ভারতে বাবরি মসজিদে ভাঙার পর জামাত-পন্থী পত্রিকা পরিকল্পনা-মাফিক ‘দৈনিক ইনকিলাব’ একটি সংবাদ প্রকাশ করে;- “বাবরি মসজিদ ভাঙায় ঢাকার হিন্দুদের মিষ্টি বিতরণ!” পরের দিন তাদের এই ভুল সংবাদের জন্যে পত্রিকা ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু যা হওয়ার তা আগের রাতেই হয়ে যায়। ঢাকার হিন্দু পল্লীগুলো আগুনে জ্বলে উঠে। বেশির ভাগ সময় পত্রিকা এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিতে মূল ভূমিকা পালন করে। মানুষকে উস্কে দেওয়ার প্রথম কাজ পত্রিকা কিংবা মিডিয়াও করে থাকে। “আমাদের দেশ” পত্রিকা রাজাকার সাঈদীর পক্ষ নিয়ে কাবা শরীফের একটা ছবি ব্যবহার করে এমন মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে। তারা সংবাদ প্রকাশ করে যে, কাবা শরীফের সামনে মাওলানারা রাজাকার সাঈদীর পক্ষে মানব-বন্ধন করেছে।
বাংলাদেশে এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পত্রিকাগুলো সবসময় জড়িত থাকলেও এদের বিরুদ্ধে কখনো কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ‘আমাদের দেশ’ পত্রিকা ছাড়া আর কোন পত্রিকার বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি বাবরি মসজিদ ঘটনায় ইনকিলাব পত্রিকার ভূমিকার জন্যে তাদের কোন শাস্তি হয়নি।
আজকে সকাল বেলা “মানবজমিন” পত্রিকার একটি সংবাদ চোখে পড়ল। তারা শিরোনাম করেছে-“”বাংলাদেশে গরু জবাই বন্ধের দাবি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের“। আর সাধারণ পাবলিক এমন নিউজ পেয়ে গালাগালিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল! অথচ ইত্তেফাকের মতন পত্রিকা একই নিউজ করল যেখানে এমন কোন কথার উপস্থিতি নেই। তাদের শিরোনাম ছিল-‘সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে’ স্বাভাবিক জ্ঞানে বলে এমন কোন বক্তব্য আসার কোন সুযোগ নেই। হিন্দু-বৌদ্ধ-ঐক্য কমিটি নিয়ে সমালোচনা কিংবা আলাপ সেটি ভিন্ন ইস্যু কিন্তু ফেসবুকে জামাতিদের এজেন্টরা এই পত্রিকার রেফারেন্স নিয়ে স্ট্যাটাস-বাজিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সংখ্যাগুরুদের তালি ও ফলোয়ার শিকারে মিশনে যোগ দিয়েছে ফেসবুকের পিনাকীও। এই পিনাকী ফেসবুকে বিভিন্ন সময় মনগড়া তথ্য, গুজব ও দুইদিন পরপর পল্টিবাজি করার ইতিহাস আমরা সবাই জানি। সাংবাদিক পুলক ঘটক এই বিষয়ে একটি ব্লগ পোস্টও করেন-পিনাকীবাদ নামে।
কথা হল, জামাতি পত্রিকার নিউজ বাছবিচার না করে তারা স্ট্যাটাসবাজিতে লেগে গেল? এর কারণ আর কিছু না কিছুদিন আগে যেহেতু পঞ্চগড়ে একজন হিন্দু পণ্ডিতকে জবাই করা হল এবং এই নিয়ে খুব সমালোচনা হচ্ছে সেহেতু পিনাকী গ্যাং মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে নিতেই জোটবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছে। অনেকেই হয়তো ভাববেন নামতো পিনাকী আবার সে জামাতি হয় কেমনে তাদের জন্যে Razik Hasan এর স্ট্যাটাসখানি তুলে দিচ্ছি
বগুড়াতে জন্মানোর সুবাদে পিনাকীকে চিনতাম সেই ছোট বেলা থেকেই, ওনার পিতা শ্রদ্ধেয় শ্যামল ভট্টাচার্য আমার শিক্ষক ছিলেন। মফস্বলের একজন স্কুল শিক্ষকের কতো টাকা আয় সেটা কম-বেশি সবারই ভালো জানা আছে। পিনাকী মেডিকেলের স্টুডেন্ট ছিলেন, এমবিবিএস পাশ করার পর তিনি তার বাবার প্রিয় ছাত্র ডাক্তার মুস্তাফিজুর রহমানের (আমার নানা, মায়ের দূর-সম্পের্কর আত্মীয়) প্রতিষ্ঠান পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালে জয়েন করেন।
পপুলারে যাওয়ার আগে পিনাকী চাকুরী করেছে এভেন্টিস ফ্রেঞ্চ মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর অনকোলজি বিজনেস ইউনিটে । ওখানে চাকুরী করার সময় সে বিপনণের নামে কি করেছে তা জানা ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিং বিশেষতঃ ক্যান্সার প্রোডাক্ট বাজারজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট কম বেশী সকলেই । এভেন্টিসের পর সে চাকুরী করেছে “সার্ভিয়ার” নামের আরেকটা ফ্রেঞ্চ মাল্টিন্যাশানাল এ। তারপর সে গিয়েছে পপুলারে ।
তার বাবার ছাত্র ছিলেন ডাক্তার মুস্তাফিজুর রহমান, আর সেই সুবাদে ডাক্তার মুস্তাফিজুর রহমান গুরু দক্ষিণা দিয়েছিলেন, তাকে পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালে সিইও হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। পিনাকীকে যে গুরুদায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন পিনাকী সেই দায়িত্বের অপব্যবহার করেছেন, পিনাকীকে বিশ্বাস করেছিলো ডাক্তার মুস্তাফিজুর রহমান, পিনাকী সেই বিশ্বাস রাখেনি।
২০০৯-২০১০ সালের দিকে পপুলারের কালা জ্বরের ড্রাগ নিয়ে যে ঝামেলা হয়েছিলো, যেই ড্রাগ পপুলার সরবরাহ করতো হেলথ মিনিস্ট্রিতে, সেইবারের সেই ঝামেলাতে পপুলারের ক্ষতি হয়েছিলো কয়েক কোটি টাকার উপরে, পিনাকী কিন্তু সেই ঝামেলার মূলে ছিলেন সেটা কিন্তু কমবেশি সবাই জানে, সেখান থেকে যে পিনাকী বড় ধরনের দাও মেরেছিলেন সেটাও হেলথ খাতের অনেকেই জানে। দূর্জনেরা বলে, এভাবেই পিনাকী আস্ত একটা ফার্মাসিউটিক্যালের মালিক হলেন।
এবার আশি অন্য প্রসঙ্গে, পিনাকী কেন প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে লিখছেন এবং কেন এখনও চলছে তার অনলাইন প্রোপাগান্ডা। একটা উদাহরন দেওয়া যাক,
“পহেলা বৈশাখকে স্যেকুলার রাখতে হবে। বিশেষ করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যে কোন ধরণের ধর্মীয় প্রতীক উপস্থাপন সচেতনভাবে বাদ দিতে হবে। ধর্মকে অ্যাপ্রিশিয়েট করাতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু যেই উৎসবে সব ধর্মের মানুষ অংশ নেয় সেই উৎসবে কোন বিশেষ ধর্মের প্রতীক কোন আরেকটি ধর্মের অনুসারীদের মনে যদি দ্বিধার জন্ম দেয় তবে সেটা আর স্যেকুলার থাকেনা। মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকরা এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন তত মঙ্গল।”
ম্ম্ম্। দেখা যাচ্ছে পিনাকীর মতে, থিওরেটিক্যালি, যা ইসলাম-সম্মত নয়, তা ধর্ম-নিরপেক্ষ নয়। মনে হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হলে আগে তাকে ইসলাম-সম্মত হতে হবে। অর্থাৎ, এরপর ইসলাম ইজ ইকুয়াল্টু ধর্ম-নিরপেক্ষতা সমীকরণটি প্রতিষ্ঠিত হল।গত পরশুর ঘটনায় পিনাকীর পোস্ট ছিল; “ওস্তাদ আলাউদ্দিনের স্মৃতিচিহ্ন বিজড়িত সঙ্গীত ভবন আক্রান্ত হওয়াকে যদি বর্বরতা বলেন তাহলে স্বীকার করুন, নকশাল আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য ভেঙে আপনার কমরেডরাও বর্বরতা করেছে। রুশ বিপ্লবের সময় বলশেভিকরা অসংখ্য ঐতিহাসিক আর্টিফেক্ট ধ্বংস করেছিল, সেটা জানেন?” “বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মাদরাসার ছাত্রদের হৃদয়ের আওয়াজ ধ্বনিত হয়েছে”তাও মন্তব্যে দেখলাম।
গল্পকার কুলদা রায় পিনাকী সম্পর্কে একটা লেখায় লিখেছিলেন, “পিনাকী কেন মৌলবাদীদের হয়ে কাজ করছে? এর সোজা একটা জবাব আছে। সেটা হল ১৫০০ কোটি টাকা। পিনাকী ১৫০০ কোটি টাকার প্রকল্পের একজন। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়তে ইসলামী বছরে ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করছে তাদের জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ড প্রচারে। এই টাকা দিয়ে তারা প্রগতিশীলদের মধ্যে থেকে লোক কিনছে। মার্কসবাদী নামের লোক কিনছে। সুশীল নামে লোক কিনছে। ড: আবুল বারাকাত এ বিষয়ে একটি গবেষণাপুস্তক বের করেছেন। সেখানেই বিস্তারিত লেখা আছে। তাহলে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়–‘লক্ষ্মী পেঁচা! মুসলমানরা কেন মেনে নেবে? ” পিনাকীর এই বাক্য স্রেফ একটা ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক উস্কানী। উস্কানীটি দেওয়া হচ্ছে মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে। উস্কানী দেওয়া হচ্ছে টাকার প্রভাবে। টাকার অন্য নাম টঙ্কার। ফলে পিনাকেতে লাগে টঙ্কার! ফলে যখন মার্কস-লেনিনের কোট ব্যবহার করে, ফুকো-দেরিদার দোহাই দিয়ে, শিবঠাকুরের নাম পিনাকী ধারণ করে লিখলেই তা মধুর হবে ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনো গোপন হাত কেউটো সাপের মত ভয়ঙ্কর বিষ ঢেলে দিচ্ছে কিনা—সেটা খুঁজে দেখা দরকার।”
পিনাকীকে চিন্তাম পিঙ্কু দা’ হিসাবে, প্রিয় পিঙ্কু দা’ আমাদের এক সময়ের নায়ক। আজ তিনি আর নায়ক হিসাবে আমাদের হৃদয়ের মাঝে বেঁচে নেই, রক্তে মাংশে পিনাকী জীবিত থাকলেও, পিঙ্কুদার মৃত্যু হয়েছে, প্রিয় পিঙ্কুদা’ করেছেন নৈতিক আত্মহত্যা।
রেস্ট ইন পিস পিঙ্কু দা’ !!”
এর আগেও আমরা দেখেছি যে জামাত-শিবির রামপুরার কালী মন্দিরে কোরাব অবমাননার গুজব ছড়িয়ে হামলা করার চেষ্টা চালায়। চট্টগ্রামে হিন্দু পল্লীতে কোরানের পাতা ছড়িয়ে দিয়ে হামলার পরিকল্পনা করার সময় কোরানের ছেড়া পাতাসহ গ্রেফতার হয় দুইজন শিবির কর্মী। দেশে ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর হামলার পরিকল্পনা চলছে কয়েক মাস ধরে। ব্লগেও হিন্দু আইডির নাম ধারণ করে হিন্দুদের উপর হামলার উস্কানি দেওয়া হচ্ছে যেমনটি করে যাচ্ছে জামাত-শিবিরের পেইজ-নয়ন চ্যাটার্জি। আজকের নিউজটি কোনটি ব্যতিক্রম নয়। বরং এগুলোর সাথেই এক সুতোয় গাথা। এই নিউজের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ এর শুধু প্রতিবাদ করলেই হবে না। এই নিউজ যারা ছেপেছে এবং যারা ফেসবুকে উস্কানি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।কারণ এসব নিউজের কারণে দেশে ভিন্ন সম্প্রদায় যদি হামলা শিকার হয় তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এসব পিনাকীরা জামাতের সাথে হাত মিলিয়ে দেশে একটি সাম্প্রদায়িক হামলা করার প্রচেষ্টা করছে বহুদিন ধরেই। তাই এসব ব্যবসায়ী ও তাদের গ্যাংরা যাতে কোন বদমাইশি করতে না পারে তার জন্যে প্রতিটি সচেতন নাগরিককে সর্তক থাকতে হবে।

বর্ধিত অংশ
আব্দুর রাজ্জাকের মতন ওয়াজ মাহফিলের লোকরা সরাসরি বলে যে; মূর্তিকে লাত্থি দিয়ে ভাঙতে এসেছি। এগুলো যারা পূজা করে তারা কাফের। বর্তমান ভারতে সংখ্যালঘু (খ্রিস্টান, মুসলিমসহ অন্যরা) সম্প্রদায় কিছুটা চাপের মধ্যে আছে। এই সময় ভারতের কোন ইসলামিক সংগঠনের কেউ যদি এমন বক্তব্য দেয় যে; ভারতের মাটিতে মূর্তি পূজা বন্ধ করে দিতে হবে, লাত্থি দিয়ে মূর্তি সব ভেঙে দিতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা মানুষের কী করা উচিত?
প্রথমত এসব বক্তব্যের কারণে যেন কোন সুযোগসন্ধানীরা তাদের উপর অত্যাচার করতে না পারে সেজন্যে উস্কানিমূলক বক্তব্য না দিয়ে বরং এই বক্তব্যটি কতোটুকু সঠিক, কোন ব্যক্তির বক্তব্যকে কী কেউ সাংগঠনিক বক্তব্য হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে কিনা। কিংবা চালিয়ে দিলে এর উদ্দেশ্য কী ছিল। মানুষকে প্রকৃত ঘটনা জানার জন্যে ধৈর্য ধরার কথা একজন সাধারণ মানুষ বলবে। কারো বালখিল্য বক্তব্যের কারণে যেন কোন সম্প্রদায় ক্ষতির শিকার না হয় এটাই তো একজন মানুষ প্রত্যাশা করে। আর কোন সংগঠন যদি এমন বক্তব্য যদি দিয়েই দিত সেক্ষেত্রে সবার আগে উচিত ছিল এটি যে সুরো সম্প্রদায়ের বক্তব্য নয় বরং এসব সংগঠনের মন গড়া বক্তব্য তা মানুষকে বোঝান।
কিন্তু আমরা দেখেছি এসব বক্তব্যকে পুঁজি করে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে হামলা করার জন্যে উস্কে দেওয়া হচ্ছে। একজন মানুষের বক্তব্যকে সাংগঠনিক বক্তব্য হিসেবে চালিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে কোণঠাসা ও অনিরাপদ-ভাবে টিকে থাকা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বরং একটি পক্ষ মানুষকে উসকিয়ে দিচ্ছে। পত্রিকা-ওলারা খবর বেচার জন্যে কতো কিছু করে কিন্তু যখন দেখি কিছু বদমাইশ নিজের লাইক ও ফলোয়ার বাড়ানোর জন্যে এসব ভণ্ডামিতে লিপ্ত হয়। একদিকে ইতর পত্রিকার, অন্যদিকে কথা বলতে হচ্ছে এদের বিরুদ্ধে। এরা আসলে আর কেউ না স্বর্গ থেকে যাকে প্রথম বিতাড়িত করা হয়েছিল, এরা তারই বংশধর।