স্যাম হ্যারিসের “বিশ্বাসের সমাপ্তি” বইটি শুরু করেছেন এক নাটকীয় দৃশ্যের মাধ্যমে, যেখানে এক তরুণ বাসে করে যাচ্ছে। বাস যখন মানুষের ভর্তি হয়ে গেল তখন তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। এবং আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাল। এই ঘটনা বর্ণনা করে স্যাম হ্যারিস পাঠকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন- এই তরুণের ধর্ম কি? ৯/১১ কিংবা লন্ডনের ৭/৭ এর পর এর উত্তরটা খুব সহজ। থিওডের সাঈদ বলছেন- “এই প্রশ্নটি যদি ২০০১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর করা হতো? তাহলে সবচাইতে সম্ভাব্য উত্তর হতো ‘হিন্দু তামিল টাইগার’, যারা প্রায় চারশো আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। এই প্রশ্ন যদি ১৯৪৫ সালে করা হতো, তাহলে উত্তর হতো – বৌদ্ধধর্মীয় কামিকাজি, অথবা ইস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান লুফটওয়াফের সুইসাইড স্কোয়াড।” তবে এখানেও কথা আছে! সেটি হল; সাধারণ মানুষের কাছে এরা মোটা দাগে পরিচিত ছিল নাহ।
আফগানিস্তানে রাশিয়ার দখলদারিত্ব হঠানোর জন্যে আমেরিকা ও সৌদি আরবের হুকুমে পাকিস্তানের সহায়তায় ওহাবী মতবাদে বিশ্বাসী তালেবানের উত্থান ঘটে। বিন লাদেনের একটা উক্তি ছিল যে-আজ যারা আমার বন্ধু তাদের কাছেও আমি একদিন শত্রু হয়ে যাব। ১৯৮৮ সালে নির্মিত হলিউডের ছবি Rambo 3 তে সিলভেস্টার স্ট্যালোন জিহাদি তালেবানদের সাথে নিয়েই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস ইস্যুকে পুঁজি করে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজের ক্ষমতা আরো বেশি মজবুত করেন। এবং বইটিকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের মুসলিম সমাজ প্রথম অনুভূতির ইস্যুতে রাস্তায় নেমে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে। ব্যবসায়ীরা ভয়ে দোকান থেকে বইটি সরিয়ে ফেলে। এর পর থেকে বিভিন্ন ইসলামিক চ্যারেটি ও সংস্থার জন্ম হতে থাকে। বর্তমান জঙ্গি কার্যক্রমে এরাও যে মোটা দাগে জড়িত তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সাথে বসনিয়ার মুসলিমদের বিভিন্ন ঘটনাকে পুঁজি করে ব্রিটেনে হিজবুত তাহরীর কার্যক্রম শুরু হয়। আন্তর্জাতিক এই জঙ্গি সংস্থার জন্মলগ্নে বাংলাদেশী জিহাদিরা যুক্ত ছিল। বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে মুসলিম ছেলেদের দলে ভেড়ানোর সাথে সাথে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনা বাহিনীতে হিজবুত কর্মীর সমর্থক যোগার হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে হিজবুত কর্মী কিংবা সমর্থক আছে এমন একটা কথা বলে। বাস্তবতা হলো এটি কোন গুজব কিংবা অপপ্রচার নয় বরং বাস্তবতা। বিস্তারিত জানতে পড়ুন-Radical: My journey out of Islamist Extremism by Maajid Nawaz
জার্মানির ইস্টার্ন ফ্রন্টে কিংবা তামিল টাইগারদের বোমা হামলা যতো বেশিই হোক না কেন এই নিয়ে খুব বেশি আতংকে থাকতে হয়নি পশ্চিমা কিংবা ইউরোপের নাগরিকদের। বারে কিংবা পাবে এসে কেউ বোমা হামলা করে দেবে এমন কোন ভয় অন্তত সমাজে ছিল না। আর সাধারণ জনগণ সবাই এদের চিনত তাও বলা যাবে না। কারণ এরা পৃথিবীব্যাপী বোমা হামলা করতো না। গত চার বছরে ধর্মান্তরিত নব্য মুসলিমদের সবাই সালাফি কিংবা ওহাবী আদর্শে বলিয়ান হয়ে ধর্মান্তরিত হওয়ার মাস খানেকের মাথায় অনেকে জিহাদে নেমে পড়েছেন। বেশি দূর যেতে হবে না-লন্ডনে আমাদের সিদ্ধার্থ ধরের কথাই বলা যায়। এখন তো সে সিরিয়ায় গলার কাটার উপর পিএইচডি করছে। এছাড়া কানাডার এক ধর্মান্তরিত মুসলিম ইসলাম গ্রহণ করার ৬ দিনের মাথায় কাফের নিধনের জন্যে বন্দুক হাতে রাস্তায় নেমে পড়ে।
১৯৩০-এর শুরুতে হিটলার যখন জার্মানির ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন মিশরের ব্রাদারহুড সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও ইসলিমক আন্দোলনের চিন্তাবিদ হাসান আল বান্নার সাথে নাৎসিদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি হিটলারের পক্ষে সমগ্র আরব উপদ্বীপে নাৎসি জার্মানির গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তিনি হিটলারের মাইন ক্যাম্ফ অনুবাদ করে আমার জিহাদ নামে সমগ্র মিশরে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। গত এক’শ বছরে ইসলামের উগ্রবাদের ধারণা যেভাবে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে তাতে ২০০ কোটি মুসলিমদের ২% যদি ISIS-তালেবান টাই জিহাদের সমর্থক হয় তাহলে তার সংখ্যা ৪ কোটি!
১/১১ এ বাংলাদেশের মানুষের কাছে লাদেন হয়ে গেল ইসলামিক হিরো। ঢাকায় রাস্তায় মিছিল হয়েছিল; বাঙলা হবে আফগান আমরা হবো তাহলেবান। ঈদে বাজারে এসেছিল “লাদেন বোমা”। মানুষের বাসায় শোভা পাচ্ছিল তালেদের ছবি। যারা ঐ দিন লাদেনের ছবি কিনে বাসায় নিয়ে এসেছিল তাদের কাছে আজ লাদে হয়ে গেল আমেরিকার সৃষ্টি। প্রতিটি জঙ্গিগোষ্ঠী’র উত্থানের পেছনে সামাজিক কারণ থাকে তেমনি এসব সংগঠন শক্তিশালী হওয়ার পেছনে থাকে রাজনৈতিক মদদ। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, আদর্শের কিংবা মতবাদে বলিয়ান হয়েই যে ছেলে কখনো কচু গাছ কাটেনি সে কীভাবে আজ মানুষের মাথা কাটছে। তাই এসব জঙ্গি গোষ্ঠীকে আমেরিকা-ইসরাইলের এজেন্ট কিংবা সাম্প্রাজ্যবাদী শক্তির সৃষ্টি বলে প্রচার করেও মুসলিম তরুণদের জঙ্গিবাদ থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয়নি। হ্যাঁ, এটি সত্য কিন্তু রাজনৈতিক নীরব সমর্থন অনেক দেশেরই থাকে কিংবা রাষ্ট্রীয় পলেসি ব্যর্থ হওয়ায় এমন জঙ্গিগোষ্ঠীর সৃষ্টি কিন্তু এটি ভুলে গেলে চলবে না; প্রতিটি জঙ্গিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শ আছে। যেমন-তালেবান হল সুন্নি ওহাবী গ্রুপ আর আইএসআইএস হল সালাফি সুন্নি গ্রুপ। ফলে দুই গ্রুপ জঙ্গি হলেও তাদের মধ্যে আদর্শ ও দর্শনের কিছু তফাৎ আছে।
এবার আসি পাকিস্তানের জিহাদ প্রসঙ্গে। পাকিস্তানের পাশে দুইটি দেশ ভারত ও চিন। কিন্তু পাকিস্তানী জিহাদীদের জিহাদ শুধু ভারতদের বিরুদ্ধে। জিহাদীরা ভারতের হিন্দুদের যতোটুকু কাফের ভাবে চিনের বোদ্ধদের যতোটুকু কাফের ভাবে না। তাই পাকিস্তানের জিহাদীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে ভারত। অথচ পাকিস্তানের পাশে আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র রয়েছে চিন। পাকিস্তানী জিহাদ, আরবের জিহাদ স্থানকাল পাত্র ভেদে বিভিন্ন হয়। যেমন-৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকেও পাকিস্তানীরা জিহাদ বলেছিল। জিহাদ পুরোটাই একটা রাজনৈতিক শব্দ। ধর্মকে ভর করে এর উত্থান ঘটে। ফলে এই জিহাদের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই এমনটি বলার কোন সুযোগ নেই।
আটশ বছর আগের ইবনে তাইমিয়া থেকে শুরু করে আইএসএর সালাফি সুন্নি মতাদর্শের কারণে যেভাবে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটেছে যেখানে দক্ষিণ আমেরিকা বাদে (মুসলিম নাই কিন্তু মাফিয়া আছে) পৃথিবীর স্থানে যে কোন স্থানে সাধারণ মানুষের উপর বোমা হামলা হয়ে যেতে পারে। স্যাম হ্যারিসের লেখায় স্পষ্টভাবে মার্কিন আগ্রাসনের সমর্থন থাকে স্যাম হ্যারিসনের লেখায় স্পষ্টভাবে মার্কিন আগ্রাসনের পক্ষে সমর্থন থাকে সেটি ভিন্ন আলাপ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যে পরিমাণ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে তাতে ইউরোপের সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ করে যারা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না তাদের কাছে কী উত্তরটি সহয় হয়ে যায়নি?
নোট: ২০১৬ শেষ হতে আরো ৯ মাস বাকি।
তথ্য:http://www.thereligionofpeace.com/
ছবি-আশানুর রহমান খান।
– See more at: http://istishon.com/node/16357#sthash.NYN2cued.dpuf