ইইউ দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নীতি-মালা

দুই কোটি মানুষের ডিজিটাল শহর ঢাকা। অথচ এই শহরে মানুষের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার জন্যে ঢাকার বাহিরে কেরানীগঞ্জে গিয়ে ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাগজ জমা, তথাকথিত ৪০ সেকেন্ডের পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়। ১০ মিনিটের নাম মাত্র থিউরি ও ৪০ সেকেন্ডের পরীক্ষা আসলে সৌজন্যতা মাত্র, কারণ ঘুষ ছাড়া ওখান থেকে যোগাযোগ-মন্ত্রীও লাইসেন্স বের করতে পারবে না।। সচেতনভাবেই ড্রাইভিং পরীক্ষার সময় ৪০ সেকেন্ড বলছি, অনেক সময় তারও কম! কারণ পরীক্ষায় দশ-পনের ফুট গাড়ি চালানো চালাতে ৪০ সেকেন্ড অনেক লম্বা সময়।

বাংলাদেশে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। স্বভাবতই সবার মতন বাড়তি অর্থ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়েছে। এখানে আসার পর এখানকার প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে যে পরিশ্রম করতে হয় তা দেখে অনেকেই অবাক হবে। এবং সেই সাথে এটিও স্বীকার করবেন যে-বাংলাদেশে আসলে ড্রাইভিংয়ের নামে এক ধরনের তামাশা করা হয়। আসলে ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলেও ব্যক্তি যে গাড়ি চালানোর যোগ্য রাখে তা বাংলাদেশে নিশ্চিত করা বলা যাবে না। আমরা হয়তো ইইউ দেশের মতন ড্রাইভিং লাইসেন্সের সিস্টেমে এখনই যেতে পারব না কিন্তু কিছু জিনিস তো আমরা নিশ্চয়ই ফলো করতে পারি। কারণ প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, আহত ও পঙ্গু হয় কয়েক লক্ষ মানুষ। এছাড়া আমাদের রাস্তায় কতো স্পিডে গাড়ি চালানো হবে তারও কোন দিক নির্দেশনা নেই। অথচ যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের মতন একখানা বিশাল মন্ত্রনালয় আমাদের রয়েছে। একজন ব্যক্তিকে ইইউ’র ড্রাইভিং লাইসেন্স (ব্যক্তিগত গাড়ি, ওজন সর্বোচ্চ ৩.৫ টন) পেতে কী পরিমাণ পরিশ্রম ও পড়াশুনা করতে হয় তার একটা নমুনা এখানে দেখানোর চেষ্টা করব। ইইউর প্রতিটি দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স পদ্ধতি প্রায় এক, দুই একটায় হয়তো ভিন্নতা থাকতে পারে।

ইন্ট্রোডাকশন ক্লাস

স্কুলে কিংবা পরিচিত কোন ব্যক্তির কাছে গাড়ি চালানো শিখতে গেলে প্রথমেই ইন্ট্রোডাকশন ক্লাস করতে হবে। এর জন্যে একটা ফি দিতে হবে। এখানে ড্রাইভিং পেতে গেলে কী কী করতে হবে, থিউরিতে কীভাবে প্রশ্ন করা হয় এসব সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হয়। যেমন ধরেন; আপনার গাড়ি এমন ব্যক্তিকে চালাতে দিলেন যার কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সে ক্ষেত্রে শাস্তি শুধু ঐ ব্যক্তি পাবে না, সেই সাথে আপনাকেও পেতে হবে। এই ক্লাস এক ধরণের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।।

চোখ পরীক্ষা

চোখের কী অবস্থা তার পরীক্ষা করে সরকারী সড়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। আপনাকে কষ্ট করে পাঠাতে হবে না, চোখের ডাক্তারখানা থেকে অটোমেটিক আপনার রিপোর্ট তারা পাঠিয়ে দেবে। আপনার চোখের অবস্থা যদি খুব খারাপ হয় তাহলে আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সে লেখা থাকবে-গাড়ি চালানোর সময় চশমা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। তখন চশমা ছাড়া গাড়ি চালালে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

ড্রাইভিং শেখা

ড্রাইভিং স্কুলে খুব সহজেই গাড়ি চালানো শেখা যায়। এছাড়া আপনি আপনার পরিচিত যে কোন ব্যক্তি থেকে গাড়ি চালানো শিখতে পারবেন। তবে যিনি আপনাকে শেখাবেন তাকে একটা ফি দিয়ে “ড্রাইভিং শিক্ষকের দায়িত্ব” সম্পর্কে একটা ক্লাস করতে হবে। জীবনে এটা একবারই করতে হয়। পূর্বে করা থাকলে পরবর্তীতে আর করা লাগে না। ড্রাইভিং শেখানোর দায়িত্ব পেতে গেলে ব্যক্তিকে ৫ বছরের গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। স্কুলে ড্রাইভিং শেখা যেহেতু খুব খরচের কাজ তাই অনেকেই পরিচিত মানুষ থেকে ড্রাইভিং শিখে পরবর্তীতে ড্রাইভিং স্কুলে কয়েকটা কোর্স কিনে নিজেকে পরখ ঝালিয়ে নেয়। শুধু কার কাছে শিখতে চাচ্ছেন তার জন্যে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অনুমতি পত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পথে পুলিশ ধরলে এই অনুমতি পত্র দেখানো বাধ্যতা মূলক। তবে স্কুলে আপনাকে যেতেই হবে কম কিংবা বেশ। কারণ স্কুলের শিক্ষক আপনার ছোট ছোট অনেক ভুল ধরিয়ে দেবে যার জন্যে হয়তো মূল পরীক্ষায় আপনি অকৃতকার্য হতে পারেন।। আপনি যখন গাড়ি চালানো শিখছেন তখন অন্য চালকরা যেন বুঝতে পারে আপনি একজন শিক্ষা নবীশ তাই গাড়ির পেছনে “শিক্ষা নবীশ” লেখা স্টিকার লাগানো থাকে। ফলে অন্য গাড়িগুলো খুব সতর্কতা সহিত আপনার আচরণ খেয়াল করতে পারে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে; আপনি যখন গাড়ি চালাবেন তখন পাশের সিটে অবশ্যই আপনার শিক্ষক থাকতে হবে।। আপনি কোন অঘটন করতে আপনার শিক্ষকের উপর সেই দায়টা যাবে।।

স্নো ও বরফে গাড়ি চালানো প্রশিক্ষণ

এখানে যেহেতু স্লো পড়ে সেহেতু স্নো এবং বরফে গাড়ি কীভাবে চালাতে হয় তার জন্যে ক্লাস করতে হয়। শীতের সকালে অফিসে যেতে দেরি হলেও কেন গাড়ি দ্রুত চালাতে নেই সেগুলোর হাতে নামে গাড়ি চালিয়ে দেখানো হয়। স্লো ও বরফের প্রশিক্ষণের জন্যে আলাদা গাড়ি রয়েছে।। স্লো, বরফে কীভাবে ব্রেক করতে হয়, চাকা পরিবর্তন করলে পেছনে নাকি সামনে লাগাতে হয় এমন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান আপনাকে তিন ঘণ্টার ক্লাসে দেওয়া হবে। এর বিনিময়ে আপনাকে ফি দিতে হবে।

ড্রিংকস ও মাদক সচেতন ক্লাস

মদ খেয়ে গাড়ি চালালে কী হয়, আমাদের শরীর কী প্রতিক্রিয়া করে, আমাদের চোখ-মগজ কেমন আচরণ করে এসব আপনাকে দেখানো ও পড়ানো হবে। মদ, মদক সেবন করে গাড়ি চালালে শান্তি কী কিংবা আপনার বন্ধু যখন গাড়ি চালাচ্ছে আপনি তাতে উত্তেজিত করলে যে আপনিও অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন এমন অসংখ্য তথ্য ও জ্ঞান আপনাকে ৪ ঘণ্টার ক্লাসে দেওয়া হবে। এর জন্যে অবশ্যই আপনাকে ফি দিতে হবে। উপরে সকল কোর্স শেষ করার পরই আপনি মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

থিউরি ও ড্রাইভিং পরীক্ষা

সাধারণত ছয় থেকে আট মাসের পড়াশুনা ও ড্রাইভিং অনুশীলনের পর একজন ব্যক্তি মূল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের সবচেয়ে কঠিন পর্ব হল থিউরি পাশ করা! কারণ ৬৫ টি প্রশ্নের মধ্যে আপনাকে ৫২ পেতে হবে। সময় মাত্র ৫০ মিনিট। ৩০০ পৃষ্ঠার বইটির পুরোটা আপনার জানা থাকতে হবে। কয়েক হাজার প্রশ্নের মধ্যে কম্পিউটার আপনার কাছে ৬৫ টি প্রশ্ন হাজির করবে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের বইয়ের উপর হাফেজ না হয়ে কেউ এই থিউরি পাশ করতে পারে না।। কেউ যদি লিখতে, পড়তে না জানে তাদের জন্যে আলাদা পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। থিউরি ও ড্রাইভিং আপনাকে পাশ করতে হবে। ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে হয় সরকারী প্রতিষ্ঠানে। ৩০-৪০ মিনিট আপনাকে গাড়ি চালাতে হবে। সামান্য কোন ভুল মানেই হল আপনি পরীক্ষা পাশের অযোগ্য বিবেচিত হবে। থিউরি ও ড্রাইভিং পরীক্ষা কোন এক বিষয়ে যদি পাশ করতে পারেন তাহলে আপনাকে ২ মাস সময় দেওয়া হবে বাকি অংশ পাশ করার জন্যে। দুই মাসে যদি ব্যর্থ হোন তাহলে পরবর্তীতে আবার থিউরি ও ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে হবে। এবং প্রতিবার পরীক্ষা আপনাকে ফি গুণতে হবে।

ড্রাইভিং পরীক্ষা পাশ

থিউরি ও ড্রাইভিং পরীক্ষা উত্তীর্ণ হলে ৭ দিনের মধ্যে আপনার বাসায় ড্রাইভিং কার্ড পৌঁছে যাবে। তবে এতেই খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ কার্ড পাওয়ার পর থেকে দুই বছর আপনারprobation টাইম হিসেবে গণ্য হবে। এই দুই বছরের মধ্যে আপনি যদি কোন মেজর ভুল করেন তখন আপনার আর্থিক জরিমানার সাথে সাথে আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হবে পারে।। এখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স কী কারণে বাতিল হবে পারে তার দুইটা সাধারণ নমুনা দেখাই: এক. সিগন্যালে লাল বাতি উপেক্ষা করে আপনি গাড়ি চালিয়েছেন কিংবা ৩০ কি.মি স্পিডের রাস্তায় আপনি ৫০ কি.মি চালিয়েছেন। এই অপরাধে আপনার আর্থিক জরিমানার সাথে সাথে লাইসেন্স বাতিল বলে গণ্য হতে পারে। মদ খেয়ে গাড়ি চালালে বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও লাইসেন্স বাতিল।। এছাড়া প্রতিটি আইন ভাঙার সাথে আর্থিক জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের ভয় তো থাকছেই।

ইউরোপের এতোগুলো ধাপ অতিক্রম করার পর কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়। অথচ আমাদের দেশে ড্রাইভিং লাইসেন্সের নামে যে তামাশা হচ্ছে তাকে পথে ঘাটে হাজারো মানুষ গাড়ির নিচে নিহত হচ্ছে। খুনের জায়গায় আমরা সেগুলোকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিচ্ছি।। কাগজ পত্র ফিটনেস কোন কিছুরই আমাদের ঠিক নেই। রাস্তায় মানুষ মারতে মারতে আমরা গাড়ি চালানো শিখে ফেলি।। ফাটাকেষ্টর মতন মন্ত্রীরা লোক দেখানোর জন্যে একদিন বাসে উঠলে আনন্দে আমরা কেঁদে দিই অথচ কেউ প্রশ্ন করি না; প্রতি বছর মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে কেন যেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বছরে “শূন্য দুর্ঘটনা ভিশন” গ্রহণ করেছে।

শিক্ষার্থীদের দাবী বিষয়ে একটু কথা বলি

ছাত্রদের নয় দফা দাবীর ৭টা দফা ঠিক আছে তবে প্রথম দফার অগ্রহণযোগ্য। দফাটি হল: বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সহযোজন করতে হবে। আর ৬ নাম্বার দাবীতে সড়ক দূর্ঘটনা আরও বাড়বে।

দাবীগুলোর মধ্যে একমাত্র ফাঁসির দাবীটি বাস্তব সম্মত দাবী হয় নাই। কারণ তার নামই সড়ক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লক্ষের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয়।। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি, মদ খাইয়া গাড়ি চালানোর জন্যে ১০-১৪ বছরের জেল দাবী করা যায়।। ফাঁসির দাবীটা কখনো গ্রহণ যোগ্য হবে না,পৃথিবীর কোন দেশে এমন আইন আছে বলে মনে হয় না।। এমন আইন করলে কেউ নিজের গাড়ি চালাতেও রাজি হবে না। বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির সব দেশে আছে।। বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৪০ হাজারের বেশি মানুষ (বাস্তবতা আরও কয়েক গুণ) এবং আহত হয় কয়েক লক্ষ।। সড়ক দুর্ঘটনায় ফাঁসি হলে প্রতিদিন কম করে ১০০ লোককে ফাঁসি দিতে হবে।

২০১৩ সালে ৭১-এর গণহত্যা সহায়তাকারীদের রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে ফাঁসি দাবী করায় শাহবাগকে অনেকে ফ্যাসিস্ট আন্দোলন বলছে। ঐসব ক্রিমিনাল বুদ্ধিজীবী এখন বছর ৪০ হাজার লোকের ফাঁসি দাবী করাকে কী বলে আখ্যায়িত করবে সে নিয়ে চিন্তিত নই তবে আবেগের বশে বাচ্চারা অবাস্তব একটা দফা নয় দফায় সংযুক্ত করেছে।। আট দফা দাবী আন্দোলন করে আদায় করা সম্ভব তবে ১০০ ছাত্র আত্মাহুতি দিলেও প্রথম দফাটি আদায় হবে না। তাই প্রথম দফাটি সংস্কার করা প্রয়োজন।

আর ৬ নাম্বার দাবীটি হল; শিক্ষার্থীরা হাত দেখালে বাস দাঁড়াতে হবে! এটাও অযৌক্তিক। কারণ এতে আরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটনার সুযোগ থাকে। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া বাসে কেউ উঠতে কিংবা নামতে পারবে না, এটাই নিয়ম হওয়া উচিত।

(কাউকে ইচ্ছাকৃত-ভাবে চাপা দিয়ে মারা সেটা খুন। সেটা ভিন্ন আলাপ। বেপরোয়া গাড়ি চালানো রোধ করতে রাস্তায় ডিজিটাল মেশিন স্থাপন করা যেতে পারে। এশিয়ার সুইজারল্যান্ডখ্যাত বাংলাদেশ এই মেশিন কেনার ক্ষমতা আছে এবং অটোমেটিক মেশিনের রিপোর্ট দেশে অপরাধী ধরার ক্ষমতা রাখে বলে আমি বিশ্বাস করি। )

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.