১৫ অক্টোবর:জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি

উপরের অংশে নিহতদের ছবি। নিচের অংশে আহদ ছাত্রদের ছবি।-দৈনিক বাংলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “জগন্নাথ হল”এর নামের সাথে গৌরবের ইতিহাস ও ত্যাগ দুটি শব্দ পাশাপাশি অবস্থান করে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বর্তমান বাংলাদেশের এমন কোন ঐতিহাসিক ঘটনা নেই সেখানে এই হলের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর পর ১৯৪৮ সনের ১০ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে, এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল করে জমায়েত হয়েছিল জগন্নাথ হলেরই সামনে। শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার নির্বিচারে গুলি চালায়। জগন্নাথ হলের সামনে সুরকির রাস্তা লাল হয়ে গিয়েছিল আহত ছাত্রদের রক্তে। আর টিয়ার গ্যাসের দৌলতে পথটি সিক্ত হয়েছিল ছাত্রদেরই চোখের জলে। তারপর ১৯৫২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারির স্মরণীয় ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জমায়েত হয়েছিল অগণিত ছাত্র-ছাত্রী। ১৯৫২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রদের মিছিলটা যাচ্ছিল এসেম্বলি হাউসের পথে। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের মিছিলে টিয়ার গ্যাস ও গুলি চালায়। ঢাকার রাজপথ ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হল। ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রেক্ষিতে সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী রচনা করলেন “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” যা একুশের গান হিসেবে সুপরিচিত।

02

২৫শে মার্চ (১৯৭১) রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। অপারেশন সার্চলাইটে কম করে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। তবে অনেক বিদেশী পত্রিকার মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজারও উল্লেখ করে। তবে মোট কতো ঐ হাতে খুন হোন তার কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর সর্বপ্রথম হামলা চালায় জগন্নাথ হল। ছাত্র শিক্ষক কেউ হাতের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে পারেনি। একাত্তর সালের ২৬শে মার্চে বুয়েট (তৎকালীন ইপুয়েট) এর প্রফেসর নুরুল উলা বিদেশ থেকে সদ্য আনা ভিডিও ক্যামেরাতে যে ভিডিও চিত্রটি ধারণ করেছিলেন, তার কিছু অংশ NBC News এর এই সংবাদ-চিত্রে স্থান পেয়েছে। যে দৃশ্যাবলী দেখা যায় – পাকিস্তান সেনাবাহিনী জগন্নাথ হলের ছাত্রদের দিয়ে অন্য ছাত্রদের মৃতদেহ সরাচ্ছে। তার পর ঐ ছাত্রদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। একজন ছাত্র প্রথম দফায় মরেনি দেখে খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মৃতদেহের উপরে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালানো হয়। জগন্নাথ হল অমুসলিম ছাত্রদের হল এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গঠনে এই হলের অবদান থাকায় পাকিস্তানীরা এই হল গণহত্যা চালায়। জগন্নাথ হলের পর পাকিস্তানীদের রোষের শিকার তৎকালীন ইকবাল হল (বর্তমান নাম- শহীদ সার্জেন্ট জহরুল হক হল)। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এই হলের শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস প্রতি বছরের ১৫ অক্টোবর পালিত হয়। স্বাধীনতার ১৫ বছর পর জগন্নাথ হলের ছাত্রদের উপর নেমে আসে এক ট্র্যাজেডি। ১৫ অগাস্ট (১৯৮৫) রাত পৌনে নয়টা। জগন্নাথ হলে সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে। পরের দিন দুর্গাপূজার ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাড়ি যাবে। অকস্মাৎ ভয়ংকর শব্দ! মুহূর্তেই ঝড়ে যায় ৩৯টি তাজা প্রাণ। আহত হয় ৩০০ উপর। কোন কোন পত্রিকায় আহতের সংখ্যা ৪০০ প্রকাশ করে। নিহতদের মধ্যে ছাত্রদের পাশাপাশি, কর্মচারী ও হলের অতিথিরাও ছিলেন।

দ্য বাংলাদেশে অবজারভার

প্রবাসী সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী বোখারী’র লেখায় তৎকালীন ঘটনার স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়। লেখাটি মুক্তমনার আর্টিকেল সেকশনে প্রকাশিত হয়। লেখাটির বড় একটি অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল।

“শিক্ষার্থীরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের পরিত্যক্ত প্রাদেশিক সংসদ, অর্থাৎ জগন্নাথ হলের অডিটোরিয়ামে বসে অন্যান্যের সাথে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ দেখছিলেন। নিজেদেরই এক সতীর্থ মনন অধিকারীর অভিনয় দেখবেন সে প্রত্যাশায় অডিটোরিয়ামটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ ভয়ংকর শব্দ; সেই সাথে সব কিছু মিলিয়ে গিয়ে এক নারকীয় অবস্থা। গগনবিদারী চিৎকারে চতুষ্পার্শ্ব ততক্ষণে এক ধ্বংস স্তূপ। বৃষ্টির জলে ৬৪ বছরের পুরনো চুণ-সুড়কীর ছাদ ভেঙ্গে গেছে। ইট, টাইল, লোহা ও কাঠের গরাদসহ চুন-সুড়কীর স্তূপে চাপা পড়েছে সকলে! ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাত পৌনে নয়টায় দুর্গাপূজার ছুটিতে পরদিন বাড়ী যাবে এমন ৩৯ জন ছাত্র, দর্শনার্থী এবং কর্মচারীকে এখানে প্রাণ হারাতে হয়। সেই সাথে আহত হয় আরও ৩০০ জন।

১৭ অক্টোবর।-দৈনিক বাংলা

মুহূর্তের মধ্যে জগন্নাথ হল দুর্ঘটনার সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় জগন্নাথ হলে কোন ছাত্র সংসদ না থাকলেও দ্রুতই উদ্ধার কর্মে এগিয়ে আসেন তদানীন্তন ডাকসু-র ভিপি আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মনসুরও দলের কর্মীদের নিয়ে এগিয়ে আসেন। হলের প্রভোস্ট পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ললিত মোহন নাথ চট্টগ্রামে থাকলেও পরদিন ছুটে এসেছেন। এমনকি তৎকালীন স্বৈরশাসক হিসেবে বিবেচিত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ নাইরোবীতে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে থাকলেও তড়িঘড়ি ছুটে এসেছেন এবং পরে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লক্ষ টাকা করে প্রদান করাসহ পাঁচ তলা ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’ নির্মাণের জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন।

07

নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন সংগঠনের শোক মিছিল

তবে ঐ মর্মান্তিক ঘটনার সাথে সাথেই সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল দমকল বাহিনী, পথচারী মানুষ, রিকশাওয়ালা, প্রতিবেশী ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার মানুষ। তারা কেবল উৎসুক্যতা নিয়েই ছুটে আসেনি, বরং এসেছিল নিজেদের রক্ত দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে। আজ এতো বছর পর এ কথা বলাটা অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৬ বছরের ইতিহাসে এমন সতত মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং একই সাথে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার ক্ষেত্রে এক আদর্শিক দীক্ষার সামিল।”

নিহতদের স্মরণে বিএনপির ৭ দল, আওয়ামী লীগের ১৫ দলের সভা।-১৮ অক্টোবর।

প্রত্যক্ষদর্শী বেগম মমতাজ হোসেন জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি নিয়ে লেখা থেকে জানা যায়-“জগন্নাথ হলের গেটের সামনে একজন মা, লাল টকটকে সিঁদুর সিঁথিতে, কপালে সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করছে। সাথে একজন প্রৌঢ় হয়তো কোনো বাবা হবেন। রিকশা থেকে নেমে দু’জন গেলেন সেই অডিটোরিয়ামের সামনে। দারোয়ান ধরা গলায় যখন বলল আর কি দেখবেন? সব শ্যাষ। মা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, তারপর অডিটোরিয়ামের রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। ‘আহারে আমার পুত। আহারে আমার কেমনে মরছিল? আহারে দম বন্ধ হইয়া পুতে আমার না জানি কত কষ্ট পাইছে। মার বিলাপে ভিড় জমে গেল।বাবা যেন স্তব্ধ নির্বাক একটা পাথরের মূর্তি।”

জগন্নাথ হল দুর্ঘটনার জন্যে দেশ তিন দিনব্যাপী শোক প্রকাশ করেছে। খবরের কাগজের পাতা ভরে গিয়েছে আহতদের ছবি দিয়ে, রেডিওর মাধ্যমে গোটা বিশ্বে এ সংবাদ ছড়িয়ে গেছে। টেলিভিশনে প্রচার করা হয়েছে হৃদয় বিদারক ঘটনার নানা চিত্র। আর গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’র প্রচার বন্ধ করে দেয়। কারণ নাটকটির সাথে জগন্নাথ হলের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি জড়িত। শুকতারা নাটকে নিজেদেরই এক সতীর্থ মনন অধিকারীর অভিনয় দেখবেন শিক্ষার্থীরা টিভি রুমে জড়ো হয়েছিল।

২০১১ সালের ১৫ই অক্টোবর জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক অজয় কুমার দাস বলেন, ‘জগন্নাথ হলের ধসে পড়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯২১ সালে। ১৯৮৫ সালে ভেঙে পড়ার আগেই এটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ হলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সংখ্যালঘু ছাত্রদের হল। তাই এ হলে সব সময়ই শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ ছিল।‘ তিনি আরও বলেন, ‘আর তা মোকাবেলার জন্য স্বাধীনতার পর তড়িঘড়ি করে কারিগরি দিক পর্যালোচনা না করেই সেই ভবনটি চালু করা হয়েছিল। এরই পরিণতি সেই দুর্ঘটনা।’

উদ্ধার অভিজান, আহতদের চিকিৎসা প্রদানসহ নানা রকম কর্মসূচীর ছবি।-দৈনিক বাংলা

সংস্কারে অভাবে ৬৪ বছরের পুরাতন ছাত্রদের উপর ধ্বংসে পড়ে। হল সংস্কারের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগের ১৫ দল ও বিএনপির ৭ দলসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দল জগন্নাথ হলের নিহতের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচী এবং এই দুর্ঘটনার জন্যে কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিকে দায়ে করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, তৎকালীন শিক্ষার্থীদের জবানবন্দিতে এটি প্রমাণিত হয় যে; জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি সংঘটিত হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা ও খামখেয়ালিপনা দায়ী। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন জোড়াতালি দিয়ে সঠিকভাবে সংস্কার না করে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে বাধ্য করছে। ঢাকা শহরে ভূমিকম্প কিংবা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন আরেক ট্র্যাজেডি যেন সৃষ্টি না হতে পারে, তার জন্যে কর্তৃপক্ষের কাছে ভবনগুলোর সংস্কারের জোর দাবী জানাচ্ছি।

14666160_10207378509130148_5322785772952515491_n

পত্রিকার কপি কৃতজ্ঞতায়:PID, Ministry of Information
বিশেষ কৃতজ্ঞতা- ওমর শেহাব ভাইয়ের প্রতি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.