এক ফিলিস্তিনীর সাথে কথোপকথন

নাম সামির।বয়স আনুমানিক চল্লিশ। জন্মসূত্রে সিরিয়ান হলেও মূলত সে ফিলিস্তিনী। কারণ তার পিতা ফিলিস্তিনী। প্রচণ্ড ভাল একটা মানুষ। তাই তার সাথে সহজে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অবসর পেলেই তার দেশ তার আদি-ভূমি ফিলিস্তিন বিষয়ে আলাপ করি। ফিলিস্তিনী ও কুর্দিরা সাধারণত তিন থেকে চারটা ভাষায় দক্ষ হয়। হয়তো এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানাস্তরিত হওয়ার কারণ কিংবা তাদের আত্মীয়-স্বজন ভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে এরা সবাই মূলত তিন থেকে চারটা ভাষা বলার দক্ষতা অর্জন করে। সামির ঈশ্বর ভক্ত হলেও চিন্তা-চেতনায় উদারতা ও সহনশীলতার কোন কমতি তার মধ্যে নেই। সামির বলে তুমি যদি কোন বাস’কে শ্রদ্ধা কর তাতে আমার বাঁধা দেওয়ার কিছু নেই তেমনি তুমি কিছু যদি বিশ্বাস নাও কর তাহলেও তোমাকে আমার কোন কিছু বলার অধিকার আমার নেই। ছুটি দিন থাকায় সুযোগ হল তার ব্যক্তিগত ভাবনা ও চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে জানার। এখানে বলে রাখা ভাল তার বক্তব্যগুলো সম্পূর্ণটাই তার ব্যক্তিগত মতামত। যেহেতু সে ফিলিস্তিনী তাই তার চিন্তা-চেতনা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

ফিলিস্তিনী বন্ধুটির কথা শুনে মোটামুটি ধাক্কা খাওয়া মতন অবস্থা। জন্মসূত্রে সিরিয়ান হলেও তারা নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় ফিলিস্তিন এর সাথে তার যে সম্পর্ক আছে তা উল্লেখ করতে ভুলে না। কথা প্রসঙ্গে বলল আমাদের পাসপোর্টে সিরিয়ান লেখা থাকলেও নিচে ফিলিস্তিনী লেখা থাকে। ফিলিস্তিনী লেখা থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশ আমাদের ভিসা দেয় না। এমনকি সিরিয়ান পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আমাদের পাশের দেশে যাওয়ার সময় অনুমতি লাগবে যা সিরিয়ানদের লাগে না। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলল; যেহেতু আমরা ফিলিস্তিনী সেহেতু তাদের ধারণা আমরা যদি তাদের দেশে যাই তাহলে আর কখনো ফিরে আসব না। এই ভয় থেকে তারা কখনো ফিলিস্তিনদের ভিসা দেয় না। কথা প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনদের পক্ষে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কথা উঠে আসল।

ফিলিস্তিনদের জন্য তো অনেক ফান্ড-কালেক্ট হয় সেই ফান্ড কি ফিলিস্তিনরা পায়?

-ফিলিস্তিন এর জন্য ভেতরে ও বাহিরে যতো যতো সংগঠন আছে এদের বেশির ভাগের মূল উদ্দেশ্য নিজেদের অর্থ সংগ্রহ। এই মূল বিষয়টা তোমার মাথায় রাখতে হবে। এর বাহিরে খুব কম সংগঠন আছে যারা প্রকৃত অর্থে আমাদের জনগণকে সাহায্য করে। তুমি যদি আমাদের পক্ষে কাজ করতে কিংবা আমাদের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে তাহলে তো তুমি ফাইভ স্টার হোটেলে শুয়ে আমাদের পক্ষে প্রচার করতে না। তুমি এক দিকে বলছ তুমি আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছ অন্যদিকে তুমি ফাইভ স্টার হোটেলে ঘুরে বেড়াচ্ছ। অথচ আমাদের শিশুরা ঠিকমতন খেতে পারছে না। হামাস আমাদের স্বাধীনতার জন্য কাজ করলেও হামাসের ভেতরে অনেক মানুষ আছে যারা আসলে হামাসকে ইউজ করছে নিজেদের স্বার্থে। ফলে দিন শেষে হামাসের যুদ্ধও আমাদের থাকছে না বরং ফল ভোগ করছে অন্যরা। অর্থের মালিকও হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন।

ফিলিস্তিনে যে সমস্যাটা এর সমাধান তুমি কীভাবে দেখ? এই যুদ্ধ কি আদও থামবে নাকি অনন্তকাল ধরে এভাবে যুদ্ধটা চলতে থাকবে। ইসরাইলের যে ভূমির দাবী সেটা কীভাবে দেখ?

-বিষয়টা আসলে Complex । ফিলিস্তিনের ভূমিটা ছিল নবী মুহাম্মদের চাচার জমি। পরবর্তীতে কিছু ফিলিস্তিনী অতিরিক্ত টাকা পেয়ে এই জমি ইসরাইলের কাছে বিক্রি করে দেয়। এটা কোন গল্প না এটা বাস্তবতা। তবে মনে রাখতে হবে সবাই বিক্রি করে নি। ইহুদিদের ধর্মীয় বইতে ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেছেন এই জমি তাদের তিনি দেবেন। এই কারণে তুমি যদি ইসরাইলকে এর থেকে বড় জায়গা দাও তারপরও তারা কিন্তু এই জায়গা ছাড়বে না। ঠিক ফিলিস্তিনদের যদি এর থেকে ভাল জায়গা দাও তারপরও এই জায়গার উপর তারা তাদের দাবী ছাড়বে না। তোমাকে সহজ ভাষায় বোঝাই। ধর তুমি তোমার দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছ। কিন্তু ঐ বাংলাদেশ তো তোমার জন্মস্থান, তোমার বাবার জন্মস্থান। ফলে তুমি তোমার প্রজন্মকে সেই ভূমির কথা বলবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঐ ভূমির কথা বলবে। এবং স্বপ্ন দেখাবে একদিন না একদিন আমরা ঐ ভূমিতে ফিরে যাব। ঐ ভূমি হবে শুধুই আমাদের। এই স্বপ্ন ফিলিস্তিন ও ইহুদিদের মধ্যেও আছে। অন্যদিকে আমাদের দুই ধর্মেই আছে দুই ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করার কথা, হত্যা করার কথা। ফলে তুমি যদি সবকিছু ভুলে বন্ধু হতে চাও তারপরও আসলে অন্তরে অবিশ্বাসটা ঠিকই থেকে যায়।

তাহলে তোমার কথা অনুযায়ী আমরা বলতে পারি মুসলিম ও ইহুদিদের একে অপরের প্রতি যে ঘৃণা তার উৎপত্তি কিংবা বিকাশের কারণ পবিত্র বইগুলো?

-আমি যেহেতু বিশ্বাসী সেহেতু আমাকে মানতেই হবে পুরো বইটা। কোন বিষয় বাতিল করার সুযোগ নেই। আমার ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা নেই কিন্তু আমি একজন মুসলিমকে যেভাবে দেখি সেই ভাবে তো ইহুদিদের প্রতি বিশ্বাস আমার আসে না। কারণ ছোট বেলা থেকে আমি পবিত্র বইতে এদের বিরুদ্ধে কথা পড়ে এসেছি। তাই কেউ শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে চাইলেও গোরা ইহুদি ও মুসলিম তা হতে দেবে না। কারণ এরা একে অপরের প্রতি ঘৃণা করে। ইহুদিদের বইতেও লেখা আছে এই ভূমির মানুষগুলোকে হত্যা কর। ইসরাইল রাষ্ট্র যখন সৃষ্টি হল এরপর তারা ফিলিস্তিনে এসে সৈন্য বাহিনী দিয়ে কিছু মানুষ মেরে ফেলল। এই দৃশ্য দেখা সবাই ঐ অঞ্চল থেকে প্রাণ নিয়ে পালাল। ফলে ওরা আমাদের অনেক জমি দখল করে নিল। জেরুজালেম একটি উষ্ণ অঞ্চল। থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ না যেহেতু এই অঞ্চলটির সাথে ইতিহাস জড়িত আছে সেহেতু এটি সবার কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই জমির ভাগ কেউ ছাড়বে না। আজ ইসরাইল কবজা করেছে কালকে মুসলিমদের ক্ষমতা হলে তারা করবে। এই জমি যতদিন থাকবে ততদিন আসলে যুদ্ধ চলতে থাকবে।

অনেকে প্রমাণ করে দেখায় যে বর্তমান ইসরাইলের নাগরিকরা যারা দাবী করছে এই ভূমি তাদের পূর্ব পুরুষের তা সঠিক নয়। তুমি এই বিষয়টি কীভাবে দেখ?

-ধর সৌদি আরবের সকল মানুষ মারা গেল। তখন কাবার অধিকার কি অন্য কারো হবে না কাবা মুসলিমদেরই থাকবে। পৃথিবীর সকল মুসলিম আরবের মক্কাকে নিজেদের বলে দাবী করবে। সেরকমভাবে এরা কেউ যদি আদি ইহুদিদের বংশধর নাও হয় তারপরও এই ভূমির অধিকার দাবী করা ন্যায় সংগত কারণ আমি যেহেতু বিশ্বাসী সেহেতু আমি জানি এই ভূমিতে তাদের অধিকার আছে। কারণ কিতাবে ঈশ্বর তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করেছে এই জমি তাদেরকে একদিন না একদিন তাদের দেবেই। তবে তারা নিজেদের ভূমিতে এসে আমাদের উচ্ছেদ করে ভূমি থেকে তাড়িয়ে দিল। একসময় তাদেরকে অন্যরা তাড়িয়ে দিল আজকে তারাই আমাদের তাড়াচ্ছে, আমাদের হত্যা করছে। এটা খুব দুঃখজনক।

ধর তোমাকে একটা অপশন দেওয়া হল; ইউরোপ অর আরব দেশগুলো। তুমি কোথায় যেতে পছন্দ করবে?

-আমি ব্যক্তিগতভাবে আরবের দেশগুলোতে যেতে পছন্দ করব। কারণ আমার ভাষায় মিল আছে, আমাদের কালচারের সাথে মিল আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা আমাদের জায়গা দেবে না। মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই এগুলো বোগাস কথাবার্তা। একটা মানুষ পরিচিত হয় তার জাতির মাধ্যমে ধর্মের মাধ্যমে না।

একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করি। তুমি হয়তো জান সৌদি আরব অন্য কোন ধর্মের উপাসনালয় বানাতে দেয় না। এই বিষয়টি তুমি কীভাবে দেখ?

-প্রতিটি রাষ্ট্রের আইনকে আমি শ্রদ্ধা করি। তারা যদি এই আইন করে আমার কোন আপত্তি নেই। তেমনি ইউরোপ যদি বলে এখানে মসজিদ বানাতে দেব না তাতেও আমার আপত্তি নেই। কারণ আমি রাষ্ট্রের আইনকে শ্রদ্ধা করি। আল্লাহ কে ডাকতে গেলে মসজিদের দরকার নেই। আমি যখন এখানে আসি তখন আমি মসজিদ কোথায় জানতাম না। তাই শুক্রবারে আমি মাঠে নামাজ পড়েছি কিংবা ঘরে পড়েছি। এখন যদি এই দেশ বলে যে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হবে তাহলেও আমার কোন আপত্তি নেই। নামাজ ঘরে পড়া যায় এর জন্য মসজিদ থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তবে তোমার কথা আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কী জানতে করতে চাচ্ছ। হ্যাঁ, কিছু মানুষ আছে যারা সৌদি আরবের আইনের পক্ষে কথা বলবে আবার এই দেশে এমন আইন করলে তার বিরোধিতা করবে। এরা আসলে সুবিধাবাদী। আমি এই দলে না।

সিরিয়ার আজকের এই অবস্থার কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে?

-আসলে এই জিনিসটিও তোমাকে বলে বোঝান কঠিন। তুমি যদি সিরিয়ায় না যাও তাহলে কখনো বুঝবে না কী হচ্ছে ওখানে কিংবা কীভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। সংক্ষেপে তোমাকে বলি- বাশার যখন ক্ষমতায় আসল তখন সে সংবিধান পরিবর্তন করে দেয়। আমাদের ধর্মীয় মানুষগুলোর মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা উস্কে দেয়। ফলে জাতিতে জাতিতেও যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দিরা মুসলিম হলেও তাদেরকে কেউ কিন্তু সহ্য করতে পারে না। কুর্দিদের দমন করতে সবাই কিন্তু তৎপর। তুরস্ক আইএসআইএল দমন করতে যতোটা না তৎপর তার থেকে বেশি তৎপর কুর্দিদের দমন করতে। সিরিয়ার এই সংকট সহজে থামবে বলে মনে হয়। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের একটা অংশ বাশারকে সাপোর্ট করছে আরেক পক্ষ পরোক্ষভাবে আইএসআইএলকে সাপোর্ট করছে। আবার আরেক পক্ষ বাশার বিরোধী আন্দোলনকে সাপোর্ট করেছে। ফলে এতো বেশি গ্রুপিং যে সিরিয়ার পরিস্থিতি সহজে সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না।

ইসলামের যে জঙ্গিবাদ তা তুমি কীভাবে দেখ?

-এই জঙ্গিবাদ কিন্তু করছে একটি ক্ষুদ্র অংশ। এদের কাছে অন্যদের মতন কিন্তু আমরা মুসলিমরাও নিরাপদ না। আমার বাড়ি, কোম্পানি মিসাইল মেরে উড়িয়ে দিল। আমার পরিবার সেখানে ছিল না বলে তাঁরা বেঁচে গেছে। এই মিসাইল কিন্তু অন্য কেউ মারে নাই। নিজেদের দেশের লোকই মেরেছে।

ইউরোপে তুমি কীভাবে আসছ? কেন আসছ?

-সিরিয়া থেকে সবাই পালাচ্ছে। ওখানে কোন দূতাবাস নেই ওরাও পালাচ্ছে। ইউরোপ আসার জন্য আমি একা ১০ হাজার ডলার খরচ করেছি। নৌকায় করে শুধু ইউরোপ পৌঁছে দেবার জন্য। বিমানে আসলে আমার দুই তিন হাজার ডলারের বেশি লাগত না। জন প্রতি দশ হাজার ডলারের কারণে আমি আমার স্ত্রী, সন্তানদেরও নিয়ে আসতে পারি নি। আমি যদি এখানে থাকার কাগজ পাই তাহলে আমি তাদের নিয়ে আসতে পারব। তারা এখন একটি ক্যাম্পে আছে। যেখানে বিদ্যুৎ আসে মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টার জন্য। বাসায় থাকলে তাদের কথা শুধু পড়ে। তাই আমি সারাক্ষণ বাহিরে ঘুরে বেড়াই। রাতের বেলায় মোবাইলে তাদের ছবি দেখলে কান্না আসে।
এখানে আসার মূল কারণ। এখানে থাকার অনুমতি পেলে আমি আমার পরিবারকে নিয়ে আসতে পারব। এরা শরণার্থীদের যে সুযোগ সুবিধাগুলো দেয় তা অন্য রাষ্ট্র দেয় না। ফলে সবাই ইউরোপের দিকে আসতে চাচ্ছে।

তোমার দেশ সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ হলে কিংবা ফিলিস্তিন স্বাধীন হলে তুমি কি চলে যেতে চাইবে?

-অন্যদের কথা জানি না। তবে আমি চলে যাব। কারণ ওটা আমার দেশ। আমিও সবার মতন স্বপ্ন দেখি একদিন আমি নিজের ভূমিতে ফিরে যাব। শরীরে মাখব মাতৃভূমির মাটি।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.