ধর্মে-সমাজে নারী

arabtriple
আরবের দেবীরা

নারী’র প্রতি সকল ধর্ম কম-বেশি নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপন করেছে। তৎকালীন সময় বিচারে পৃথিবীর বড় ধর্মগুলোর মধ্যে সামাজিক অর্থে ইসলাম সবার আগে নারী’কে অধিক সম্মান দিয়েছে। এটাও সত্য ইসলামের আগমন হয়েছে অন্যান্য ধর্মগুলোর অনেক পরে তাই স্বাভাবিকভাবে কিছু আপডেট ভার্সন এখানে আছে। আরবে যখন বিভিন্ন গোত্রে হানাহানি চলছিল তখন নারী আর পুরুষের অনুপাত প্রায় ২৫:৭৫ হয়। ফলে গোত্রগুলোর মধ্যে হানাহানি থামানোর জন্যে, সবাইকে এক ছায়ার তলে আনার লক্ষ্যে নতুন ধর্মের আগমনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। গোত্রগুলোর মধ্যে অধিক হারে হানাহানির ফলে অধিক সংখ্যক রমণী বিধবা হয়ে পড়ে। এখানে স্মরণ রাখা উচিত নবী মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী’ খাদিজা ছিলেন বিধবা। বিধবা নারীরা যাতে বেঁচে থাকতে পারেন সে জন্য আরবে নারী’দের সম্পত্তি দেওয়ার প্রথা শুরু হয়। অধিক সংখ্যক বিধবার কারণেই পুরুষের বহু বিবাহ সমাজে সেই বিচারে ভারতবর্ষে গোত্রে গোত্রে মারামারি-কাটাকাটি নেই তাই অধিক সংখ্যক নারী বিধবা হওয়ার মতন পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয় নি। তবে মূল কারণটি হল, ভারতবর্ষে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা তখনও ছিল না। সাধারণ মানুষ ছিল দাসের পর্যায়ে। সকল কিছুর মালিক ছিল রাজা আর জনগণ ছিল রাজ্যের অধিনে জীবন-যাপনকারী প্রাণী মাত্র।

গ্রিক পুরাণ থেকে শুরু করে আরব সমাজ, ভারতীয় সমাজে ধর্মীয় ভাবে নারীর ঐশ্বরিক অবস্থান ছিল। আরবে এক ঈশ্বর মতবাদের পূর্বে নারী’রা দেবী হিসেবে পূজিত হয়ে আসছিলেন। আল্লাহ’র তিন কন্যা আল লাত, আল উজ্জা, আল উজ্জা আল্লাহ সাথে সাথে পূজা পেয়ে আসছিলেন। উজ্জা হল আরব দেশের চন্দ্রদেবী, মানত ছিলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন চন্দ্রদেবী আর উজ্জা ছিলেন দীপ্তি আঁধিয়ার সমন্বিত চন্দ্রদেবী। এই তিন দেবীর মধ্যে মানাত সবচেয়ে প্রাচীন । কুরাইশদের একটি অংশ হুবাল বা আল্লাহর তিন কন্যার  উপাসনা করতো। ‘আল্লাহ’ নামক এক ঈশ্বরবাদ শব্দটি আরবে অতীতেও ছিল। আল্লাহ শব্দটি নবী মুহাম্মদের নিজস্ব কোন মৌলিক আবিষ্কার নয়। তিনি দেবতাদের মধ্যে যিনি টপ ছিলেন, তাঁকেই ঈশ্বর ধরে অন্যদের বাতিল করে দিয়েছেন মাত্র। ধারণাটি পরিষ্কার হওয়ার জন্য আমরা নবী মুহাম্মদের পিতার নামটি আমরা স্মরণ করতে পারি। ওনার নাম ছিল-‘আব্দুল্লাহ’! আব্দুল্লাহ শব্দের অর্থ ‘আল্লাহ দাস’! তাহলে স্বাভাবিকভাবে স্পষ্ট ছিল যে নবী মুহাম্মদের জন্মের পূর্বে আরব অঞ্চলে ‘আল্লাহ’ নামক দেবতার অস্তিত্ব ছিল। আরবে যখন শুধু টপ অব গডের (আল্লাহ) ধারণা প্রতিষ্ঠিত হল তখন স্বাভাবিকভাবে অন্যদের পূজা বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর গুড়িয়ে দেওয়া হয় দেবী মূর্তিগুলোকে। সেই সাথে চন্দ্রদেবী’রা মানুষের আরাধনা থেকে বাদ পড়েন।

ভারতবর্ষে এক ঈশ্বর ধারণার পাশাপাশি বহু দেবতার ধারণার জন্ম হয়। দেবতার পূজার পাশা-পাশী পূজা পায় দেবী’রাও। দেবী দুর্গা ভারতীয় দেবী।  যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত।  সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি তিনি। তমোগুণময়ী মহা কালী, রজোগুণময়ী মহালক্ষী এবং সত্ত্ব-গুণময়ী মহাসরস্বতী। মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, গন্ধেশ্বরী, সুবচনী, অন্নপূর্ণাদিও এই মহাশক্তিরই অংশ। শক্তিবাদ এই দেবী দুর্গাকেই কেন্দ্র করে অঙ্কুরিত, পরিবর্ধিত ও পূর্ণতা পায়। ভারতবর্ষের পৌরাণিক নারী’রা ধর্মীয়ভাবে পূজা পেলেও সামাজিকভাবে ঠিক নিগৃহীত যেমনটি মুসলিম সমাজে তারা যুগের পর যুগ ধরে হয়ে আসছে। তবে কিছুক্ষেত্রে মুসলিম সমাজ অনেক এগিয়ে ছিল যেমন-নারী’র বহু বিবাহ, সম্পত্তির দাবিদার। এর মূল কারণ ছিল আরবের সামাজিক অবস্থান। আরব এমন একটি অঞ্চল যেখানে কৃষি কাজ হতো না। যুদ্ধ-লুট, ব্যবসাই ছিল তাদের প্রধান পেশা। গোত্রে গোত্রে হানাহানির ফলে অধিক সংখ্যক নারী এক সাথে বিধবা হয়ে যেতেন। ফলে বহু বিবাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে এই বহু বিবাহ যেন স্বেচ্ছাচারিতায় জন্ম না দেয় তার জন্য ইসলামে প্রথম বৌ’য়ের অনুমতিক্রমে চারটি বিয়ের নিয়ম করে দেওয়া হয়। ভারতবর্ষে যে কেউ স্বল্প সময়ে বিধবা হতো না তা কিন্তু নয় কিন্তু আরবের মতন গোত্রে গোত্রে চুলোচুলি অন্তত ছিল না। ভারতের অনেক দেবী জন্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা ঐ অঞ্চলের কিংবা ঐ সমাজের নারী যোদ্ধা ছিল। পরবর্তীতে তারা দেবী মর্যাদা লাভ করেন। এই ক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি উত্তর পূর্ব ভারতের মনিপুর রাজ্যের  ইরম শর্মিলাকে। যিনি ভারতে মনিপুর রাজ্য থেকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহারের জন্য গত চোদ্দ বছর ধরে অনশন করছেন। ঐ অঞ্চলের অনেকে তাঁকে দেবী হিসেবে কল্পনা করে থাকেন।

একটি বিষয়ে প্রায় সময় বিতর্ক দেখা যায় এবং শরীয়ত-পন্থীরা এই ইস্যুতে বেশ বিপদে পড়েন তাহলো-ধর্ষণ। ধর্ষণ কথাটি কোন ধর্মে নেই। এটি মূলত যুগের সীমাবদ্ধতা। কারণ ধর্মগুলো যেসময় নাজিল হয়েছিল সেসময় সাধারণ নারী ‘ব্যক্তি’ হয়ে উঠে নি। ধর্ষণ শব্দটি আসল তখন, যখন প্রতিটি নারী ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। ধর্মে অবৈধ মিলনের কথা উল্লেখ আছে কিন্তু ধর্ষণের কোন কথা নেই। শরিয়তি মোল্লারা অবৈধ মিলনের যে শাস্তি তাই ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে প্রয়োগ করেন। অথচ অবৈধ মিলন ও ধর্ষণ এক নয় তা একটি কিশোর বয়সী ছেলেও জানে কিন্তু ধর্মের এই সীমাবদ্ধতা যাতে প্রকাশ না পেয়ে যায় তার জন্য তারা দু’টি কে এ পাল্লায় মেপে থাকেন! নারী যখন ব্যক্তি হয়ে উঠলেন তখন তার শরীর শুধু তার হল। এই শরীরের সাথে পুরুষের মিলিত হতে হলে নারী’র অনুমতি আগে নিতে হবে। অনুমতি না পেয়ে কিংবা অনুমতির ধার না ধেরে জোর করে মিলিত হওয়ার চেষ্টার নাম-ধর্ষণ। আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে আরব সমাজে পুরুষের শরীরের উপর নারী’র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও যৌনতায় অন্যান্য সমাজের মতন নারী সবসময় দাস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ফলে ধর্মীয়ভাবে নারী যদি পুরুষের কথা মতন যৌনতায় অংশগ্রহণ করতে না চায় সেক্ষেত্রে পিটুনি দেওয়ার আদেশ দেওয়া আছে।

ভারতবর্ষে দেবী’রা যতোটুকু ক্ষমতাবান সামাজিকভাবে ঠিক ততটুকু ক্ষমতাহীন। এর মূল কারণ উৎপাদন থেকে নারী’কে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে  নতুন প্রজাতির ধানের বীজ আবিষ্কার হয়। যতোটুকু মনে পড়ে, সামাজিক বিজ্ঞানীরা ঐ বীজের বিরোধিতা করেছেন এই কারণে যে, এই বীজ আলাদাভাবে বপন করতে হবে না ফলে শস্য উৎপাদনে নারী’র প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। ফলে উৎপাদনে যেহেতু নারী’কে আর লাগবে না সুতরাং কৃষি সমাজে নারী নির্যাতন বাড়বে। নারী যতক্ষণ উৎপাদ কিংবা পারিবারিক আয়ের সাথে যুক্ত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক ও পারিবারিক-ভাবে সে গুরুত্বপূর্ণ থাকে।

পূজো আসলে ইহ-জাগতিক সুখ, শান্তি ও সম্পদের আশায় মায়ের পায়ে মাথা নত করে ঘরে গিয়ে ঠিকই অসুর হিসেবে স্ত্রী’র কাছে হাজির হয়। তবে গৃহের অসুর সবসময়-ই সামাজিক দুর্গাকে পরাজিত করে থাকেন। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত সামাজিক অসুরের জয় আর গৃহের দুর্গার পরাজয়। এটাই যেন আমাদের সমাজের নিয়তি। দেবী দুর্গার মতন সামাজিক নারী’দের আগমনেই সমাজে পরিবর্তন আসা সম্ভব, অন্যথায় না।

অক্টোবর ২১, ২০১৫

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.