশ দেখা যায়। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বেজি ডাকছে। ফেসবুকে আবার কোন কোন নেত্রী’র নাম সংক্ষেপে বেজিও লেখে। সে যাই হোক আমার চোখে বেজি হল সাহসী এক প্রাণী! যে কিনা সাপের সাথে যুদ্ধ করে। বেজি অতিদ্রুত চলাফেরা করতে পারে। সবচেয়ে অবাক বিষয় বেজি সাপের সাথে যুদ্ধ করে। বিশাক্ত সাপ দেখে যেখানে আমরা এক দৌড়ে মদিনায় চলে যাই সেখানে এই ছোট্ট প্রাণী বেজি সাপের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হয়। অথচ মানবকূলে বেজি গালিটি হীন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যা অন্ত্যন্ত দুঃখজনক।

বাঘের বাচ্চা

মানুষ নিরীহ ভদ্র প্রাণীদের হেয় করে আর হিংস প্রাণীদের প্রসংসা করে। শক্তের ভক্ত আর কী। বাঘের বাচ্চা অবশ্য মানবকুলে গালি নয় প্রশংসা বা স্তুতিবাক্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়! যে বাঘ মানুষের উপকার তো দূরের কথা সারা মানব জীবনে অপরারই করে গেল সেই বাঘের বাচ্চা হিসেবে নিজেকে দেখে আমরা পুলকিত হই। মানুষ বড়ই বিচিত্র! তার থেকে বিচিত্র মানুষের কল্পনা! বাঘকে খুব একটা সাহসী বলা যাবে না। বাঘের খিপ্র গতি আছে ঠিকই কিন্তু বাঘের মোস্তানি তো ঐ হরিণ, জেব্রার মতন নিরীহ প্রাণীকূলের সাথেই। একটা দুটা সিংস বা হাতি মারার গল্প শুনি নাই। উল্টো মনুষ্যকূলে এসে এই বাঘ মানুষকে মেরে নিজের উদর ভর্তি করে! যে প্রাণী কিনা মনুষ্যের উপর হামলা করে, মনুষ্যের রক্তের স্বাদ পেলে পাগল হয়ে যায় সেই প্রাণীর বাচ্চা বললে মানুষের বুকের ছাতি ৩২ ইঞ্চি ফুলে উঠে।

বাঁদর

সাধারণত দুষ্টুদের বাঁদর বলা হয়। অথচ মানুষের থেকে দুষ্টু কোন প্রাণী এই পৃথিবী কেন মহাবিশ্বের আছে কিনা সন্দেহ। অথচ যতো দোষ ঐ বাঁদরের। বনে বাঘ আসলে বাঁদরই সবার আগে হরিনদের জানিয়ে দেয়। এই বাঁদর মানুষের মাথার উকুন মেনে দেয়। বাঁদর নাচ দেখিয়ে মানুষের পকেটে টাকা এনে দেয়। অথচ এই বাঁদরই কিনা আমাদের সমাজে একটা গালি।

শকুনী মামা

আত্মীয়কুলে কুচক্রী মামাকে শকুনী মামা বলা হয়। অথচ মামার সাথে বা কুচক্রে সাথে শকুনের কোন সর্ম্পক নেই। তারপরও উপকারী প্রাণী শকুনকে শুধু শুধু টেনে আনা। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত শকুনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক শকুন রক্ষার করার জন্য বড় অংকের টাকা অনুদান দিয়ে থাকে। শকুন প্রকৃতির পঁচা, আবর্জন খেয়ে মানুষ ও পরিবেশকে সুস্থ রাখে। শকুনের কারণে পরিবেশে রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়। মানুষ ও প্রকৃতির এমন উপকারী প্রাণীকে নিয়েও মানুষ মন্দ কথা বলতে ছাড়েনি। শকুনের মাংস কেমন তা জানা নেই। আমার খাবারের বাছ বিচার না থাকায় আমার দীদা আমাকে অংশ পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন; নাতী কখনো শকুনের মাংস খাসনে। তাহলে পাগল হয়ে যাবি। যাই হোক শকুনের মাংস খেলে পাগল হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তারপরও পাখি হিসেবে উপকারী পাখি কাক থেকেও এগিয়ে এই শকুন। এতো উপকারী প্রাণী হওয়ার সত্ত্বেও শকুন কারো পছন্দের পাখি না। এর কারণ হতে পারে দুটো; এক শকুনের চেহারা ভাল না দুই তার খাদ্যাভাস। শকুন প্রেমি হওয়ায় কখনো কখনো আবেগে প্রেমিকাকে শকুনী বলে অবশ্য পিটুনি খেয়েছি। যাই হোক শকুনী মামা বলতে উপকারী মামা না হয়ে আমরা কুচক্রী মামা বুঝি।

আগেই বলেছি মানুষ অদ্ভুত তার থেকে বেশি অদ্ভুত তার কল্পনা বা চিন্তা। এরা দুর্বলকে হেয় করে আর হিংস প্রাণীর প্রশংসা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ মানুষের যতোটুকু ক্ষতি করেছে এখনো করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে এমন ক্ষতি কোন পশু বা অন্য কোন প্রাণী করেছে কিনা কেউ বলতে পারবে না। এক পাকিস্তানী আমাদের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, এক হিটলার ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেছে। এছাড়া একটি দেশ আরেকটি দেশের কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। সম্পদ ও ক্ষমতার জন্য এই ১০০ বছরে ২০ কোটির উপর মানুষ হত্যা হয়েছে। অথচ মানুষ অন্য নিরীহ প্রাণীদের নাম নিয়ে প্রতিনিয়ত গালাগালি করে যাচ্ছে! এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়। মানুষ মানুষকে গালি দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মানুষকেই ব্যবহার করা উচিত অহেতুক অন্য প্রাণীদের টেনে আনা কেন! যেমন গালি হতে পারে হিটলার, গালি হতে পারে গো আযম, গালি হতে পারে সাকা। অথচ গালাগালি করা হয় উপকারী প্রাণীর নামে! তাই পশু বা অন্য কোন প্রাণীর নামে গালাগালি বন্ধ হওয়া উচিত। তাই সবশেষ বলতে হয় গাইল্লাও (গালি দাও) তোমার মানুষের নামে।

আইডিয়া- গোলাম মুরশিদের প্রবন- “পাশবিক ভাষা” থেকে।

ফেব্রুয়ারী ২, ২০১৫

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.