মারি ক্যুরি এর জীবন ও সংগ্রাম, পর্ব ১

মারি ক্যুরি এর জীবন ও সংগ্রাম, পর্ব ২

কারিন স্ভেনসনের (Carin Svensson) লেখা “Marie Curie: Forskaren som sprängde gränser” বইটিতে মারি ক্যুরির জীবনী সংক্ষেপে বর্ণনা করা আছে। বইটিতে মারি ক্যুরির সমগ্র জীবনের সংগ্রাম, বিয়োগান্তক অধ্যায়, সাফল্য সব কিছু লিপিবন্ধ করা আছে। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্যে বইটি এখানে অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম।

“মারি ক্যুরি (ফরাসি: Marie Curie) প্রথম নারী বিজ্ঞানী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।  মারি ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য তাঁর স্বামী পিয়ের ক্যুরি এবং তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক অঁরি বেকেরেলের সাথে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ছিলেন প্রথম নারী বিজ্ঞানী যিনি বিজ্ঞানের দুইটি ভিন্ন শাখায় দুইবার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মারি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম মহিলা অধ্যাপক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যার অসামান্য মেধার কারণে ১৯৯৫ সালে প্যান্থিয়নে সমাহিত করা হয়। রাশিয়া বিভাগের সময় পোল্যান্ডের ওয়ার্সতে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর মারি ক্যুরি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ভ্লাদিস্লাও স্ক্লদভস্কি পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন পড়াতেন যা পরবর্তীতে মারিয়ার লেখাপড়ার বিষয় হয়ে দাড়ায়। আর মা আন্না মেয়েদের স্কুলে কাজ করতেন। পাঁচ ভাই বোনদের মধ্যে মারি ছিলেন সবচয়ে ছোট।  মারির জ্যেষ্ঠ ভাই বোনদের নাম জোফিয়া (জন্ম ১৮৬২), জোজেফ (জন্ম ১৮৬৩), বরিন্সলা (জন্ম ১৮৬৫) এবং হেলেনা (জন্ম ১৮৬৬)।“

এক.

ছোট বেলায় মারির মধ্যে এমন কোন আলামত দেখা যায়নি কিংবা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি যে, মারি একদিন এতো বড় গবেষক হবেন। তবে মারি যখন চার বছরের শিশু ছিলেন তখন তাঁর এক বছরের বড়  বোন হেলেনার তুলনায় তিনি দক্ষতার সাথে বই পড়তে পারতেন।  মারির মা আন্না অসুস্থতার কারণে স্কুলের চাকরিটি ছাড়তে বাধ্য হন। মারির পূর্ব-পুরুষ কয়েকটি দূর্গ ও বাগানের মালিক ছিলেন।  ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ এর মধ্যে ঐতিহাসিক জানুয়ারি আপ্সপ্রিং-এর সময় পোল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয়ার কারণে মারি ক্যুরির পৈতৃক এবং নানা বাড়ির সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে পরিবার অর্থনৈতিকভাবে গরীব হয়ে পড়লেও তারা নিজেদের কর্মের জন্যে গর্বিত ছিল। এই কারণে মারি ক্যুরি এবং তাঁর ভাইবোনদের খুব অল্প বয়সেই জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়। মা আন্না অসুস্থতার কারণে সারাদিন বাসায় থেকে জুতা তৈরির কাজ শেখে নেন। অন্তত নিজের সন্তানদের জন্যে যেন জুতা  বানাতে পারেন। কিন্তু আন্নার অন্য আরেকটি দুশ্চিন্তা ছিল, সন্তানরা যেন তার কারণে অসুস্থ না হয়ে পড়ে। আর এই কারণে তিনি সন্তানদের থেকে সবসময় একটা  দূরত্ব বজায় রাখতেন। কারণ আন্না যক্ষা রোগে আক্রান্ত ছিলেন, যা তৎকালীন সময়ে কঠিন ও ছোঁয়াছে রোগ হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু ছোট্ট মারি মায়ের কাছে আসতে চাইতো, মাকে দিনে একবার অন্তত জড়িয়ে ধরতে চাইত। মারি যখন মাকে একবার জড়িয়ে ধরার বায়না করতো তখন আন্না মেয়েকে বাহিরে খেলার জন্যে পাঠিয়ে দিতেন। মায়ের সাথে খেলার সুযোগ না হলেও পিতা বলেস্লাও সন্তানদের সাথে খেলার চেষ্টা করতেন। বিশেষ করে, সন্তানদের নিয়ে পদার্থ, রয়াসনের বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।।


বাবা ও দুই বোনের সঙ্গে মারি (বাম পাশে)

মারিদের বাসাটা বড় ছিল না। তার উপর ৫ ভাই বোন, অসুস্থ মা। আর পিতাই ঘরের একমাত্র উপাজর্নকারী ব্যক্তি। তাই বাধ্য হয়ে রুমের অর্ধেক অংশ স্কুলের এক ছেলের কাছে ভাড়া দিয়ে দেয়। ঘরের টেবিল ছিল শুধু একটা যেখানে খাবার আবার খাবার শেষে পড়াশোনার কাজ হতো। এমন অভাবের মধ্যেই মারির বড় বোন মারা যান এবং এই বড় বোনকে মারি কখনো ভুলতে পারেননি। মারির জীবনে বোনের মৃত্যুই ছিল প্রথম বিয়োগান্তক অধ্যায়।

দুই.

সে সময় পোল্যান্ড রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল। রাশিয়া পোল্যান্ডের সব কিছু নির্ধারণ করতো। ফলে দিনদিন পোল্যান্ডের মানচিত্র মুছে যেতে থাকে। এমনকি স্কুলে পোল্যান্ডের পোলীয় ভাষার বদলে বাচ্চাদের রাশিয়ান শেখানো হতো এবং রাশিয়ান ভাষায় শিক্ষাদান করা হতো। পরবর্তীতে জার্মানি এই পোল্যান্ড দখলের মাধ্যমেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। বলা যায়, রাশিয়া ও জার্মানি দুই দেশই পোল্যান্ডকে ঘাড়ে সবসময় নিঃশ্বাস ফেলছিল। স্কুলে পোলীয় ভাষায় পড়ানো যেত না! তাই মারির শিক্ষকরা লুকিয়ে পোলীয় ভাষায় নিজেদের শিক্ষার্থীদের পড়ানোর চেষ্টা করতেন। সবাই রাশিয়ান ভাষায় শিক্ষাদান করছে কিনা তা তদারকি করতে মাঝে মধ্যে স্কুল ইন্সপেকটর স্কুল পরিদর্শনে আসতেন।  তবে শিক্ষকরাও চতুর কম ছিলেন না। তারা স্কুল পরিদর্শকের আসার খবর সংকেতের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিতেন। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই রাশিয়ান ভাষায় কথা বলা শুরু করতেন। একদিন মারিদের ইতিহাসের ক্লাশ ছিল। তো, বরাবরের মতন সবাই পোলীয় ভাষায় পড়ছে ও লিখছে কিন্তু হঠাৎ করে ইনস্পেক্টর আসার সংকেত শুনতে পেল। সবাই নিজেদের পোলিশ বই ও খাতা দ্রুত লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু একটি মেয়ে অসাবধানতাবশত নিজের পোলীয় খাতা টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে। সেদিন ক্লাশে ঢুকেই স্কুল ইন্সপেক্টর খাতা দেখতে না চেয়ে বরং “প্রার্থনা শ্লোক” শুনতে চাইলেন। শিক্ষকের নির্দেশে শ্লোক পড়ার জন্যে মারি সবার সামনে এগিয়ে গেলেন। মারি কোন সংকোচ ছাড়াই সুন্দর ভাবে রাশিয়ান ভাষায় “প্রার্থনা শ্লোক” পড়ে ফেললেন। এরপর ইন্সপেক্টর মারিকে প্রশ্ন করলেন; পোল্যান্ড কার আদেশ মান্য করবে? মারি নিঃসঙ্কোচে বলল; জার আলেকজান্ডার দ্বিতীয়র। এপর ইন্সপেক্টর খুশি হয়ে চলে গেলেন। শুদ্ধ রাশিয়ান বলার মাধ্যমে মারি শুধু নিজের ক্লাশই নয় পুরো স্কুলকে রক্ষা করলেন। ইন্সপেক্টর চলে যাওয়ার পর মারি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন আর অন্যরা তাঁকে সান্ত্বনা দিতে জড়িয়ে ধরল। মারি সবসময় স্কুল ইন্সপেক্টরদের ঘৃণা করতেন। স্কুলে সব কিছু মারি খুব দ্রুতই শিখে নেয়। মারির স্মৃতিশক্তিও ছিল চমৎকার। দুই বার কোন কবিতা শোনার মাত্র মারি সেই কবিতা চমৎকারভাবে আবৃত্তি করতে পারতেন। এছাড়া রাশিয়ান, পোলীয়, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারতেন। এছাড়া মারি ছিল স্কুলের ক্লাশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী।

মারির সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল কাতিয়া। প্রতিদিন তারা একসাথে স্কুলে যেতেন। ১৮৮১ সালে দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তারা একসাথে ক্লাশে নেচেছিলেন। এমনকি একদিন মারি ও কাতিয়া আলেকজান্ডার দ্বিতীয় স্ট্যাচুর উপর থুথু নিক্ষেপ করেন। এক সময় রাশিয়ান রাজের শাসনের বিরুদ্ধে পোলিশরা আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের উপর রাশিয়ানরা চালাল দমন-নিপীড়ন। রাশিয়া শাসকদের কারণে পোল্যান্ডের ভাষা, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে নিজস্ব স্বকীয়তা ছিল হুমকির মুখে। পোলিশরা এর থেকে মুক্তি চাইল। একদিন মারির এক সহপাঠীকে বেশ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। কারণ তার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে এবং আগামী কাল তার ফাঁসি দেওয়া হবে। তার ভাইয়ের অপরাধ ছিল; আন্দোলনের সময় তার ভাই রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করতে চেয়েছে। সারা রাত মারি তার বান্ধবীর সাথে বসে ছিল। হয়তো ভাইয়ের ফাঁসি হবে না, এমন করে নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তারা। কিন্তু রাশিয়ানরা তাদের কথা রেখেছিল। পরের দিন সকাল সকাল তারা ফাঁসি কার্যকর করে। অন্যদিকে মারির মা’র অবস্থাও ভাল ছিল না। মায়ের জন্যে মারি প্রায় সময় গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করতেন। কিন্তু ঈশ্বরও মুখ তুলে তাকাননি। মারির বাবা ছিলেন নাস্তিক তবে মা ছিলেন ছিলেন ক্যাথলিক। মায়ের মৃত্যুর পর মারি ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। মায়ের মৃত্যু ছিল মারির জীবনে দ্বিতীয় বিয়োগান্তক ঘটনা। মায়ের মৃত্যু মারির জীবনে গভীর দাগ কাটে। এরপর থেকে মারি গম্ভীর ও চুপচাপ স্বভাবের হয়ে যায়। তার ভাই-বোনরা যখন খেলাধূলা কিংবা অন্য কিছু করত মারি তখন একা একা নিজের মতন করে পড়াশুনা করতেন। মারি বইয়ের মধ্যে নিজের জগৎ খুঁজে নেয়। ফলে মারি শুধু বইয়ের মধ্যেই ডুবে থাকতেন। মায়ের মৃত্যুর পর মারি খুব দ্রুত স্কুলে চলে যেতেন এবং সবার শেষে স্কুল থেকে ফিরে আসতেন। কারণ একমাত্র স্কুলে গেলেই মারি তার সকল দুঃখগুলো ভুলে যেতে পারতেন। ১৬ বছর বয়সে মারি স্কুলে পরীক্ষা দেয় এবং সেখানে সে স্কুলের সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম স্থান অধিকার করে নেন। মেয়ের সাফল্যে মারির বাবা মেয়েকে বলে, ‘তুই অনেক কষ্ট করেছিস এখন তোর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন মা’।

তিন.

গ্রামের দিকে মারিদের অনেক আত্মীয়-স্বজন ছিল। এছাড়া  কাজিনদের সংখ্যাও কম ছিল না। স্কুল পরীক্ষার পর সবাই মিলে গ্রামে বেড়াতে গেলেন। সেখানে যাওয়ার পর গম্ভীর সেই মারি হঠাৎ করে যেন বদলে গেলেন।  মারি সবার সাথে হাসছেন, গান গাইছেন এমনকি সবার সাথে নাচছেন! এক রাতে মারি এতো বেশি নেচেছিলেন যে তাঁর নতুন জুতো ছিঁড়ে যায়। গ্রামে গিয়ে মারি ঘোড়ায় চড়া, নদীতে গোসল করা  শিখেছেন। এছাড়া মারির একটি শখ ছিল, পাহাড়ে হাঁটতে যাওয়া ও পাহাড়ি ফুল সংগ্রহ করা। অবসর সময়ে মারি রোমান্টিক ট্র্যাজেডি উপন্যাস পড়ে নিজের সময় ব্যয় করতেন। কখনো কখনো মারি সারা দিন ঘুমাতেন আর সারা রাত জেগে থাকতেন। মায়ের শোক এরপর আর বেশিদিন থাকেনি কারণ নিজের খরচের জন্যে এবার মারিকে নিজেই আয় করতে হবে।

মারির পরিবারের সবাই বেশ অল্প বয়সেই উপার্জন শুরু করেন। বড় বোন জোফিয়া ১২ বছর বয়সে মারা যায়। মারা যাবার আগে তিনি-ই মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করতেন। আরেক বোন  বরিন্সলা অনেক বছর বিভিন্ন পরিবারে গৃহশিক্ষক ও বাচ্চাদের দেখা শোনার কাজ করেছেন। বরিন্সলার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়া কিন্তু অর্থ ছাড়া তো ডাক্তারি পড়া তো সম্ভব নয়, তাই তাকে কাজ করতে হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে বরিন্সলার বয়স ২৩ হয়ে গেছে এবং অবিবাহিত। তার বিয়ে নিয়েও পরিবারের একটা বাড়তি চিন্তা ছিল। বরিন্সলার ছোট ভাই জোশেফ ভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়েছেন। এরপর বোন হেলেনা। হেলেনা মারির চেয়ে এক বছরের বড় ছিলেন, তবে দুজনে এক সাথেই ছোট বেলায় একই ক্লাশে স্কুলে যেতেন। ছোট বোন সব সময় ক্লাশে প্রথম হচ্ছে কিংবা ক্লাশের সবচেয়ে ভাল শিক্ষার্থী হচ্ছে এমন পরিস্থিতি হেলেনার জন্যে সহজ ছিল না। হেলেনা প্রথমে কয়েকদিন মানুষের বাসায় টিউটর হিসেবে কাজ করে পরবর্তীতে এক বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। মারি ও বরিন্সলার ইচ্ছে ছিল ভাইয়ের মতন পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশে গিয়ে ভার্সিটিতে মেডিক্যালের উপর পড়বেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ভার্সিটিতে মেয়েদের পড়া নিষিদ্ধ ছিল। তাই অন্য কোন দেশে যাওয়া ছাড়া মেয়েদের পক্ষে মেডিক্যাল পড়া সম্ভব ছিল না। তবে মারি একটা বুদ্ধি বের করেন। সে বরিন্সলারকে মেডিক্যাল পড়ার জন্যে প্যারিস যেতে বলে আর অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্যে তখন তিনি কাজ করবেন। বরিন্সলার পড়া শেষে মারি মেডিক্যাল শুরু করবেন। বরিন্সলা এই প্রস্তাবে মত দিল। তবে এর জন্যে প্রথমে মারিকে ভাল বেতনের একটি কাজ জোগাড় করতে হবে। সে সময় ওয়ারশে থেকে ৮০ কি.মি দূরে এক পরিবারে মারি কাজের সন্ধান পান। এক কাপড় ব্যবসায়ীর সদ্য জন্ম নেওয়ার নবজাতকের দেখাশোনার কাজ করতে হবে। অপরিচিত একটি পরিবারের সাথে থাকতে হবে ভেবে প্রথমে মারির মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে। তবে পরবর্তীতে পরিবারের সাথে মারির বেশ ভাব জমে উঠে। এবং তাদের অন্য বাচ্চাদের সাথে মারির বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। পরবর্তীতে ঐ পরিবারের ছোট মেয়ে মারির ছাত্রী হিসেবে পড়াশুনা শুরু করে। কাজ শেষ হলে রাতে মারি গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন নিয়ে পড়তে বসতেন। যদিও মারি নির্দিষ্ট করে জানতেন না সে কী পড়বে তারপরও শুধু জানার জন্যে পড়তেন। মারি বিশ্বাস করতেন যে; মানুষ যতো বেশি জানবে, যতো বেশি বুঝবে তা সমাজের জন্যে ততো বেশি ভাল ফল বয়ে আনবে। মারি ঘরের মালিক ও গৃহিনীকে বলল-তাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে তিনি গ্রামের দরিদ্র শিশুদের পোলীয় ভাষা পড়াতে ও শেখাতে চান। এমন প্রস্তাবে মালিক রাজি হল এবং গ্রামের প্রায় ২০ জন বাচ্চাকে নিয়ে  নিজের স্কুল শুরু করেন। মাঝে মধ্যে বাচ্চাদর সাথে বাবা-মাও মারির কাছে পড়তে আসতেন।

মারি যাদের বাসায় কাজ করতেন তাদের বড় ছেলের নাম ছিল ক্যাসিমির। ক্যাসিমির “ওয়ারশ ভার্সিটি’তে পড়াশুনা করতেন। মারি ও ক্যাসিমির সময় পেলে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। বিশেষ করে, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। অবসরে দুই জনে মিলে পাহাড়ে হাঁটতে বের হতেন, তখনও তারা পড়াশুনার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। মজার বিষয় হল এসব আলোচনায় তাদের কখনো ক্লান্তি আসতো না। ক্যাসিমিদের পরিবারে মারির কাজের বয়স প্রায় দুই বছর হতে চললো। ক্যাসিমির বাবা-মা’ও মারিকে খুবই পছন্দ করে। ক্যাসিমি যখন মারিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় মারি তাতে সম্মতি দেয়, কিন্তু ক্যাসিমির বাবা-মা বিয়েতে বেঁকে বসেন! তাদের মূল আপত্তির জায়গা ছিল তাদের ছেলে একজন গরীব গৃহশিক্ষককে বিয়ে করতে যাচ্ছে যা তাদের সামাজিক স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। মারি ও ক্যাসিমির মন খারাপ ও হতাশ হওয়া ছাড়া তাদের অন্য কিছু করার ছিল না। ক্যাসিমিকে অবশ্যই পিতা-মাতার সিন্ধান্ত মেনে নিতে হবে না হলে সে পিতা-মাতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে হবে এবং অর্থকষ্টে জীবন পার করতে হবে। গরীবের জীবন কী, কীভাবে সামান্য কয়টি টাকায় মাস চালাতে হয় সেই অভিজ্ঞতা মারির আছে। মারি ক্যাসিমিকে বললেন, কেন তুমি পিতা-মাতার সিন্ধান্ত মেনে নিচ্ছ না? আর যদি সত্যি আমাকে তুমি ভালোবেসে থাক তাহলে তাদেরকে তা জানিয়ে দাও। কিন্তু ক্যাসিমি সম্পত্তির উত্তরাধিকার হারানোর ভয়ে পিতা-মাতার বিরুদ্ধে কিছু বলতে রাজি নয়। সুতরাং মারি বুঝে গেছেন যে, ক্যাসিমির তাকে সেভাবে ভালোবাসে না। ক্যাসিমির তাকে ছেড়ে যাওয়ায় মারি প্রচণ্ডভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং ক্যাসিমিরকে ভুলে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে তার পক্ষে এই চাকরিটি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় কারণ তার বোনকে মেডিক্যাল পড়ার জন্যে টাকা পাঠাতে হয়। তাই ক্যাসিমিরদের ঘরে আগের মতন তার গুরুত্ব ও ব্যবহার না থাকলেও মারি সেখানে কাজ চালিয়ে যান। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে কাজ করলেও বাহ্যিকভাবে তা বোঝার উপায় ছিল না। বাড়ির কর্তা যেন কোন ক্রটি দেখতে না পায় তাই মারি আগের মতনই কঠিন পরিশ্রম করেন । তিন বছর কাজ করার পর মারি ওয়ারশে ফিরে আসেন। এর মধ্যে মারির বাবা একটা স্কুলে ভাল বেতনের চাকরি পেয়েছে ফলে প্যারিসে বরিন্সলার জন্যে তিনি এখন টাকা পাঠাতে পারবেন আর মারির নিজের জন্যে চিন্তা করার একটু ফুসরত মিলল।

চার.

মারির বড় বোন বরিন্সলা প্যারিসে এক ফ্রেঞ্চ নাগরিককে বিয়ে করেন। তারা দুই জনে মিলে গরীব এলাকার পাশে একটি সার্জারির ডাক্তারখানা খুলে বসেন। বরিন্সলা ও তার স্বামী শুধু তাদের থেকে টাকা নিতেন যারা টাকা দেওয়ার সামর্থ রাখতেন। তারা তাদের পড়াশুনা ও জ্ঞান সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার পেছনে কাজে লাগাতে চেয়েছে মাত্র। গরীবের জীবন ও অর্থকষ্টের যন্ত্রণা তাদের কারও অজানা ছিল না। তাই তারা সাধারণ মানুষের জন্যে কাজ করার সিন্ধান্ত নেন। বরিন্সলার পড়াশুনা শেষ সুতরাং এবার তার দায়িত্ব গ্রহণের পালা। এবার মারি মেডিক্যাল পড়তে প্যারিস আসতে পারবেন। মারি যেন বোনের কাছে থেকে ভার্সিটিতে পড়াশুনা করেন বরিন্সলা এমনটাই চেয়েছিল কিন্তু মারি তাতে রাজি হলো না।  তাই বোনের কাছে মারি চিঠি লেখে যে: “ বাবাকে  একা ফেলে আমি কিছুতেই আসতে পারবো না। তোমরা সবাই বাবার কাছ থেকে একে একে দূরে সরে গেছ এবং নিজেদের জীবন গড়ে নিয়েছ। আমিই একমাত্র যে বাবার কাছে এখনো আছি। আমি চলে গেলে বাবা একেবারে একা হয়ে যাবেন।“ মেয়ের এমন চিঠিতে মারির বাবা অনেক খুশি হলেন কিন্তু তিনিও চান মারি যেন পড়াশুনার জন্যে প্যারিসে চলে যায়। তিনি মেয়েকে বলেন, তুই ভাই বোনদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী, তাহলে তুই কেন ঘরে পিতার কন্যা হয়ে ঘরে বসে থাকবি? অবশেষে মারি পড়ার জন্যে রাজি হলেন। অবশেষে ১৮৯১ সালে পিতার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে মারি প্যারিসের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠে পড়েলন। ট্রেনে করে ওয়ারশ থেকে প্যারিসে যেতে সময় লাগতো ৪৮ ঘণ্টা! মারি সস্তায় একটি টিকিট কেটে নিলেন এবং সারা পথ পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান পড়ে সময় কাটিয়ে দিলেন।

প্যারিসকে বলা হতো আলোর নগরী! কারণ প্যারিসে বেশ দ্রুত সময়ে বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয় এবং রাত হলেই প্যারিসের রাস্তায় বাতি জ্বলে উঠতো। ফলে অন্য শহরগুলোর তুলনায় প্যারিসের নাম-ডাক বেশি ছিল ও অনন্য। প্যারিসের সরবোন ভার্সিটি ছিল বিখ্যাত ভার্সিটির একটি আর সেখানেই মারি পড়তে আসলেন। সারা পৃথিবীর শিক্ষার্থীরা এই ভার্সিটিতে পড়ার জন্যে উদগ্রীব ছিল। এছাড়া রাজনীতি, চাকরি, বসবাস সব কিছু এই প্যারিসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সে সময় সরবোন ভার্সিটিতে প্রায় ২০০০ ছাত্র আর তার বিপরীতে ২৩ জন মেয়ে পড়াশুনা করতেন! মেয়েদের মধ্যে সব সময় একটা ভয় কাজ করতো যে; তারা কখনো ভার্সিটির অধ্যাপক হতে পারবে না। মারি পদার্থ বিজ্ঞানে পড়ার জন্যে আবেদন করলেন এবং নিজের নাম দল করে Marya থেকে ফরাসি নাম Marie রাখল।

প্রথম দিকে মারি তার বোনের বাসায় উঠলেন। সেখানে অনেক মানুষের সাথে মারির আলাপ হল, মারিও বেশ চমৎকার সময় কাটালেন। কিন্তু মারির দরকার নীরব পরিবেশ যেখানে তিনি সারা দিন ধরে বই পড়তে পারবেন। তাই মারি বোনের বাসা ছাড়ার সিন্ধান্ত নিলেন। মারি ভার্সিটির কাছে সস্তায় একটা রুম ভাড়া নিলেন। মারির ঘরে একটা বিছানা, একটা টেবিল ও চেয়ার ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না।  বাসা ভাড়া দেওয়ার পর সারা মাস খাওয়ার জন্যে মারির কাছে তেমন কোন অর্থ অবশিষ্ট নেই! মারি রান্না করতে জানতেন না, এমনকি ২৩ বছর পর্যন্ত স্যুপ বানাতেও পারতেন না। মারি যে ঘরটি ভাড়া নিয়েছিল, সেখানে পানির কোন ব্যবস্থা ছিল না, তাই প্রতিবার বাহির থেকে পানি আনতে হতো। এছাড়া মারির রুমটি শীতে প্রায় বরফ সমান ঠাণ্ডা হয়ে যেত। তাই ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্যে মারি চেয়ারের উপর ঘরের সকল জামা-কাপড় পড়ে বসে থাকতেন। তারপরও মারি খুশি ছিলেন! কারণ বই পড়ার জন্যে মারি ঘরে অনেক সময় পেতেন, অন্যদিকে ভার্সিটিতে বিভিন্ন গবেষণা করার সুযোগ তো ছিলই। সন্ধ্যার দিকে মারি লাইব্রেরিতে পড়তে চলে যেত কারণ তখন ঘর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যেত। রাত ১০ টায় লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার পর মারি ঘরে এসে এই ঠাণ্ডার মধ্যেও রাত ২টা পর্যন্ত পড়াশুনা চালিয়ে যেতেন। মারি খাবার ছিল রুটি, ফল, কখনো কখনো পনির কিংবা চকলেট। মারি একবার লাইব্রেরিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। লাইব্রেরিতে থাকা এক পোলিশ ছাত্র মারিকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তার বোনকে মারির সংবাদ জানান। সংবাদ শুনে বড় বোনের জামাই মারিকে দেখতে ছুটে আসেন এবং মারির ঘরে এসে তিনি শুধু একটা চায়ের টি-ব্যগ ছাড়া আর কোন খাবার দেখে নাই! তাই মারিকে জিজ্ঞেস করলেন;  তুমি আজকে সারাদিনে কী খেয়েছিলে? উত্তরে মারি বললেন; কিছু চেরি ফল আর একটা রুটি। দুলাভাইয়ের বুঝতে বাকি রইল না কেন মারি অজ্ঞান হয়ে লাইব্রেরিতে পড়ে গিয়েছিলেন। দুলাভাই মারিকে নিজেদের বাসায় নিয়ে গেলেন এবং  ভাল মতন যত্ন করেন। কিন্তু মারি খুব দ্রুত ভার্সিটিতে ফিরে আসেন কারণ মারি কোন লেকচার মিস করতে রাজি নন।

পোল্যান্ডে থাকা অবস্থায় মারি ফরাসি ভাষা শিখেছেন কিন্তু ততোটা ভাল বুঝতেন না। তবে এখন যেহেতু ফ্রান্সেই আছে সেহেতু ফরাসি ভাষাটি শেখার চমৎকার সুযোগ আছে। মারি ফরাসি ভাষায় পদার্থ ও রসায়নের বইগুলো পড়া শুরু করলেন। ভার্সিটিতে পৃথিবীর সেরা অধ্যাপকদের কয়েকজন শিক্ষকতা করতেন, তাদের মধ্যে একজন ছিল গাব্রিয়েল লিপমান (Gabriel Lippmann)। আলোকচিত্র থেকে ছবির রংসমূহ পুনরুৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। মারি মন্ত্রমুগ্ধের মতন তার লেকচার শুনতেন। মারির জীবন বলতে, ক্লাশ, লাইব্রেরি আর বই। মাঝে মধ্যে লাইব্রেরি যাবার সময় ক্যাফেতে ঢু মারতেন। আর এই কারণে তার সহপাঠীরা অনেকে মারিকে নিয়ে কথা বললেও কিন্তু মারির পোলিশ সহপাঠীরা সবসময় মারিকে সাপোর্ট দিত। মাঝে মধ্যে ছেলেরা মারিকে দেখে বলতো; মারি কিছুক্ষণের জন্যে বই, পড়ালেখা ভুলে আমাদের সাথে আড্ডা দিতে পার। বইয়ের জগৎ ভুলে আমাদের সাথে একটু ওয়াইনও খেতে পার। কিন্তু অন্যসহপাঠীরা ছেলেদের এসব ইয়ার্কি-তামাশা বন্ধ করতে এগিয়ে আসতেন।

এভাবেই মারির দিন চলে যাচ্ছিল। পরীক্ষার দিন মারি বেশ নার্ভাস ছিল। কারণ পরীক্ষার প্রশ্নগুলো সে ভালো ভাবে বুঝতে পারছিলেন না। যদিও সে পরীক্ষায় ভাল করার জন্যে পরিশ্রম কম করেননি। মারি কিছুক্ষন সময় নিয়ে এক গভীর শ্বাস নিল এবং পরীক্ষার খাতায় লেখা শুরু করল। পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন এক লোক রেজাল্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির হলেন এবং রেজাল্ট ঘোষণা করলেন। রেজাল্টের তালিকায় সবার উপরের নামটি Marie Skoldowska। রেজাল্ট ঘোষণাকারী যখন মারি স্কলডোস্কা নাম ঘোষণা করলো তখন সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কে এই মেয়ে! মারিকে ঐ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থের সবচেয়ে ভাল শিক্ষার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রেজাল্ট শুনে মারি নীরবে হলের বাহিরে বেরিয়ে এলেন।  হাজার খানেক  মেধাবী ছেলের মধ্যে মারি সবচেয়ে ভাল নাম্বার পেয়েছে এটা ছিল সবার কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। এমন সাফল্যের পর গ্রীষ্মের ছুটিতে মারি বাবার কাছে পোল্যান্ড বেড়াতে আসেন। তবে ভার্সিটিতে আবার দ্রুত ফিরে যাওয়ার কথা মারি ভুলে যাননি। তবুও আবার সরবোনে ফিরে আসতে ইতস্ততঃবোধ কাজ করছিলেন কারণ তাঁকে আবারও নিজের মতন করে একটি রুম ভাড়া নিতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে। আর এই খরচ কীভাবে আসবে সেটাও একটা চিন্তার বিষয়।

চলবে… (চার পর্বে সমাপ্য)

One comment

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.