বিষয়টি স্পষ্ট যে, বাংলা ব্লগ কিংবা অনলাইনে ইসলাম কিংবা নবী মুহাম্মদ নিয়ে আলোচনা কিংবা সমালোচন মূলত দুই ভাবে-এক. অন্ধ ভক্ত দুই. অন্ধ হেইটার। এই দুই গ্রুপের লোকদের চিপায় পড়ে অনলাইনে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা কিংবা লেখালেখি করা বেশ মুশকিল। মানে বিভিন্ন ট্যাগ আপনার জুটে যেতে পারে। অবশ্য আক্কেল দরজার বাহিরে রেখে ফেসবুকে লেখা-লেখা করলে আইডির টিআরপি বাড়ে, ফাও জনপরিচিতিও জুটে যায়।
ইউরোপিয়ানদের চোখে ভারতের মানুষ ছিল আধা-ন্যাংটা অসভ্য মানুষ। তাই অসভ্যদের খ্রিস্ট-প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর ঊনবিংশ শতাব্দীর পাদ্রীরা বোম্বে, মাদ্রাজ কোলকাতা বন্দরে নেমেছেন, বিভিন্ন কৌশলে জিশুর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তাদের একদলের ধারণা ছিল তারা যদি বাঙলার মানুষদের বুঝাতে সক্ষম হয় ভগবান কৃষ্ণ আদতে ছিলেন ভীষণ নারী-লোলুপ লম্পট তবে তারা কৃষ্ণকে ভুলে খ্রিস্টপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যাবে। তারা হিন্দুদের শাস্ত্র ঘেঁটে শ্লোক সাজিয়ে পাতার পর পাতা বাইবেল আর গীতা মহাভারতের তুলনা করে প্রমাণ করে দিতো যে কৃষ্ণ কতোটা নীতিহীন লম্পট। তেমনি একই পদ্ধতি তারা আরোপ করেছিল পূর্ববঙ্গে। তারা পূর্ববঙ্গে এসে প্রচার করতে শুরু করল যে; নবী মুহাম্মদ ছিলেন নারীলোলুপ, নবী হওয়ার জন্যে তার যোগত্যা ও নীতিবোধ নেই। সেই তুলনায় জিশু খুব ভাল মানুষ যিনি রক্তপাত চান না শুধু মানুষের ভালবাসতে চান।
ইতিহাস হল খ্রিস্ট-পন্থীদের এক অংশের এমন প্রচার ও পদ্ধতি কোনটাই ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে উৎসাহিত করতে পারে নাই। বরং খ্রিস্টান নীতিবোধে উদ্ভুত হয়ে কলকাতায় ‘ব্রাহ্ম’ ধর্মের প্রসার হয়েছে। যারা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই খ্রিস্টান ফাদারদের ব্যক্তিত্ব, আনুগত্যের কারণে হয়েছেন। কৃষ্ণ লম্পট, মুহাম্মদ নারীলোলুপ এমন প্রচারে কেউ উৎসাহী হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নাই। অনলাইনে কিংবা ব্লগে যারা লেখালেখি করেন তাদের একটা অংশ দুই’শ বছর আগে ভারতীয় মুল্লুকে নামা খ্রিস্টপ্রচারকদের একাংশের মতনই আচরণ করছেন। আপনার লেখার স্বাধীনতা আছে তবে দোষত্রুটির কঠোর সমালোচনা করলে, কিংবা কোনোভাবে যদি কোন ধর্মপুরুষকে হীন প্রমাণ করতে পারলেই সেই ধর্মের প্রতি অনুরক্ত মানুষের সংখ্যা কমে যাবে কিংবা সবাই অবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এমন ধারনা যাদের মধ্যে আছে তারা সম্ভবত ভুল ধারণা নিয়ে বসবাস করছেন।
এবার আসি যৌনতা বিষয়ে আক্কেল প্রসঙ্গে:
যৌনতার প্রতি আমাদের কৌতূহল একটু বেশি মাত্রায়। রক্ষণশীল পরিবেশে থাকার দরুন হয়তো আমাদের এই অবস্থা। তাই যতোই শিক্ষিত হই না কেন আমাদের প্রশ্ন ঐ যৌনতামুখী হয়ে যায়। তাই তো নব্য বিবাহিতা নাতনীকে দেখে নানী জিজ্ঞেস করে জামাই কেমন আদর করে কিংবা বন্ধু গার্লফেন্ডের সাথে কতো দূর এগোল তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। একই ক্ষেত্রে ধর্মীয় নবি কিংবা ধর্মপ্রচারকদের বেলায়ও দেখি। অনেক সময় নবীদের কর্ম কিংবা রাজনীতি থেকে তাদের যৌনতা আমাদের কাছে মূল বিষয় হিসেবে দাঁড়ায়।
হুমায়ূন আহমদের বেলায়ও আমরা তা দেখি। হুমায়ুন আহমেদ এর কথা শুনলে অনেকে প্রথমেই বলে; ওহ ঐ লোকটা যে তার মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেছে। হুমায়ূন আহমেদের রচনা কিংবা সাহিত্যে আমাদের কৌতূহল জন্মায়নি। কৌতূহল জন্মাল তার ব্যক্তিগত যৌনতার দিকে। একই জিনিস রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে আমাদের ভাবনা আসে না। ভাবনা আসে যুবক বয়সে অবিবাহিত রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীকে আসলে কতো দূর নিয়ে যেতে পেরেছিলেন! সেই যৌনতার আগ্রহ থেকেই নবী মুহাম্মদ ও আয়েশার যৌনতার বিষয়ে বেশির ভাগ সময় বে-আক্কেল কথাবার্তা পাওয়া যায়। একপক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে আয়েশার বয়স ৬ নয় বরং ১৬ মতন ছিল আরেক পক্ষ বলে ঐ দেশ লোকটা তো শিশুকামী! এই দুই অংশের চিন্তায় গলদ আছে, এক অংশের চিন্তায় অসহায়ত্ব আরেক অংশের চিন্তায় যৌনতার অভিযোগ আরোপের এক ধরণের আনন্দ। অনেকেই হয়তো ভাবছেন হঠাৎ এই ইস্যুতে লেখালেখি কেন। এর মূল কারণ ফেসবুক ব্লগে হরহামেশায় এমন কিছু চিন্তাহীন লেখালেখি পাওয়া যায়। শুধু যে তরুণ ছেলেরা করে তা নয় অনেক বয়স্ক লোকজনও একই আচরণ করে। ইসলাম, নবী’র সমালোচনা করতে কোন বাঁধা নেই কিন্তু সেই সমালোচনা যদি চিন্তাহীন ভুল বিশ্লেষণ কিংবা ব্যক্তিগত ঘৃণার প্রচার হয় তাহলে এসব নিয়ে লিখতেই হয়। যেমন-অনেকেই বলতে দেখেছি সনাতনীদের দেবতা কৃষ্ণের ১৬ হাজার ১০ জন স্ত্রী ছিলেন। কৃষ্ণকে পছন্দ অপছন্দের বিষয় নয়, কিন্তু এই তথ্যটি পুরোটাই ভুল ও অপপ্রচার। ৭১-এর স্বাধীনতার পরে শেখ মুজিব যেমন বলেছিলেন-‘ধর্ষিতা মেয়েদের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও’ তেমনি বলা হয়- কৃষ্ণ যখন কংসকে পরাজিত করল তখন কংসের হারেমের সকল মেয়েদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার জন্যে কৃষ্ণ নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বাভাবিক জ্ঞানে বলা যায় কারো এতো স্ত্রী থাকা সম্ভব নয়। হারেমখানায় এতোগুলো রমণী হয়তো কেউ পুষতে পারেন, তারা কেউ স্ত্রী হয় না, স্ত্রী’র মর্যাদা পান না। নবী মুহাম্মদ ও আয়েশার বিয়ের প্রসঙ্গের আগে দেখে নিই গত এক-দুই’শ বছর আগে এই ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের বিয়ে হতো কতো বছর বয়সে।
১৮১১ সালে রবীন্দ্রনাথের দাদু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিয়ে করেন ৯ বছর বয়সী দিগম্বরী দেবীকে। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সারদা দেবী কে বিয়ে করেন ৯ কিংবা ১০ বছর বয়সে। সারদা দেবী’র প্রথম সন্তান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয় ১৮৪০ সালে যখন সারদা দেবীর বয়স এগার বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেন ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। তার জন্ম ১৮৭৪ সালের মার্চে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যখন বিয়ে করেন তখন মৃণালিনী’র বয়স পূর্ণ ১০ বছর হয়নি। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালে। মুজিবের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসার জন্ম ১৯৩০ সালে। শেখ মুজিব বিয়ে করেন ১৮ বছর বয়সে। সুতরাং হিসেব অনুযায়ী ফজিলাতুন্নেসার বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। অতীতে মেয়েদের বিয়ে খুব দ্রুত তো হতোই আবার গৌরি দান প্রথাও আমাদের সমাজে ছিল। এক্ষেত্রে মুহাম্মদের সাথে অন্যদের তফাৎ হল মুহাম্মদের বয়স ছিল ৫৪ অন্যদের ছিল ১৭ কিংবা ১৮ এমন।
আয়েশা ছিলেন আবু বকরের কন্যা। আবু বকর গবীর, অসহায় লোক ছিলেন না ছিলেন ধনী গোত্রপতি। ফলে ইসলামের প্রথম দিকে সম্পদহীন ইসলামগ্রহণকারী কিছু সাধারণ মানুষ কিছুটা সামাজিক হ্যারাসের শিকার হলেও আবু বকরের মতন ধনী লোকজন মক্কা-মদিনার রাস্তায় স্বাধীন ও নিরাপদভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আয়েশা ও নবী মুহাম্মদের বিয়েটিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিয়েও বলা যায়। কারণ আবু বকর যেহেতু মুহাম্মদের প্রথম দিকের ধনী সাহাবী ছিলেন সুতরাং বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্কটা আরো অটুট করলেন। হ্যাঁ, এটাও সত্য আয়েশা সুন্দরী ছিলেন। সুতরাং নবী মুহাম্মদ ৫৪ বছর বয়সে বিয়ে করলেও সেটি কারো গলায় ছুরি ধরে বিয়ে নয় বরং সামাজিকভাবে এবং আয়েশার পিতা-মাতার সম্মতিতে। আবু বকর প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে রাজি হোন। সুতরাং যারা এই বিয়ে কিংবা সম্পর্কে ধর্ষণের সাথে তুলনা করেন কিংবা নবী মুহাম্মদকে শিশুকামী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চান তাদের নৈতিকতা বিচার মানদণ্ডে নিজেদের দাদা-নানাও শিশুকামী পর্যায়ে নিশ্চিতভাবে পড়ে যাবে।
ওলামা লীগ যেমন কিছুদিন আগে বলল; নারীদের বিবাহের বয়স নীতি বাতিল করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ-তারা নবী মুহাম্মদ ও বঙ্গবন্ধুর বিয়ের বয়স হাজির করলেন। এসব নির্বোধ ও ইতর প্রজাতির লোকজন হরহামেশায় এই কাজ করে। বর্তমান আরবেও কিছু লোক এই বয়সী শিশুদের বিয়ে করে সুন্নত পালন করে। নিজেদের কুৎসিত বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে এমন উদাহরণ হাজির করে। হুজুররা ১৫ বছর আগের নিয়ম এই সময়ে চালাতে চায় আরেক পক্ষে বর্তমান সময়ের মূল্যবোধ দিয়ে অতীতে বিচার করতে চায়। এদের জানা নেই; ৪০ বছর আগেও পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্র নায়ক কিংবা নেতারা জনসম্মুখে সিগারেট খেতেন। যেমন-আমাদের বঙ্গবন্ধু কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লবী চে। কিন্তু সময়ের সাথে সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তন হয়েছে। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টও মিডিয়া কিংবা জনসম্মুখে সিগারেট খাওয়ার অধিকার রাখেন না। তাই সব কিছু বিচার করতে গেলে স্থান-কালে মূল্যবোধ-চেতনাকে বিবেচনায় এনে বক্তব্য দেওয়া কিংবা কুৎসা রটানো আর যাই হোক মুক্তচিন্তার চর্চা নয় বরং নিজেদের ঘৃণা-বিদ্বেষ বমি করার নামান্তর।