ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন হলে (একাত্তর হল) সকল ধর্মের ছেলেরা সিট পাবে এমন একটি সংবাদ দেখি। এই প্রসঙ্গে অনেকে আনন্দিত সেই সাথে ধর্মের ভিত্তিতে হল প্রদান করা উচিত কী অনুচিত না নিয়ে অনেকে মতামত দিয়েছেন। অমুসলিম ছেলেদের জন্য জগন্নাথ হল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মের ভিত্তিতে হল আলাদা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি চোখে লাগে। তবে বাস্তবতার কারণে ধর্মের ভিত্তিতে হল বরাদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যাচ্ছে না! একাত্তর হলের বিষয়ে সবার সাথে আমিও আনন্দিত। তবে বাস্তবতার কারণে অমুসলিমদের জন্য আলাদা হল এখনো জরুরী। কেন জরুরী তা আলোচনা করা জরুরী।
মেয়েদের হলগুলোতে ধর্মের ভিত্তিতে হয় নাহ। সেখানে রাজনৈতিক আধিপত্য সামান্য থাকলেও বেশিরভাগ সিট বন্টন হয় মেধা বা ভর্তি পরীক্ষার সিরিয়ালের ভিত্তিতে। অন্যদিকে ছেলেদের জন্য আলাদা আলাদা হলের ব্যবস্থা আছে। ছেলেদের হলগুলোতে মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্ধ হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮তম হয়ার সাথে সাথে ফাস্ট ও সেকেন্ড সেমিস্টারে প্রথম স্থান অধিকার করেও সলিমুল্লাহ হলে আবেদন করেও আমার বন্ধু আসন পায় নি। অবশেষে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে রাজনৈতিক দলের মিছিলে যাবে এমন শর্তে বারান্দায় সিট মেলে। যদিও সে তা গ্রহণ করে নি। এই বারান্দায় থাকা লোকজন আবার রাজনৈতিক মারামারি বা পাণ্ডামীতে দক্ষতা দেখিয়ে রুমে উত্তিন্ন হয়। এছাড়া এলাকার বড় ভাইয়ের সাথে সক্ষতা রেখে বড় ভাইয়ের ফেলে যাওয়া সিট নিজের নামে বরান্ধ নিয়ে নেয়। মোটা দাগে বলতে হয়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের হলগুলোতে রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক শক্তির ভিত্তিতে সিট দখল হয়। যারা রাজনৈতিক মিছিলে অংশ নেওয়ার বিপরীতে সিট নিচ্ছে নাহ তারা এলাকার পরিচিত বড় ভাই খুঁজে নিয়ে সিট বরাদ্ধ নিচ্ছে।
মেয়েদের হলগুলোতে আদুবোন খুব একটা পাওয়া না গেলেও ছেলেদের হলগুলোর সিট আদুভাইদের দখলে। জগন্নাথ হলে থেকে অনেকে দশ বছর চাকরি করেছে এখনো করছে এমন রেকর্ডও আছে। এক বড়ভাই আমার রুমে থাকত ওনার এইচ.এস.সি ১৯৯৬ সালে! তিনি রুমের একটি সিট দখল করে রাজনীতি করছেন এবং পাশাপাশি চাকরি করছেন। রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়ায় কেউ ওনাকে বিরক্ত করছে না। এরকম অসংখ্য আদুভাই ঢা.বির হলগুলোতে অবস্থান করছেন। মার্স্টাস শেষ হওয়ার পরও চাকরি পাওয়া পর্যন্ত অনেকে অবস্থান নিয়ে থাকেন। মূলত ভাল মেসের অভাব, অর্থ সংকটের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী চাকুরী পাওয়া পর্যন্ত হলে অবস্থান করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে হল কর্তৃপক্ষ থেকে খুব কম ছাত্রই সিট বরাদ্ধ পেয়ে থাকে। এছাড়া প্রতিটি হলে অসংখ্য রাজনৈতিক রুম হয়েছে। যেগুলোতে হল কর্তৃপক্ষ সিট বরাদ্ধ দিতে সাহস পায় না। আর যদি বরাদ্ধ দিয়েও দেয় তার বিপরীতে বরান্ধ পাওয়া ছেলেটি সিটটি পায় না। আসন সংকটকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মিছিলে মানুষ বাড়ানো হচ্ছে। ঢাবিতে প্রথমবর্ষে আসন পেতে গেলে ৯৮% ছেলেকে রাজনৈতিক দলে যুক্ত হতে হয়। যখন যে দল ক্ষমতায় তখন সেই দলের মিছিলে যেতে হয়।
অমুসলিম সকল ছেলেদের জন্য জগন্নাথ হল। জগন্নাথ হলের মন্দিরে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান ধর্মের মূর্তি বা প্রতীক স্থান পেয়েছে। এখন কথা আসে সবার যদি একই হল হয় তাহলে কী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা তাদের হলে ভিন্ন ধর্মের কোন প্রতীক মেনে নেবে কিনা। তারা হয়তো ভিন্ন মন্দির স্থাপনের পক্ষে যাবে কিন্তু একই রুমে ভিন্ন ধর্মকে ঠাঁই দেবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে মুসলিম হলগুলো থেকে গুটি কয়েক রাজনৈতিক কর্মী কর্মসূচীতে আসত। সবচেয়ে বেশি আসত জহুরুল হক হল থেকে। তাও পঁচিশ জনের বেশি নয়। জিয়া হলগুলোর মতন ছোট হল থেকে আসত সাত, আটজন। অন্যদিকে জগন্নাথ হল থেকে আসত দুই’শ থেকে তিন’শ! জগন্নাথ হলের ছেলেরা না আসলে মিছিল বা ছাত্রলীগের কর্মসূচী শুরু হতো না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করেছে জগন্নাথ হলের ছেলেদের। এখানে এই প্রসঙ্গটি টানার অর্থ হল; বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিটের উপর যতোদিন নিজেদের ১০০% নিয়ন্ত্রন আনতে পারছেন নাহ ততদিন ধর্মের ভিত্তিতে হলের বিরোধীতাও করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেলা ভিত্তিক সংগঠন আছে। আবার আছে উপজেলা ভিত্তিক সংগঠনও। অতীতে এসব সংগঠনের দরকার থাকলেও বর্তমানে এগুলোর কোন দরকার নেই। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তিস্বার্থে এগুলো এখানো যেমন চালু আছে তেমনি আছে আমাদের সংর্কীণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি এলাকার ভাই ব্রাদারদের ধরে সিট বরাদ্ধ নেয় অনেকে তেমনি সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদকও হয় ক্ষমতা, আবার অনেক সময় ধর্মের ভিত্তিতে। ঢাবিতে যারা পড়ে তারা যে খুব উদার নাহ তার পরিচিয় মেলে এসব সংগঠনের অস্তিত্বের কারণেই।
ফলে ঢাবির প্রশাসন যদি সিটের উপর নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে না পারে সেক্ষেত্রে সবার জন্য হল তৈরি করলেও সংখ্যায় কম যারা তারা সংখ্যাগুরুর সাথে পেরে উঠবে না। এটাই বাস্তবতা। ধর্মের ভিত্তিতে হল তুলে দিয়ে যদি সংখ্যালঘুদের থাকার জায়গা দিতে না পারি তাহলে ছেলেগুলো যাবে কোথায়? নতুন একাত্তর হলের ছেলেরা অন্য ধর্মের ছেলেদের জায়গা দিতে চায়নি সেখানে কীভাবে বিশ্বাস করব হল প্রকাশনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অন্যরা হলগুলোতে জায়গা পাবে? বরং আঞ্চিলক কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে সংখ্যালঘুরা পিছিয়ে পড়বে। এছাড়া খাবারের কিছু সমস্যা তো আছেই। সনাতনীরা গরু খায় নাহ, খ্রিস্টানরা শুকর খায়। তবে সংখ্যাগুরুর আপত্তিতে শুকর রান্না না হলেও গরু রান্না তো হবে। খাবারের কারণে সংখ্যালঘু ছাত্রদের অনেকের আপত্তির থাকতে পারে। তবে ক্যান্টিন আলাদা করে (ওখানে গরু, শুকর রান্না হল না) এই বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সিটের বিষয়ে যদি হল প্রশাসনের ক্ষমতা না থাকে তাহলে সবার জন্য হল করেও সংখ্যালঘুরা সেখানে কোনঠাসা থাকবে। তাই সবার আগে দরকার হলের উপর হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ। তাহলে ধর্মের বিরুদ্ধে হল-এর বিরোধীতা করা সহজ হবে অনেকেই এর সাথে যুক্ত হবে, এছাড়া তা সম্ভব নয়।
ধর্মের ভিত্তিতে হলের পক্ষে আমিও নই। তবে বাস্তবতার কারণে তা মেনে নিতে হচ্ছে। আশা করি একদিন হল কর্তৃপক্ষ হলের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবেন এবং একদিন এই ধর্মের ভিত্তিতে হল প্রথার অবসান ঘটবে। এই দিনের প্রত্যাশায় রইলাম।