ফাও খাওয়া!

“ফাও খাওয়া” এই শব্দটির সাথে প্রথম পরিচয় হয় ভার্সিটিতে এসে। রাজনৈতিক দলের পাণ্ডারা ফাও খেয়ে থাকেন। সবাই ফাও খায় না তবে অসংখ্য পাতি নেতারা ফাও খেয়ে থাকে। নেতা হয়ে যাওয়ার পর নিজে ফাও না খেলেও নিজের গ্রুপ বা দলের নবাগত মাস্তানদের ফাও খাওয়ার সুযোগ করে দেন। দুই দিন আগে তিতুমীর কলেজের ছেলেরা ফাও খাবারের জের ধরে দোকান মালিকদের সাথে মারামারি করে অতঃপর তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ৩০টি গাড়ি ভাংচুর করে নিজেদের মাথা ঠাণ্ডা করে। শুধু তিতুমীর নয় রাজনৈতিক দলের নেতারা বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন কাজ করে থাকে। ঢাকা কলেজের সামনে, নীলক্ষেতের মারামারি বেশির ভাগ সময় এই ফাও খাওয়াকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তাই ছাত্র লীগ ফাও খাচ্ছে! বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ছাত্র দল ফাও খেয়েছিল। এটা আমাদের দেশে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ৪-৫ বছর কোমল পানীয় পাওয়া যেত না। এখনো অসংখ্য দোকানে কোমল পানীয় রাখা হয় না। তাই ডিংক্স পাওয়ার একমাত্র স্থান ডাকসু অথবা আইবিএর ক্যান্টিন। হলের দোকানগুলোতে অনেক দোকানে কোক রাখা হয় না আর রাখলেও রাখা হয় নিন্ম মানের পানীয়। মানে যে ডিংক্স গুলোতে লাভ বেশি। এর একমাত্র রাজনৈতিক দলের পাণ্ডাদের ফাও খাওয়া। দামী সিগারেটও দোকানদার লুকিয়ে রাখ। সবার কাছে বিক্রি করতো না। এমন অনেক পাণ্ডাদের চিনতাম দোকানে তাদের বাকি পড়েছে ৭০ হাজার! কল্পনা করতে পারেন একটি ক্ষুদ্র দোকানে কয় বছর টাকা না দিয়ে বাকি করেছে এতোগুলো টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছেলে হলে আসার আগে ফাও খাওয়ার হাতে খড়ি তাদের ছিল না। হলে ভাল রুম, রাজনৈতিক বড় ভাইদের চোখে পড়ার লোভে অনেকেই মাস্তানি ও মারামারি শুরু করে দেয়। আপনি যে মাস্তান তা দেখানোর ভাল আরেকটি জায়গা হল হলের ক্যান্টিন। এরা নির্লজ্জের মতন সবার সামনে ফাও খেয়ে চলে যাবে। আর ক্যান্টিন মালিক পেছনে নিজের মনে গালাগালি করবে। জগন্নাথ হলে মনির ভাই ক্যান্টিন খুব নাম করা ছিল। অন্য ক্যান্টিন থেকে কিছুটা দামে বেশি কিন্তু পেট ভরে অন্তত খাওয়া যেত। মনির ভাই লোকটার বয়স ৫০-৫৫ এর মতন। বাপের বয়সী এই লোকটাকেও ফাও খাওয়া বাহিনী অনেক বার চড় মেরেছে। চড় মারার কারণ ছিল, তিনি ফাও খাওয়া বাহিনী থেকে টাকা চেয়েছেন। এই ফাও খাওয়া বাহিনী তো ফাও-ই খেয়ে যায় কিন্তু এর মাশুল দিতে হতো আমাদের। কারণ ফাও খাওয়ার পরিমাণ যতো বাড়বে খাবারের মান ততো বেশি খারাপ হবে! এটাই স্বাভাবিক কারণ ক্যান্টিন মালিক তো নিজের বাড়ি বেঁচে ওদের ফাও খাওয়াবে না।

প্রতিটি হলে অসংখ্য রাজনৈতিক গ্রুপ থাকে। মানে দল একটা কিন্তু গ্রুপ তো অসংখ্য। তাই ফাও শুধু এক গ্রুপের কেউ খায় না। অসংখ্য গ্রুপের ছেলে ফাও খেয়ে থাকে। এক গ্রুপের পাঁচজন যদি ফাও খায় তাহলে সেই গ্রুপ থেকে যে গ্রুপ শক্তিশালী সে ১০ জনকে ফাও খেতে পাঠায়। ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া নিয়েও প্রভাব বিস্তারের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন হলের ক্যান্টিনে আবার রাজনৈতিক টেবিল থাকে। মানে এই টেবিলগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। রাজনৈতিক পাণ্ডারা এই টেবিলে বসবে। ঢাবিতে টেবিলে বসা নিয়েও কম মারামারি হয়নি।

বিএনপির আমলে ক্যাম্পাসে এক সন্ত্রাসী ছিল। নাম তেহারী করিম। সূর্য সেন হলের ছাত্র দলের সম্পাদক ছিলেন। তবে তার সামনে সূর্য সেন হলের প্রেসিডেন্টও ভয়ে কথা বলত না। তার নাম করিম। তেহারী করিম নাম হল; সে নীলক্ষেতে ‘রয়েল তেহারী’তে তেহারী খেতে গেছে। খাওয়ার পর টাকা চাওয়াতে দোকানদারকে অস্ত্র ঠুকায়। সেই থেকে তার নাম তেহারী করিম। সামনে সবাই করিম ভাই কিন্তু পেছনে ঐ তেহারী করিম বলেই সম্বোধন করতো। যাই হোক তিনি সূর্য সেন হলের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় বাড়ি করেছে, সাদা নোহা গাড়িও কিনেছে। এতো বেশি আকাম ও এতো নেতাদের মেরেছে যে আওয়ামী লীগ জেতার আগের রাতে হল ছেড়ে পালিয়ে যায়। তার চেলাচামুণ্ডারা অনেকে হল ত্যাগ করেছে অনেকে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে নিজের হল সিটটা বাঁচিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলে নিন্ম মানের খাবার দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু খাবার কেন নিন্ম মানের হয় সেই দিকে কেউ নজর দেয় না। সমগ্র ভার্সিটিতে প্রকাশ্যে অথবা নীরবে ফাও খাওয়ার সংস্কৃতিতে ডুবে গেছে। পাতি নেতা প্রথমে ফাও খেয়েই নেতা হওয়ার হুংকার দেয়। হ্যাঁ! উপরের কথাগুলো বাংলাদেশের সেরা বিদ্যালয়ের চিত্র। শুধু ঢাবিতে নয় সমগ্র বাংলাদেশেই একই চিত্র। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি এখন ফাও খাওয়া, টেন্ডার-বাজি, গুণ্ডামিতে রূপ নিয়েছে। এই অধঃপতনটা চূড়ান্ত রূপ নেয় ৯০ দশকের পর। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি কতোটা নেতিবাচকটায় রূপ নিলে ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সময় লাকি আক্তার যখন নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ছাত্র রাজনীতি করে এই কথা যখন বলতে যান তখন সাংবাদিকরা বলে; নাহ আপনি ব্লগার হিসেবে নিজের পরিচয় দেবেন।

অনেকেই নিজ দলের কর্মীদের ফাও খাওয়া, টেন্ডার-বাজির কথা উঠলেই বলা শুরু করে তারা প্রকৃত কর্মী নয়। আমার প্রশ্ন হল; যদি প্রকৃত কর্মী না হয়ে থাকে তাহলে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেওয়া হল? রাজনৈতিক দলের ঐ কর্মীরা দলের নাম ও নেতার শক্তিতেই আমার/আপনার পকেট থেকে টাকা নিচ্ছে। তাহলে আমি কাকে দোষারোপ করব? রাজনৈতিক শেল্টার ছাড়া কেউ টেন্ডার-বাজি কিংবা ফাও খেতে পারেন না। তাই এসব দায় সারা বক্তব্য দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। বর্তমানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-তরুণ লীগ আরও হাজারো লীগ ফাও খাওয়া থেকে শুরু করে সকল কিছুই করছে রাজনৈতিক দল ও নেতার নাম নিয়ে ও পরোক্ষ শেল্টারে। তাই এই অপরাধের মাশুল রাজনৈতিক দলকেই দিতে হয়, এই দায় এড়ানোর কোন সুযোগ রাজনৈতিক দলগুলোর নেই।

জুলাই ৮, ২০১৫

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.