আমাদের সংবিধান

রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার জন্য মানুষকে অজস্র রক্ত দিতে হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো আজ সেই মানুষগুলোর রক্তের উপর দাড়িয়ে আছে। পৃথিবীর যেখানেই রাজার শাসন ছিল সেখানে প্রতিটি রাজা দাবী করেছেন; তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি তাই জনগণকে শাসন করা তাদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমেরিকায় কখনো রাজা ছিল না। অন্যদিকে ইউরোপের মানুষগুলো যখন আমেরিকায় বসতি গড়ছে তারাও ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার জন্য আমেরিকায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে জোর দেয়। ফলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে শুরু করেন জনগণের ভোটে, ফলে কোন পবিত্র অধিকারের বলে রাষ্ট্র পরিচালনার করার সুযোগ আর থাকল না। একই বিষয় ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও।

১৮৪৬ সালের পর থেকে ইংরেজি ভাষায় সেকিউল্যারিজম বলতে অনেক সময় বোঝান হয়ে থাকে জর্জ জ্যাকব হোলিওক-এর মতবাদকে। হোলিওক ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) তিনি মনে করতেন বিধাতা থাকতেও পারেন নাও থাকতে পারেন, পরকাল থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে। তা নিয়ে তর্ক করা যায়। কিন্তু মাটির পৃথিবীর ও তার বুকে মানুষের প্রাণ যাত্রা প্রত্যক্ষ সত্য তা নিয়ে তর্ক করার কোন অবকাশ নেই। তাই আমাদের সকল কর্মের লক্ষ্য হওয়া উচিত পার্থিব জীবনের কল্যাণ। যদি কেউ পরকাল বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে ভাল কাজ করলে সে তার ফল পাবে। আর যদি পরকাল নাও থাকে তাহলেও ক্ষতি নেই। হোলিওক মনে করতেন-মানুষ যত কারণে অসুখী হয় তার মধ্যে দারিদ্র্য প্রধান। তাই মানুষের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য হওয়া উচিত রাষ্ট্র থেকে কেউ যাতে বঞ্চিত না হয়। কেউ যাতে গরীব থাকতে না পারে। তবে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে হোলিওক এর বিশেষ মতবাদকে বুঝি নাহ। আমরা বুঝি; সেখানে সরকারী ধর্ম বলতে কিছু নেই। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ইহলোক, বেহেস্ত নিয়ে আমরা আলোচনা করব না।

ব্যক্তির ধর্মচর্চার স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে। প্রতিটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়ে থাকে ততটুকুই যতোটুকুতে সমাজ বা ভিন্ন ব্যক্তির অসুবিধা বা সমস্যা না হয়। ১৮৩০ সালের দিকে আমেরিকায় নতুন এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এরা নিজেদেরকে মরমন বলে(mormon), মরমনরা বলে যে, যেহেতু একমাত্র নবি ইসা ছাড়া অন্য সকল নবী বহু বিবাহ করেছে সেহেতু বহুবিবাহ অন্যায় কিছু নয়। এমন বক্তব্যের ফলে আমেরিকায় নিন্দার ঝড় উঠে এবং আইনগতভাবে এদের নিষিদ্ধের দাবী জানান হয়। পরবর্তীতে মরমনরা নিজেদের বহুবিবাহের বিষয়টি থেকে সরে আসে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় অসংখ্য মামলা হয়। আমেরিকার সংবিধানে লেখা হয়- কোন ব্যক্তিকে চাকুরীর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য ধর্ম সর্ম্পকে প্রশ্ন করা যাবে না। এক মামলাকারী অভিযোগ করেন মেরিল্যান্ড প্রদেশে বিধাতার নামে শপথ নিতে হয়। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় তাদের কাছে বিষয়টি বিব্রতকর ও এর মাধ্যমে তাদের বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করা হয়। যা আমেরিকার সংবিধানের পরিপন্থী। আদালত মামলাকারীর পক্ষে রায় দেয় এবং এই প্রথার অবসান ঘটে। তবে আমেরিকার প্রেসিডন্টকে বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করতে হয়।

বাংলাদেশের সংবিধান গঠন করা হয় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। এরপর সংবিধানের অনেক ধারার পরিবর্তন এসেছে, অনেক নতুন ধারাও যুক্তি হয়েছে। লক্ষ্য করতে দেখা যাবে বাংলাদেশের সংবিধান শুধু থেকে ছিল ক্রুটিপূর্ণ ও একে অপরের সাথে সার্ঘষিক। ক্রুটিযুক্ত হওয়ার দোষের নয় কিন্তু সেই ক্রুটিকে স্থায়ী করে বৈধতা দেওয়া অন্যায়। যেমন-সংবিধানে বাংলাদেশের সকল মানুষকে ‘বাঙালি’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল যা ছিল ক্রুটিপূর্ণ। কারণ এই দেশের সবাই বাঙালি নয়। বাঙালি ছাড়া ত্রিশের বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী এই বাংলাদেশে ছিল। ফলে এই ‘বাঙালি’ জাতির সাথে তাদের কথা না লিখার ফলে তাদের জাতিগত পরিচয় সাংবিধানিকভাবে অস্বীকার করা হল। এরকম চাপিয়ে দেওয়া সংখ্যাগুরুর স্বভাব। সংখ্যাগুরু নিজের প্রভাব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সবসময় ক্ষুদ্র অংশের উপর তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তা অযৌক্তিক হলেও।

সবাইকে বাঙালি করার মতন একাত্তর যুদ্ধে সবাই আল্লাহ উপর বিশ্বাস স্থাপন করে যুদ্ধ গেছে তা স্পষ্টভাবে আমাদের সংবিধানে লেখা আছে। লক্ষ্য করুণ এখানে সৃষ্টিকর্তা না বলে আল্লাহ উপর বিশ্বাস স্থাপনের কথা উল্লেখ করা আছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কোন অবিশ্বাসী কী যুদ্ধে যায় নি? প্রশ্ন আসে; তৎকালীন বৃহৎ অমুসলিম জনগণ কী আল্লাহ উপর বিশ্বাস স্থাপন করে যুদ্ধে গিয়েছিল? হাজার হাজার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কী আল্লাহ উপর বিশ্বাস স্থাপন করে যুদ্ধ করেছিল? সহজ বাক্যে না, তারা যে যার যার সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রেখেই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। আল্লাহ শব্দটিতে আপত্তি থাকত না যদি আল্লাহকে ঈশ্বর কিংবা ভিন্ন নামে ডাকা সম্ভব হতো।

গণপ্রজাতন্ত্রী (প্রজা থাকলে তো রাজাও থাকার কথা, শব্দের মাইর প্যাচে তাই তো আসে। যদিও আমেরিকাও যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র লেখা আছে) বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা আছে-
[আমরা অঙ্গিকার করিতেসি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদেরকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্ধুগ্ধ করিয়াছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।]

রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক ভাষাকে বেছে নেয়। তাই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রয়োজন হয়। এরশাদ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে যুক্ত করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়; যখন কোন স্বৈরাচার কিংবা সামরিক শাসক ক্ষমতা দখল করেছে তখনই সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ্যের ধর্মকে যুক্ত করে জনগণকে খুশি করার চেষ্টা করেছে। জিয়াউর রহমান সংবিধানে বিসমিল্লাহ যুক্ত করেন, এরশাদ যুক্ত করেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পৃথিবীতে নেপাল একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই নেপাল হিন্দুরাষ্ট্রের তকমাটি সংবিধান থেকে মুছে ফেলে। অনুভূতিপ্রবণ রাষ্ট্র হওয়ায় রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি আমরা মুছে ফেলতে পারি নি।

সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহে লেখা আছে- [সর্বশক্তিমান আল্লহ উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভত্তি!] ধর্ম কেন্দ্রিক গন্ডি থেকেও যদি ভাবতে হয় তাহলে সবার জন্য সর্বশক্তিমান প্রভু কিংবা সৃষ্টিকর্তা শব্দটি ব্যবহার করা কী উচিত ছিল না? আর আস্থা বিশ্বাস স্থাপন না কে কী কিছু করা যাবে না? তা কী আইন বর্হিভূত অপরাধ হবে?

সংবিধানে আরেকটি মজার বিষয় আছে। পৃথিবীতে বেশির ভাগ ইসলামিক রাষ্ট্রে কোন গণতন্ত্র নেই। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এরা সবসময় পাকিস্তানপন্থী ছিল। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর তারা বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দেয়। এছাড়া শেখ মুজিবের আমলে সৌদি আরব বাংলাদেশের মানুষের হজ্ব ভিসা বাতিল করে দেয়। গুটি কয়েক রাষ্ট্রবাদে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলো আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আর্ন্তজাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতি উন্নয়ন বিষয়ে লেখা আছে-
[রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সর্ম্পক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।]

বাস্তবতা যাই হোক না কেন আমাদের সংবিধানে চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সংবিধানে ৩৯ এ চিন্তা , বিবেক ও বাক স্বাধীনতার কথা বলা আছে। সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে।
৩৯।
() চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
() রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বৈদেশীক রাষ্ট্র সমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক, জনশৃংখলা, শালীনতা ও নৈকিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা সর্ম্পকে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবস্বাধীনতার অধিকারের এবং
(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সংবিধান কী বলে তা ৪১ নাম্বারে দেখা মিলবে। ধর্মীয় স্বাধীনতা-
৪১।
() আইন শৃংখলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে
() প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।
() প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনের অধিকার রহিয়াছে।

() কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।

ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে অবিশ্বাসী কিংবা ধর্মত্যাগীদের নিয়ে কিছু না বলা হলেও কাউকে ধর্মের বিষয়ে জোর করা যাবে না তা স্পষ্ট করে বলা আছে। পাকিস্তানের আদালত ২০০৭ সালে ভিন্নধর্মালম্বী শিক্ষার্থীদের ইসলাম বিষয়ক বই জোর করে পড়ানোর বিরুদ্ধে রায় না দিলেও তা কার্যকর হয় নি। ফলে বর্তমান অমুসলীম শিক্ষার্থীরা ইসলাম ধর্ম পড়তে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্র এখনো সেই পর্যায়ে যায় নি। তবে ধর্মীয় বিষয়টি অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে থাকা উচিত যার ইচ্ছা সে এই বিষয়টি নিয়ে পড়বে, জোর জবরদস্তি করা যাবে না।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.