প্রিয় ফ্রান্স,
জানি এই চিঠি ফ্রান্সের কাছে পৌঁছাবে না কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তবুও চিঠি লিখতে বসলাম। গত ১৩ই নভেম্বর ২০১৫ তে মধ্যপ্রাশ্চ্যের আইএসআইএস জঙ্গিদের হামলায় ফ্রান্সের সাধারণ জনগণ রক্তাত্ত হয়েছে। ভিজে গেছে ফ্রান্সের রাজপথ। সেই হামলায় সকলের মতন আমরাও ব্যথিত হয়েছি। সাধারণ মানুষ যখন হামলার শিকার হয় তখন ঐ মৃত মানুষের মধ্যে নিজেই মানুষ খুঁজে পায়। যারা ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের উপর হামলা করেছে তাদেরই পূর্বপুরুষরা আমাদের বাংলাদেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। একাত্তর সালে আমেরিকার সাধারণ জনগণের মতন ফ্রান্সের জনগণ আমাদের সাথে ছিল। একাত্তর সালে ফরাসী আন্দ্রে মালরো বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই মালরো একাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্রান্সে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার বক্তৃতা-বিবৃতি আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক প্রেরণা হয়ে উজ্জীবিত করেছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। ফ্রান্স সরকারের উদ্দেশে তার করা আকুতি : ‘আমাকে একটি যুদ্ধবিমান দাও, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের শেষ লড়াইটা করতে চাই”। তাই ফ্রান্সের নাগরিক যখন আক্রান্ত হয়েছে তখন আমরা বাঙালিরা একহাতে নিজের পতাকা অন্যহাতে তাদের পতাকা তুলে ধরেছি। শুধু একাত্তর নয় ফ্রান্সের সাহিত্যিক, মনীষী, বিপ্লবীদের কাছে আমরা ঋণী চিন্তায় ও চেতনায়। তাই ফ্রান্সের ঘটনা অন্য কোন রাষ্ট্রে হলে এতোটা দরদ অনুভব করতাম কিনা সন্দেহ। এটাও সত্য যে, ফ্রান্সের জনগণ আক্রান্ত না হয়ে যদি ফ্রান্সের রাষ্ট্র প্রধান কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তি আক্রান্ত হতো তাহলে হয়তো এতোটা উত্তেজিত আমরা হতাম না।
ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন যে, তিনি ফ্রান্সের সাথে আছেন। প্রধানমন্ত্রী আরেকটি কথা বলা উচিত ছিল; যারা ফ্রান্সে হামলা করেছে তাদেরই পূর্বপুরুষদের বিচার বাংলাদেশে হচ্ছে। চল্লিশ বছর পর শত বাধা, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলাদেশে হচ্ছে তাই যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে বাংলাদেশের সাথে ফ্রান্সের দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধী বিচার শুরু হওয়ার পর বর্তমান সন্ত্রাসীদের পূর্বপুরুষদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফ্রান্স প্রশাসন বিবৃতি দিয়েছে। ফ্রান্সের বিভিন্ন সংগঠন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে অথবা বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। তোমার রাষ্ট্রের নাগরিকদের মতন আমাদের দেশের নাগরিকদের হত্যা করেছিল বর্তমান সন্ত্রাসীদের পূর্বপুরুষ। আমরা যখন এসব সন্ত্রাসীদের পরাজিত করলাম তোমরা তখন মানবতার নামে গণহত্যাকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছ। তোমরা বলতে ইউরোপ ও আমেরিকাকেই বুঝাচ্ছি। আমার দেশের জাতির পিতাকে যখন সিরিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তখন তোমরা সেই খুনিদের নিরাপদ জীবন উপহার দিয়েছ। একদিকে তোমরা জার্মানির যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে সহায়তা কর অন্যদিকে আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় দাও। তখন তোমাদের রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে আমারা অসহায় হয়ে পড়ি।
সন্ত্রাসী হামলায় তোমার জনগণ আজ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে আইফেল টাওয়ারের সিঁড়িগুলি কিন্তু তোমার হাতেও লেগে আছে শত শত মানুষের রক্তের দাগ। সন্ত্রাস দমনের নামে তোমার বন্ধু আমেরিকার সাথে তুমি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়। অনেক সময় বন্ধু রাষ্ট্রের সৈন্য যাওয়ার আগে তুমি সৈন্য পাঠিয়ে দাও। তোমাদের কাছে শুধু আমাদের মতন তৃতীয় বিশ্বের জনগণ অসহায় না তোমার রাষ্ট্রের জনগণও অসহায়। তাই তো দেখি ইরাক হামলার পূর্বের আমেরিকার জনগণ যখন রাস্তায় নেমে আসে তখন সরকার তা আমলে নেয় নি। তোমার রাষ্ট্রের জনগণ একদিনে প্রগতিশীল আন্দোলন করে যাচ্ছে অন্যদিকে তুমি সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে যাচ্ছ। তোমার জনগণের উৎপাদন করা সুন্দর ফুলটি তুমি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে না দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছ সন্ত্রাসবাদ। জনগণের হাতে ফুলের বদলে তুলে দিচ্ছ অস্ত্র!
অন্যরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদীদের নিজ-রাষ্ট্রে আশ্রয় দিয়ে সন্ত্রাসবাদ দমন করা যায় না। তুমি যদি ভেবে থাক সেই দানব শুধু অন্যদের কামড়াবে কিন্তু তোমার নিরাপদ ঘরটির বেড়া কাটতে পারবে না তাহলে তুমি ভুল। কারণ সেই দানবের বেড়া কাটার প্রয়োজন নেই তোমার সেই নিরাপদ আধুনিক বাড়ির ভেতরই জন্ম নেবে নতুন কোন দানব। তাই এসো, হাতে হাত ধরে এই দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। এই যুদ্ধ শুধু দানবের বিরুদ্ধে নয় যারা এই দানবকে মদদ দেয় তাদের বিরুদ্ধেও। যদি তা না করা সম্ভব হয় তাহলে মনে রেখ তোমাদের সেই মদদ দেওয়া দানব তোমাদের একদিন আহত করবে। আজকে যতোটুকু প্রাণহানি হয়েছে তার থেকে হাজারগুণ বেশি প্রাণহানি তখন দেখতে পাবে।
ইতি
বাংলাদেশ