এক.
আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অতীত সরকারের তীব্র সমালোচনায় আবির্ভূত হয়। তারা অতীত সরকারের আমলকে এমন একটি শাসন ব্যবস্থা হিসেবে জাহির করেন তাতে মনে হয় অতীতে কেউ একটি ভাল কাজও করে নি। সবক্ষেত্রে যে সবাই বাড়িয়ে কথা বলে থাকেন তা সবার কাছে স্পষ্ট। এগুলো বলতে হয়, এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য! এটি শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয় এটি সমগ্র মানব সমাজের বৈশিষ্ট্য।
আরবে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার আগের প্রাক-ইসলামিক সময়কে ‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ বলে ইসলামপন্থীরা মত দেয়। তাদের অভিযোগ-সে সময় কোন নিয়ম-নীতির বালাই ছিল না, ছিল শুধু অনাচার-অত্যাচার। ধর্মীয় অনুভূতি পাশ কাটিয়ে যদি আমরা চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে পারি তাহলে স্পষ্টত দেখতে পাব; যতোটুকু বলা হয় সেরকম তেমনভাবে কিছুই ছিল না। সে সময় কা’বায় ভিন্ন-ভিন্ন সম্প্রদায়ের ৩৬০টি। কা’বা যার দখলে থাকতো সেই মক্কা নগরী নিয়ন্ত্রণ করতেন। কা’বা কে কেন্দ্র করেই মূলত মক্কার অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার চক্র আবর্তিত হতো। মুহাম্মদও সেই কা’বা, কাবার নিকটে অবস্থিত জমজমের কুপ নিয়ন্ত্রণকারী গোত্রের একজন সদস্য ছিলেন।
মুহাম্মদ যখন তার মতবাদ প্রচার শুরু করেন তখন অতীতের মতন কোরাইশরাও এর বিরোধিতা করে নি। যেহেতু খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সাথে বসবাস ছিল সুতরাং সেখানকার জামানায় এমন মতবাদ প্রচার ছিল স্বাভাবিক একটি ঘটনা। কারণ ইতোমধ্যে কোরাইশরা ইহুদি, খ্রিস্টান, হানিফি মতবাদসহ জরথুস্ত্রবাদ, জুডাইজমসহ বহু মতবাদ। তাই কেউ যদি দাবী করে মুহাম্মদের নতুন মতবাদ বা ধর্ম শুনে কোরাইশরা আশ্চর্য হয়েছে তাহলে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কা’বা নিয়ন্ত্রণ কিংবা ক্ষমতার কারণেই কোরাইশদের সাথে মুহাম্মদের শক্তির লড়াই শুরু হয়। এছাড়া মনে রাখতে হবে আরবে মোট নবীর সংখ্যা এক লাখের উপরে! প্রাক ইসলামিক যুগে হানিফ সম্প্রদায় নিজেদের একেশ্বরবাদ মতবাদ প্রচার করেছিলেন। তবে হানিফিরা নিজেদের কোন সংগঠন কিংবা ধর্ম তারা প্রতিষ্ঠা করে নি। নতুন মতবাদ কিংবা ভিন্ন মতবাদ প্রচারের ফলে কেউ শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছে এমনটা শোনা যায় না। সেই হানিফ’দের মধ্যে নবী মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী, প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী খাদিজার ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফলও ছিলেন। নওফল খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি মুহাম্মদকে আল্লাহ নবী বলে মন্তব্য করেছেন। মুহাম্মদ নিজের মতবাদকে প্রথমেই নতুন ধর্ম হিসেবে প্রচার করেন নি। বরং সুদূরপ্রসারী সামাজিক সংস্কার হিসেবে আল্লাহ বাণী প্রচার করতে থাকেন। যেমন-The sky will be cleft asunder and the earth shall be leveled” (84:1–3), and those who did not “free the slave” or “feed others in times of famine” would be engulfed in fire (90:13–20). প্রথম দিকে এই ধরণে বাণী প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনি নতুন কোন ধর্ম নয় বরং সমাজসংস্কার করতে চাচ্ছেন।
তথাকথিত জাহেলিয়া যুগে বিবি খাদিজা বিধবা অবস্থায় ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এই বিধবা ধনী নারী’কে কেউ আক্রমণ কিংবা বেইজ্জতি করতে চেয়েছে এমন কথা জানা যায় না। নতুন ধর্ম হিসেবে ইসলাম যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন বিনা বাধায় মুহাম্মদ তার নতুন ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তাহলে প্রশ্ন আসে; জাহেলিয়া যুগে এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? মুহাম্মদের উপর অত্যাচারের একটি প্রচলিত গল্প শোনা যায় তাহলো-এক বুড়ি পথে কাটা বিছিয়ে রাখতেন। এর থেকে বড় বাধার সম্মুখীন যদি হতেন তাহলে নিশ্চিত এই সামান্য গল্পটি এভাবে প্রচার হতো না। এছাড়া কোরাইশদের সাথে একবার ঝামেলার কারণে তারা মুহাম্মদের হত্যা করতে চেয়েছিল। যে রাতে তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় যায়। যাকে হিজরত বলা হয়। এছাড়া মুহাম্মদের ধর্মের অনুসারীগণ কখনোই বড় কোন অত্যাচার কিংবা খুনা-খুনির সম্মুখীন হয় নাই। তবে একবার তার দরিদ্র অনুসারীগণ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। তবে এর মূল কারণ ছিল-তাদের রক্ষার জন্যে কোন গোত্রপতি ছিল না। এছাড়া আবু বকর, ওমরের মতন ধনীরা ইসলাম গ্রহণের পরও নিশ্চিন্ত-নিরাপত্তায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া মুহাম্মদের মহিলা অনুসারীরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার কখনো হোন নাই। শুধু আবু বকরের বড় মেয়ে আসমা সর্বপ্রথম কোরাইশদের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হোন। সে নিগৃহীত ছিল-গালে মাত্র একটা চড়। অথচ ইসলামের শিশু অবস্থায় তার অনুসারীরা, নারীরা স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণ, হত্যার শিকার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তেমন কোন ঘটনার কোন উল্লেখ আমরা দেখতে পাই না। প্রাক-ইসলাম যুগ কিংবা অ-মুসলিম যুগকে বিজয়ী ইসলামিকরা ইচ্ছাকৃত-ভাবে এমন একটি নামে ডাকা হয় যার কোন সত্যতা কিংবা ইতিহাস পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক সে সমাজে ছিল তাতে নাগরিকের অপরাধ কর্ম স্পষ্ট হয় না।
দুই.
ন্যায্য বেতন, ভাতার দাবীতে কিংবা পয়লা বৈশাখের যৌন নিপীড়নের বিচার চাইতে গেলে রাষ্ট্র যেভাবে তেড়ে আসে কিংবা ইদের বেতন-বোনাদের বদলে গরম জল ও মরিদের স্প্রে দিয়ে যেভাবে জবাব দেওয়া হয়, বিচার বহির্ভূত ক্রসফায়ার, পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কিংবা সামরিক বাহিনীর রিমান্ডের সাথে অতীতের আরবের জাহেলিয়া যুগের যদি তুলনা করা হয় তাহলে অতীতের জাহেলিয়া আসলে ধোপে টিকবে নাহ। তবে হ্যাঁ, ধর্মীয় অনুভূতির কারণে বিচার বোধহীন মানুষের কাছে এই শব্দের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। পাকিস্তানের নৃশংসতা, রাষ্ট্রকর্তৃক নিপীড়নের যে দৃশ্য আমরা দেখতে পাই তাতে দ্বিধায় পড়ে যেতে হয় কোনটিকে আমরা জাহেলিয়া যুগ বলব! ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী কিংবা ইসলামপন্থীরা প্রতিনিয়ত যেভাবে লেখক থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল মানুষকে হত্যা কিংবা হুমকি, অমুসলিম মেয়েদের ধর্ষণের ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে স্পষ্ট হচ্ছে জাহেলিয়া যুগ দেখতে আমাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে সহনশীলতা, ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে সহবস্থান, মানুষের চিন্তা-স্বাধীনতার নূন্যতম সুযোগ-সুবিধা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ ও নির্বোধ অনুভূতিতে তারা এতোটাই অন্ধ ও উন্মাদে পরিণত হয়েছে যে মাঝে মাঝে তাদের অসভ্যতা অতীতের যে কোন হিংস্রতাকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নাম যে রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পেছনে যে মানুষটি তিনি হলেন জিন্নাহ। এই জিন্নাহ ছিলেন শিয়া খোজা সম্প্রদায়ের মানুষ। পাকিস্তান হল পৃথিবীর প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র যা একটি ভূ-খণ্ড থেকে বেরিয়ে শুধু মুসলিমদের জন্যে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠন করে। সেই রাষ্ট্রটির জাতির পিতা জিন্নাহ শিয়া হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের সুন্নিরা শিয়াদের রাষ্ট্র থেকে উচ্ছেদ করেছে। সহবস্থানে এই মানসিকতা যে শুধু ইসলামিক রাষ্ট্রে তাই নয় এটি বেশির ভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের। এর মূল কারণ তাদের অশিক্ষা ও ধর্মীয় উন্মাদনা। তাই পৃথিবীর যেখানেই তারা অবস্থান করুক না কেন মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার পূর্বে তাদের অনুভূতিটি হেফাজতের একটি তাগাদা তাদের মধ্যে দেখা যায়। যুক্তি-তর্কের ঊর্ধ্বে নির্বোধের গোঁয়ার্তুমি হল একমাত্র ভরসা।
কিছুদিন আগে শিয়া শরিয়া রাষ্ট্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন ফ্রান্সে যান। সেখানে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সাথে ডিনার করবেন। সেখানে তিনি আপত্তি তুলেছেন-ডিনারে ওয়াইন থাকা চলবে না। মানুষের খাদ্যাভাসের প্রতি শরীয়তীদের কোন শ্রদ্ধা না থাকলেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ডিনারে ওয়াইন যেন না থাকে তার অনুমতি দেন। কথা হচ্ছে; ওয়াইন তো নবী জিশু খেতেন। নিজের শিষ্যদেও ওয়াইন আপ্যায়ন করতেন। সুতরাং খ্রিস্টানদের কাছে ওয়াইন খাওয়া কোন হারাম জিনিস নয়। ডিনারে রুহানি’কে কেউ ওয়াইন খেতে নিশ্চয় জোর করা হতো না। কিন্তু নিজের রুচি, ইচ্ছা অনিচ্ছা ঠিকই চাপিয়ে দিলেন। যেমনটি প্রতিটি ধর্মান্ধ মুসলিম করতে পছন্দ করেন। গতকাল দেখলাম ড. হাসান রুহানি ইতালিতে যাবেন তাই ইতালির ভাস্কর্যগুলো সব ঢেকে দেওয়া হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের প্রথম পর্যায়ে ছবি আঁকা কিংবা ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা ছিল। পরবর্তীতে রেনেসাঁস-এর সময় খ্রিস্ট ধর্মের নানা মিথ’কে কেন্দ্র করে হাজারো ছবি, ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।
সম্ভবত বছর সাতেক আগে যখন ওরিয়ানা ফাল্লাচি’র “আমার ক্ষোভ আমার অহংকার” বইটি পড়েছিলাম তখন মনে হচ্ছিল তিনি হয়তো কয়টি বিষয় বাড়িয়ে বলছেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিক দৃশ্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে এতোটুকু এখন বুঝতে সক্ষম হয়েছি তিনি আসলে কিছুই বাড়িয়ে বলেন নি। বরং পরিস্থিতি আরো বেশি বাজে হবে। রুহানিদের জন্যে ভাস্কর্য ঢাকা হয় রুহানিদের অনুসারীরা ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। যেমনটি ভেঙে ফেলে হয়েছে-আফগানে কিংবা সিরিয়ায়। আইএস, তালেবান, ইসলামিক, ইসলামপন্থীদের সাথে এই এক জায়গায় মিল। তারা পৃথিবীকে কোন কিছু দিতে শেখে নি, শিখেছে শুধু ধ্বংস করতে, নষ্ট করতে। ১৫’শ বছরের ইতিহাসে যেসব বিখ্যাত মুসলিমদের নাম পাওয়া যায় তাদের বেশির ভাগই ছিল শরীয়তী ইসলামিকদের হাতে মাইর খাওয়া কিংবা অমুসলিম/ কাফের ঘোষণায় অলঙ্কৃত। সিরিয়ার একটি অংশ আইএস দখল করেছে। সেই অংশটি বেশির ভাগ মানুষ পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। তাদের কাহিনীকে পুঁজি করে মূলত অর্থনৈতিক সংকটের শরণার্থী হয়ে ইউরোপ আমেরিকায় অন্যরা পাড়ি জমেচ্ছে। এই পাড়ি জমানোর ভিড়ে ভুক্ত ভুগির থেকে অর্থনৈতিক সংকটের শরণার্থী সংখ্যাটাই বেশি। তাই জন প্রতি দশ লাখ টাকা খরচ করে ইউরোপে পাড়ি জমা দিতে কেউ পিছ পা হচ্ছে না। এই বিশাল সংকট অনুভূতি সম্পর্ক মানুষ যে কোন সময় ইউরোপের সামাজিক চিত্র বদলে দিতে পারে। এদের হাতে যদি ইউরোপ বন্দি হয় তাহলে দেখা যাবে- দল বেধে গিয়ে কোন বিখ্যাত ভাস্কর্য ধ্বংস করে আসবে। ভাস্কর্য দেখার জন্যে যে মন ও দেখার সৌন্দর্য থাকতে হয় তা এসব বেহেস্ত-মুখী ধার্মিকদের নেই। ফলে কখনো যদি ইতালির বড় বড় জাদুঘর ভাংচুর কিংবা বড় বড় শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো’র উপর এরা প্রস্রাব করে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কা’বা কোন মূর্তি নেই, সৌদি’তে কোন অমুসলিমদের বসবাস নেই সুতরাং এগুলো যেহেতু তাদের জ্ঞানের স্তম্ভ সেহেতু পৃথিবীর কোন সৃষ্টিশীল জিনিসই এদের কাছে হেফাজত নয়। আইএস যখন সিরিয়ার হাজার বছরের পুরাতন স্থাপত্য ধ্বংস করে দেয়, তালেবান যখন আফগানিস্তানের বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করে দেয় ঠিক একই আদর্শের কারণে ঢাকা বিমান বন্দরের সামনে লালন ভাস্কর্য ধ্বংস করে দেওয়া হয়। স্থান কাল পাত্র ভেদে চেহারায় ভিন্নতা থাকলেও মননে এরা এক।
মুসলিম অধ্যুষিত শিক্ষিত সমাজ নিজেদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, স্বকীয়তায় কিছুটা সচেতন থাকলেও বর্তমানে সেটিও ভেঙে পরার উপক্রম হয়েছে। আরবের সংস্কৃতির নামে আপাদমস্তক এক ধরণের অ-সংস্কৃতি চালু হচ্ছে। সেখানে তারা বলতে চাচ্ছে মুসলিমদের আসলে কোন সংস্কৃতি নেই। দুই ইদের বাহিরে তাদের কোন কিছুই নেই। প্রাগ-ইসলামিক যুগে আরবে সংস্কৃতির কিছু ছোঁয়া থাকলেও পরবর্তীতে তা নিষিদ্ধ হয়। সেই নিষিদ্ধ’কেই অন্ধ অনুসারীরা অনুসরণ করে যাচ্ছে। ফলে নির্বোধ ধার্মিকরা তাদের হাজার বছরের স্থানীয় সংস্কৃতিগুলো ধ্বংস করতে পিছ পা হচ্ছে না। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে; আরব সমাজে ইসলামের আগমনের পরও কেউ কোন নাম পরিবর্তন করে নি। বরং আরবের সেই কোরাইশদের সংস্কৃতিতেই নাম ধারণ করেছে। অথচ ইমানি জোশে বলিয়ান ধার্মিকরা নিজের শিকড় ভুলে গিয়ে অন্ধের মতন আরবের নামগুলো ধারণ করছে। হুর লোভী এসব দ্বিপদ মানুষগুলোর হয়তো জানা নেই আরবের খ্রিস্টান, ইহুদিরাও আরবি নামের নাম ব্যবহার করে। আরবি কোন ইসলামিক ভাষা নয়। বরং আরবের ভাষাতেই ইসলামের আগমন ঘটেছে।
ভারত উপমহাদেশ ভেঙে যখন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হল তখন সেখানে ২৭% মতন অমুসলিম জনগোষ্ঠী ছিল। কথা আসে তারা ভারত ভাগের সময় কেন দেশ ত্যাগ করে নি। বাংলা ভাষার পক্ষে পাকিস্তান সংসদে প্রথম যিনি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু ভারতে স্থায়ী ভাবে বসবাসের আমন্ত্রণ করেন তখন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাভাবিকভাবেই সবাই ধীরেন্দ্র দত্তের মতন নিজের দেশ পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু স্বভাব সুফল চরিত্র বর্তমান পাকিস্তানে ৩% এবং বাংলাদেশে বর্তমানে ৮% ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ভবিষ্যতে তা অন্য মুসলিম দেশগুলোর মতন শূন্যতে এসে ঠেকবে। অতীতের জাহেলিয়া নিয়ে মতভেদ তর্ক-বিতর্ক থাকলেও এই বিষয়ে সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রকে জাহেলিয়া যুগ বানানোর জন্যে মুসলমানদের অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও ধর্মান্ধতা দায়ী। যেখানে তারা সংখ্যাগুরু সেখানে তারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের সহবস্থান বিশ্বাস করে না ফলে প্রতিনিয়ত চলছে উচ্ছেদ ও জমি দখলের মতন ঘটনা। অন্যদিকে ইউরোপের মতন জায়গায় তারা সংখ্যায় কম হলেও ক্রাইমে জড়িতদের মধ্যে এদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। যেমন-সুইডেনে ৭৭% রেপ করে সংখ্যালঘু মুসলিমরা। অনেকেই হয়তো বলার চেষ্টা করবে এর পেছনে মূল কারণ অর্থনৈতিক। তাদের অবগতির জন্যে জানানো যাচ্ছে যে ইউরোপের দেশগুলো’তে রাষ্ট্র যদি কাউকে জব দিতে না পারে তাহলে বেকার ভাতা। এবং আশ্রয় পাওয়া শরণার্থীরা কেউ না খেয়ে থাকছে না। মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের খাওয়া, পরা, থাকা, শিক্ষা ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিচ্ছে সরকার। এর পরও তারা ক্রাইমে জড়িত হচ্ছে, ধর্ষণের মতন জঘন্য কাজে জড়িত হচ্ছে। জার্মানিতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ৮০০ বেশি নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ জমা হয়েছে। আর এটি আর কেউ নয় আরব থেকে আসা মুসলিমরাই করেছে। এসব ধর্ষকের পক্ষে ফতোয়াবাজও জুটে গেছে। যেমন জার্মানির এক মসজিদের ইমান বলেছে; যৌন হয়রানির জন্যে নারীদের কাপড় ও সুগন্ধি দায়ী। সুতরাং বিষয়টি পরিষ্কার যে; আরবের ধর্ষকদের আসলে কোন দোষ নেই। এটি যে শুধু জার্মানির ইমাম বলেছে বিষয়টা আসলে তা নয়। বরং প্রতিটি মুসলিম সমাজের ইমাম ও বেশির ভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের এমনটি ধারণা। এসব অসভ্য আচার-আচরণের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ফলে মুসলিম কমিউনিটির প্রতি এক ধরণে বিদ্বেষ কিংবা ঘৃণার জন্ম নিচ্ছে। পৃথিবীতে শ্রমিক হিসেবে ভারত, শ্রীলংকা’র শ্রমিক বেশ নাম করা। সেই সাথে আমরাও পাল্লা দিয়ে শ্রম শক্তি রপ্তানি করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে; ইদানীং বিদেশে কর্মরত আমাদের শ্রমিকও জিহাদে জড়িত হচ্ছে কেউ বা উন্নত দেশ ছেড়ে সিরিয়ায় আইএসআইএস এর পক্ষে যুদ্ধ করতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশ ত্যাগ করছে। এসব জিহাদি সংবাদ কিংবা উগ্র মানসিকতার কথা উঠলে এক দল বলার চেষ্টা করে যে; আমেরিকার ইরাক, আফগানিস্তান হামলা, হিটলারের ইহুদি নিধনর কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি আমরা করলাম নাকি? বিষয় হল; এসব ঘটনা উল্লেখ করে নিজের সামাজিক অধঃপতন জাস্টিফাই হয় না। বাংলাদেশের উপর গণহত্যা, কুর্দিদের উপর গণহত্যা, আর্মেনিয়া গণহত্যার কারা করেছে সেটিও ভাবনায় আনতে হবে। একটি অন্যায় দিয়ে আরেকটি অন্যায়ের বৈধতা আরোপ করা আরেকটি অন্যায়। সমস্যা সমাধান না করে বরং ইমানি চোখে বিষয়টা না দেখার ভান করে সমাজকে আসল জাহেলিয়া যুগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নির্বোধ ধার্মিকদের যে সামাজিকতার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। শাহবাগের মোড়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল হাসপাতালের ভেতর একটি মসজিদ আছে। হাসপাতালের আশে-পাশে উপাসনালয় থাকা দোষের কিছু নয়। কারণ প্রিয় জনের অসুস্থতায় অনেকের মানসিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষ এগুলোতে ভিড় জমায়। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে হাসপাতালের মসজিদে অতিরিক্ত মাইকের শব্দ। উন্নত বিশ্বে রাস্তায় হর্ন দেওয়া হয় তখন; অকস্মাৎ রাস্তায় কোন পশু কিংবা ভুল বশত কোন গাড়ি আইন ভঙ্গ করলে। সময় মতন যাত্রীরা বাসের জন্যে অপেক্ষা করে এবং বাস সময় মতন হাজির হয় ফলে আমাদের মতন বাস থামিয়ে যাত্রী সংগ্রহের জন্যে হর্ন দিতে হয় না। তেমনি হাসপাতালে উপাসনায়ে জন্যে মাইকের কোন ব্যবহার যে দরকার নেই বরং ঘড়ি ধরে যাওয়া সম্ভব তা হুরলোভী ধর্মপ্রাণদের কী করে বোঝেন। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের জরুরী বিভাগে গিয়ে নিজে শব্দের অত্যাচার দেখে আসতে পারেন। এই যে সমস্যার কথা বললাম; এর সমাধান বলা খুব সহজ হলেও ধর্মান্ধ সমাজে তা করা সম্ভব নয়। কারণ সমাধানের কথা বললে এক দল চাপাতি হাতে তেড়ে আসবে। অথচ মাইকে আজান দেওয়ার ইতিহাসটি বেশ মজার। মাইক যখন আবিষ্কার হয় তখন মাইকে আযান দেওয়া যাবে কিনা তা তর্ক বিতর্ক লাগে অনেকে বলতে থাকেন এটি শয়তানের আবিষ্কার। এখনো কিছুটা বিতর্ক দেখা যায়! যেমন কিছুদিন আগে সিলেটে একজন ফতোয়া দিলেন। মাইকে আযান দেওয়া হারাম, যারা মাইকে আযান দিয়ে নামাজ পড়েন তারা কাফির। তাদের জানাজার নামাজ পড়া হারাম। মুসলমান এলাকায় দাফন করা হারাম। সিলেটের বিশ্বনাথে এক বার্ষিক রিজভীয়া ওরস ও সুন্নী মহাসম্মেলনে- আকবর আলী রিজবী এ কথাগুলো বলেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি আজানের বিরুদ্ধে নই কারণ বিষয়গুলো সমাজের উপর নির্ভর করে। ইউরোপের মসজিদে মাইক ছাড়াও মানুষ ঠিকই সময় মতন নামাজে যাচ্চে। তাই দেশের মসজিদগুলোয় শব্দ মাত্রা কতোটুকু হবে এর জন্যে সাধারণ কিছু নিয়ম নীতির দরকার অবশ্যই আছে। সেটি শুধু আজান নয় যে কোন মাইক ব্যবহারে। কিন্তু এই অনুভূতির দেশে যে কোন কিছু নিয়ে কথা বলা মুশকিল। ওয়াজ কিংবা যে কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যেভাবে মাইক ব্যবহার করা হয় তাতে সহ্য ক্ষমতা ভেঙে পড়ার দশা হয়। যেখানে মানুষের মৌলিক পাঁচটি অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠা হয় নি সেখানে পবিত্র শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে মানুষ সচেতন হবে সেটি প্রত্যাশা করা বোকামি। সমস্যা থাকবে সমাধান থাকবে কিন্তু সেটি সবচেয়ে জরুরী তা হল সমাধানের দিকে যেতে চাই কিনা। নিজেদের কমিউনিটি, ব্যক্তি দর্শন উন্নতি করতে চাই কিনা। উপরের কথাগুলো এই জন্যে বললাম যে, সামাজিক অসুস্থতা কীভাবে সবার সামনে টিকে তাকে তা বোঝানোর জন্যে। মেয়েদের রাস্তায় বের হতে দিতে চাচ্ছি না, লেখককে লিখতে দিতে চাচ্ছি না, ভিন্ন সম্প্রদায়কে দেশে থাকতে দিচ্ছি না। যে জাহেলিয়া যুগের কথা বলে নিজেদের গৌরব ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বর্তমান সামাজিক মূল্যবোধ, কাণ্ডজ্ঞান বিচারে এমনকি রাষ্ট্রীয় চরিত্রে আমরা কী সেই তথাকথিত অতীতের জাহেলিয়া যুগকে ছাড়িয়ে যাই নি?