কয়েকজন ফেসবুকে লিখলেন যে, তাদের এলাকায় ১৬ই ডিসেম্বর উপলক্ষে ২১শে ফেব্রুয়ারির গান বাজানো হচ্ছে। এই বিষয়টি গুরুতর তাই সহজে চোখে লাগছে। কিন্তু আরেক ভুল অনেকেই করেন তাহলো-১৬ই ডিসেম্বরকে বাংলাদেশের জন্মদিন বলা!
অনেকেই হয়তো ভাবছেন এটি আর কি ভুল। এটা বাচ্চা প্রসবের তারিখের মতন গণনা মাত্র। নাহ, এটি মারাত্মক ভুল এবং এই সামান্য ভুলে আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিজের অজান্তেই অস্বীকার করে ফেলেছেন। এই ভুল শুধু সাধারণ জনগণ করে না, দুই দিন আগে আমাদের একজন প্রতিমন্ত্রীও এমন ভুল স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ডাক দেওয়া হয় ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে। এর আগে ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ১৯৭১ সালের২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ২ মার্চ থেকে পাকিস্তান সরকারের সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ মাধ্যম বাঙালি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নিরীহ জনগণের উপর হামলা চালায়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করা হয়, অনেক স্থানে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় এবং অনেক স্থানে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। এমতাবস্থায় বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং অনেক স্থানেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করেই অনেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাবার পর আপামর বাঙালি জনতা পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করে। ২৬শে মার্চে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এবং সেই ২৬শে মার্চে প্রাণ হারায় ১০ হাজার বাঙালি। বাংলাদেশ ২৬শে মার্চ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হলেও দখলদার বাহিনী’কে সরাতে আমাদের সময় লাগে ৯ মাস। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আমরা কোন কোন শব্দ ব্যবহার করি। শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সচেতনভাবে। যেমন-হানাদার বাহিনী। হানাদার সে যে কিনা অন্যের সম্পত্তি কিংবা বাড়িতে হানা দেয়। সুতরাং আপনি যখন বলবেন ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্মদিন এই কথার সাথে সাথে আপনি আপনার অজান্তে যুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল জামাতিদের এমন দাবীকে স্বীকার করে নিলেন। এছাড়া ১৬ ডিসেম্বরকে ২৬ মার্চের চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার একটা হীন চেষ্টা আছে যার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য গভীর ছিল সবসময়। যারা এখনো ১৬ই ডিসেম্বরকে বাংলাদেশের জন্মদিন ভাবছেন তাদের জানা উচিত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সর্বপ্রথম এপ্রিল মাসে। দেশটি ছিল ইসরাইল। পরবর্তীতে ১৬ই ডিসেম্বরের পূর্বে ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভুটান।
যাই হোক, সেই রাজনৈতিক হিসেবে না গিয়ে সহজ ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বাংলাদেশের জন্মদিন কোনটি তা সঠিকভাবে জানুন। আবেগের ভুল শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা ভুল বার্তা দিচ্ছি। ১৬ই ডিসেম্বরে যেমন ভাষা আন্দোলনের গান চালানো যায় না তেমনি বিজয় দিবসকে বাংলাদেশের জন্মদিন বলা যাবে না। বাংলাদেশের জন্মদিন “২৬শে মার্চ ১৯৭১”।
স্বাধীনতার ঘোষণায় পদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে ‘আইনের প্রয়োগ আদেশ-১৯৭১ জারি করেন।
মুজিবনগর
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণায় আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল সে-সমস্তই প্রয়োজনীয় অবস্থানগত পরিবর্তনসহ পূর্বোক্ত ঘোষণাসাপেক্ষে বলবৎ থাকবে এবং সকল সরকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসামরিক, সাময়িক, বিচারবিভাগীয়, কূটনৈতিক যাঁরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবেন তাঁরা সকলেই তাঁদের স্বস্ব পদে চাকুরিবিধির শর্তনুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তাঁরা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁদের আওতাধীন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন।
এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।
স্বা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি