সমাজ বলতে আলাদা কোন বস্তু নয় বরং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে মানুষের জীবনধারা, আচারণ-আচরণ ও জীবন ধারার একটা ছককেই বুঝি মশাই। আমি যে সমাজে বড় হয়েছি সেটি খুব উন্নত নৈতিক সমাজ না হলেও যে বর্বর তা বলা যাবে না। ছোট বেলায় যখন স্কুলে যাই তখন মালাউন, মুসলিম এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হই। ছোট বেলায় বুঝতে পারি; মালাউন একটি নেতিবাচক শব্দ। পিতার কাছে জিজ্ঞেস করলাম মালাউন অর্থ কী? পিতা বলল-যারা বলে তারা না বুঝে বলে এর অর্থ জানার দরকার নেই। কেউ এই নামে ডাকলে উত্তর দেবারও প্রয়োজন নেই। আমার এখনো মনে আছে আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবা মুসলিম কী? বাবা বলেছিল এটা একটা নাম। আমরা সবাই মানুষ এটাই আমাদের পরিচয়। কর্মই ধর্ম এটাই হল আমার বাবার দর্শন। তাই হয়তো কখনো ধর্ম বা হিন্দু-মুসলিম নিয়ে মাথা ঘামানোর ব্যগ্রতা জাগেনি মনে। তাই মানুষের সাথে মেশার ক্ষেত্রে ধর্মীয় চিন্তা ও আঞ্চলিকতপ্রীতি ছিল বিচারহীন ভাবে।
আমাদের শহরে একটি টাউন হল এখনো আছে। ছোট বেলায় শুনতাম এবং অল্প অল্প দেখছিও যে, ঐ টাউন হলে কবিতা, নাটক, নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। যদিও কয়েক বছর আগ থেকে টাউন হলটি টাউট হল হয়ে মদ ও জুয়ার আসর হিসেবে গড়ে উঠেছে। ছোট বেলায় খুব লাজুক স্বভাবের ছিলাম বলে কখনো কবিতা পাঠ, গান বাজনাতে উপন্থাপন করিনি। তাই অন্যদের মতন সবসময় দর্শক হতাম। তবে হ্যা! ছবি আঁকায় অংশ নিতাম। ছবি হোক বা না হোক তা তো কেউ দেখছে না সুতরাং আঁকাই যায়। তাই এঁকে ঝুকা করে জমা দিলেই তো হলো। কী এঁকেছি তা তো জানি তাই বিজয়ী সে ঘোষণা পর্বের আগে বন্ধুরা মিলে বাসায় চলে আসতাম। বিনয়ী হয়ে বলছি না আমার ছবি আঁকা দেখলে পিকাসো হার্ট ফেল করে মারা যেতেন। ওনার সৌভাগ্য আমার ছবি আঁকার আগেই তিনি মারা গেছেন। ছোট বেলায় একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে ফুল চুরি তারপর খালি পায়ে শহিদ মিনারে ফুল দিতে যেতাম। খালি পায়ে যেতাম বলে ইটের গুতো, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো পায়ে লাগত। তারপরও সবাই মিলে যেহেতু যেতাম এবং সরস্বতী পূজোর আগের রাতের মতন ফুল চুরির একটি পর্ব থাকত বিধায় একুশের প্রভাতটা অন্য রকম ছিল। এক সময় এলাকার কবিতা পাঠের সাইনবোর্ডগুলোও বেশ চকচকে ছিল। অসংখ্য শিক্ষার্থী হয়তো এখন আর যায় না তাই রাস্তায় পড়ে থাকা সিগারেটের ফিল্টারের মতন সাইনবোর্ডগুলো মলিন হয়ে থাকে।
আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে আছি। এযুগে আমারা উপরের দিকে তাঁকিয়ে থাকতে শিখেছি তাই পায়ের কাছে সুন্দর ঘাস ফুলটির যে মাড়িয়ে ফেলছি তাতে আমাদের খেয়াল নেই। সীমার মধ্যে থেকে অসীমতার দিকে ছুটছি আমরা। ছোট বেলায় আমাদের একটি মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে আমাদের বাবা মা; লেখা পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। যিনি লিখেছেন তার নামটা মনে আসছেন না তবে তিনি যে একটি মুলা ঝুলিয়ে আমাদের সর্বনাশ করে গেছেন তা ওনার নাম স্মরণে না আসলে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে; তিনি সর্বনাশের ১২টা বাজিয়ে গেছেন। বলতে লজ্জা নেই একটা চাকরি আর দুটো ভাত জুটানোর জন্যে পড়ালেখা শেখা। কারণ পড়ালেখা না করলে চা’য়ের দোকানে পানি টানতে পাঠানো হবে এমন ধমক কম খাইনি জীবনে। যখন নির্বোধ থেকে কিছুটা বোধের দিকে ধাবিত হলাম তখন মনে ভাবনায় আসল পড়ালেখা করে সবার কেন চাকরিই করতে হবে। পড়ালেখা তো বলা যায় আত্মশুদ্ধির বিষয় কিন্তু বিয়ে করতে গেলে ডিগ্রি লাগে বিধায় একাডেমিক সার্টিফিকেট খুব গুরুত্বপূর্ণ। নারী মহলে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে একখানা বাক্য রচনা করতে যাচ্ছি! যেমন অনেক বান্ধবীকে দেখেছি ভার্সিটিতে পড়ছে কারণ এতে লেবেল বৃদ্ধি পেল! ফলে ভাল জামাই পেতে সুবিধা হবে। কারণ আজকালকার ছেলেরা ঘরে গৃহস্থালী করতে নিতেও ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে চায়। গৃহের কাজকে আমি মোটেও ছোট করছি না কারণ গত তিন বছর ধরে গৃহের কাজ আমিও করে যাচ্ছি। কিন্তু এমন খাটনিওলাকে কামকে আমাদের দেশে মূল্যায়ন করে না। বিদেশে বেবি কেয়ারে বেবিদের দেখাশুনা করে ঘন্টায় দশ ডলার কামানো যায়। সে যাই আমাদের বান্ধবীরা তাই অনেকে বিয়ে করে অনেক সময় আর একাডেমিক লেবেলটা চুকাতেন না। কিন্তু আমাদের কী হবে, আমরা তো আর বিয়ে দেয় না উল্টো গাটের পয়সা খরচ করে আমাদের বিয়ে করতে হয়। তাই পড়াশুনা মনোযোগ বা পাশের জন্য ক্লাশে উপস্থিতি দেওয়া ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় কোন অপশান ছিল না।
আমার বাবা এলাকার গণ্যমান্য সুশীল সমাজের একজন ছিলেন। বিভিন্ন সভা, মিছিল করে বেড়াতেন। এলাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্লাব ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখতে পারলাম এসব ক্লাবগুলো আস্তে আস্তে মাস্তানটাইপ মানুষগুলোর দখলে চলে গেল। যেমনটি আজকাল এলাকার রাজনৈতিক টেন্ডারবাজদের দেখলে যেমন রিয়েকশন হয় ওদের দেখলে তেমন হতো। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয় বাদে পাড়া মহল্লা বা ওয়ার্ডের মিছিলে রাজনৈতিক কর্মীদের চেহারা দেখলে টোকাই, মাস্তান, সন্ত্রাসী, ধর্ষক ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। এরা মমতাজের মতন গায়িক/গায়িকাগুলোর মতন ভাড়ায় খাটা রাজনৈতিককর্মী। মমতাম জিয়াকে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন, তারেক জিয়াকে ভাই বলেছিলেন। সেই গানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলন চত্ত্বরে মমতাজের সাথে তার ভাই তারেক জিয়াও নর্তন-কুর্দন করে ছিলেন। সেই মমতাজ শেখ হাসিনাকে নিয়েও গায় গেয়ে এমপি হয়ে গেলেন। বছর দুয়েক আগে এক ছোট ভাই ঢাকায় আসল। সে তার এক বড় ভাই’র সাথে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে সন্ধ্যারপর আড্ডা দিতে যায়। শুনে ভাবলাম বাহ বেশ তো। ঠিক লাইনেই তো আছে ছোট ভাই। কিছুদিন পর জানলাম; আসলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আড্ডা হয় না হয় জুয়া! আর সে বেশ জুয়োর নেশায় পড়ে গেছে। হ্যা শুনতে খারাপ লাগলেও আমাদের ঢাকা শহরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামে দখল করা রুমগুলোতে জুয়া আর মদের আড্ডাই হয়। ঢাকা ক্লাব উচ্চবার্গীয় জুয়াখোরদের জায়গা তাই আমজনতার ভরসা ঐ মুক্তিযোদ্ধা সংসদগুলো বা আবাহনী মোহামেডাম টাইপ ক্লাবগুলো। ওখানেও একই চিত্র।
সরকার চেঞ্জ হওয়ার ২৪ ঘন্টা না যেতে বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম হয়ে যায়। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে যে সময়টুকু লাগে এসব সংগঠন সরকারকে ঐ সময়টুকুও দেয় না। স্কুল পালিয়ে রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না তবে নেতা হওয়া যায়। এই নেতারা আলোকবর্ষের গতিকে হার মানিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ছবি, ব্যানার ও নিজেদের পদ ঘোষণা করে দেয়। এটিকে লুটপাটের একটা উৎকৃষ্ট রাস্তা বলা যেতে পারে। বাড়ির সামনে পড়ে থাকা সরকারের খাস জমিতে কয়েক দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলের ঘর উঠে। স্বাধীনতা দিবস বা জাতীয় শোক দিবস উদযাপনটা বেশ কমেডি টাইপ হিসেবে পালন করে তারা। কালো সানগ্লান মুখে বিড়ি লাগিয়ে সারাদিন বিভিন্ন গান বাজিয়ে যায়। আর পাশ দিয়ে কোন মেয়ে গেলে বিনামূল্যে ইভ টিজিং তো থাকছেই। তো যাই হোক এসব অনুষ্ঠানের জন্য যেহেতু মোটা অংকের চাঁদা দেওয়া হয়েছে সুতরাং সারাদিন মাইক বাজিয়ে তা হালাল করতে পিছ পা হয় না তারা। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িটি মানুষের ভালোবাসায় তিলে তিলে তৈরি হয়েছিল। অতীতে মানুষ রাজনৈতিক দলকে খুশি হয়ে চাঁদা দিয়ে যেত। ভাষা আন্দোলনের সময় ড.আনিসুজ্জামানের মা নিজের মৃত কণ্যায় (যদি আমার স্মৃতি বিশ্বাঘাতকতা না করে থাকে একটা লেখায় পড়েছিলাম) সোনার চেইন ফান্ডে দিয়ে এসেছিলেন। এখনকার রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মুখের দিকে তাকালে দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে হয় না। কারণ এদের আচার-আচরণ বলে দেয় এরা কেন রাজনৈতিক দলের কর্মী হয়েছে। আমি ড.ইমতিয়াজের মতন শৈশব এদের কাছে আশা করছি না মশাই, যে ক্লাশ নাইনে থাকা অবস্থায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ভারত যায় কিন্তু বয়স কম হওয়ায় এবং অসংখ্য সিনিয়র থাকায় মুক্তিবাহিনী থেকে তাকে ফিরিয়ে দেয়। একটি দলের রাজনৈতিক কর্মী অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা হল শিকড়। সমাজের নাগরিকরা এদের থেকেই সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা অথবা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন পেয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের বেশির ভাগই আসলে মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। সমাজের ছোটখাট ছিচকা চোর বাপটার ছাড়া বেশির ভাগ অপরাধী আসলে রাজনৈতিক দলের কর্মী। আমার এখনো মনে আছে আমার এলাকায় মৃতদের দাফন করার জন্যেও রাজনৈতিক কর্মীরা টাকা চাইত। চাঁদা ছাড়া সরকারী কবরস্থানে এরা কবর দিতে দেবে না তারা। শকুন গরু মরার জন্য বসে থাকে আর এরা মানুষের কোন পারিবারিক উৎসব অথবা কেউ বাড়ি তুলছে কিনা তার জন্য বসে থাকে।
নাহ মশাই আমি এখানে বদনাম করতে বসি নাই। আমি সে সমাজে থাকি যেগুলো আমি দেখে বড় হয়েছি সেগুলো চিত্রের বর্ণনা করলাম মাত্র। আপনি হয়তো আমার থেকে ভাল কোন সমাজে বড় হয়েছেন তাই হয়তো এগুলোর দেখার দুর্ভাগ্য আপনার হয়নি। দুই মাস আগে দেখলাম স্কুলের ঝাড়ুদার নিয়োগ করা হবে এর জন্য চার লাখ টাকা পর্যন্ত দর উঠল। মোটেও অবাক হইনি। যে সমাজের মানুষ তার পরিবারকে একটু ভাল রাখার জন্য অশ্চিত যাত্রায় সামুদ্রিক টলারে চেপে বসে সেখানে একটা চাকরির জন্য চার লাখ তা হবেই। আমাদের সমাজে যে ছেলেটা ভার্সিটির গন্ডি পার হতে পারেনি সেই ছেলেটা ফাস্ট ক্লাশ পাওয়া ছেলেটার চাকরি দেয়। নাহ মশাই আমিও ঐ টেনেটুনে ভার্সিটি পাশ করা ছেলেগুলোর দলেই। কিন্তু কষ্ট হয় যখন দেখি সমাজে ময়ূর না বরং লোমহীন শেয়ালের কদর বেশি। সমাজে এদের শক্তিই বেশি তাই এদের মুখোমুখি না হয়ে পাশ কাটিয়ে চলাই আমাদের সমাজিক জীবন। আর এই এমন একটা জীবন নিয়ে আমরা করব পর্যন্ত চলে যাই। আমরা শুধু দেবদূত চাই যে সাতই মার্চের ভাষণের মতন আবারো জনসমুদ্রের নেতৃত্ব দেবেন কিন্তু কেউ সেই দেবদূত সৃষ্টি করতে চাই না, কেউ দেবদূত হতে চাই না। তাই কল্কি অবতার কিংবা জিসুর ফিরে আসার মতন কোন দেবদূতের পানে চেয়ে মাইর খাওয়া আমাদের নিয়তি।
জুন ২২, ২০১৫