মারি ক্যুরি এর জীবন ও সংগ্রাম, পর্ব ২

প্রথম পর্ব: মারি ক্যুরি এর জীবন ও সংগ্রাম, পর্ব ১

৫.

১৯৮৪ সালে দিকে মারি সবেমাত্র গভীরভাবে তাঁর গবেষণার কাজ শুরু করেছেন। সে সময় প্যারিসে এক পোলিশ অধ্যাপকের সাথে মারির পরিচয় হয়। এর কয়েকদিনের মধ্যে মারি একটি সংস্থা থেকে বিভিন্ন পদার্থের চৌম্বকের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে আমন্ত্রণ পান। এই কাজে মারির যোগ দেওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে তিনি দ্বিধান্বিত ছিলেন। তাই তিনি অধ্যাপকের কাছে মতামত জানতে চান। অধ্যাপক তাঁকে যোগ দেওয়ার পক্ষে মত দেন। কারণ এই কাজে মারির বেশ ভাল বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদিও ১১ শতকে চুম্বকের ধর্ম নিয়ে ইতোমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে; চুম্বক হল এমন বস্তু যা বিশেষ আকর্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন। চুম্বকের এই ক্ষমতাকে চুম্বকত্ব বলা হয়। চুম্বকের চুম্বকত্বের কারণে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। এই চৌম্বকক্ষেত্র অদৃশ্য কিন্তু এর মাধ্যমেই চুম্বকের প্রায় সব ধর্ম প্রকাশ পায়; এটি একটি বল যা তার চারপাশের ফেরোচৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং অন্য চুম্বককে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে। প্রথম স্থায়ী চুম্বক তৈরি করা হয়েছিল ইস্পাত দিয়ে। তবে এখন মারি চুম্বক নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা করার সুযোগ পেলেন। তবে সমস্যা বাঁধল ল্যাবরেটরি নিয়ে! মারির একটি বড়সড় ল্যাবরেটরি দরকার যেখানে তিনি নিজের মতন করে গবেষণা করতে পারবেন।

সমস্যার কথা শুনে অধ্যাপক মারিকে এক তরুণ গবেষকের কথা বললেন, যার ল্যাবরেটরিতে মারি হয়তো কাজ করার সুযোগ পেতে পারেন। তরুণ অধ্যাপক আর কেউ নয় তিনি মারির ভবিষ্যৎ প্রেমিক ও স্বামী বিজ্ঞানী পিয়ের ক্যুরি। পিয়ের পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। অধ্যাপক মারিকে বললেন-সামনের শুক্রবারে আমার বাসায় চলে আস, সেখানে আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হল, তখন পিয়েরের সাথে এই বিষয়ে আলাপ করলে। মারি ডিনারের দাওয়াত  সানন্দে গ্রহণ করলেন।

অধ্যাপকের বাড়িতে পিয়েরের সাথে কথা বলে মারি বেশ খুশি। কারণ পিয়েরের সাথে মারি ইতোমধ্যে ল্যাবরেটরির বিষয় ও রাসায়নিক গবেষণা নিয়ে আলাপ করার সুযোগ হয়েছে। পিয়ের সানন্দে মারিকে সাহায্য করার জন্যে রাজি হলেন। পিয়েরের স্কুলে যে ল্যাবরেটরি আছে সেখানে মারি ইচ্ছেমত গবেষণা করার সুযোগ পাবেন। মজার বিষয় হচ্ছে, মারি তখনও জানতেন না যে; এই তরুণ গবেষক ইতোমধ্যে ফ্রান্স ও ফ্রান্সের বাহিরে তাঁর আবিষ্কার ও গবেষণার জন্যে বেশ সুপরিচিত! অন্যদিকে বিজ্ঞান ম্যাগাজিনে লেখার কারণে তার জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। অন্য দেশের গবেষকরা পিয়েরকে একজন জিনিয়াস মনে করলেও, পিয়ের তাঁর সামান্য বেতনের শিক্ষকতা নিয়েই খুশি ছিলেন। অর্থ কামানোর দিকে পিয়ের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। কারণ গবেষণা করে ধনী হওয়া পিয়েরের মূল্যবোধের বিপরীতে ছিল। পিয়ের বলতেন; জীবন হল স্বপ্নের মতন, তাই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত কর। পিয়ের বড় গবেষক হতে চেয়েছেন যাতে মানুষের উপকার করতে পারেন এবং একটি সুন্দর সমাজ গড়তে অবদান রাখতে পারেন।

যারা “তারে জামিন পার” সিনেমাটি দেখেছেন তারা জানেন সিনেমার মূল চরিত্র ঈশান আওয়াস্তি ডিস্‌লেক্সিক রোগের কারণে কোন কিছু পড়তে কিংবা বানান করতে পারে না। অক্ষরগুলো তার চোখের সামনে নেচে বেড়ায়। ছোট বেলায় ডিস্‌লেক্সিক রোগে পিয়েরও আক্রান্ত হন। আর এই কারণে পড়তে ও লিখতে পিয়েরের বেশ সমস্যা হতো! যেমন: d তাঁর কাছে b হয়ে যেত! পিয়ের বয়স যখন ১৪ বছর তখন তার পরিবার তাঁর জন্যে একজন প্রাইভেট শিক্ষকের ব্যবস্থা করেন। গৃহশিক্ষক বুঝতে পেরেছিলেন যে, পিয়ের ছাত্র হিসেবে খুবই মেধাবী এবং গণিতে তার বিশেষ দক্ষতা আছে। পিয়ারের শিক্ষককে ধন্যবাদ যিনি পিয়েরকে সর্বণে (Sorbonne) তে নিয়ে আসেন। ১৮ বছর বয়সে পিয়ের বিজ্ঞান পরীক্ষা সমাপ্ত করেন এবং সর্বণ ভার্সিটির ল্যাবরেটরির চাকুরীতে যোগদান করেন।

মারি ও পিয়েরের মধ্যে খুব দ্রুত সম্পর্ক জমে উঠার কারণ- তাদের দুইজনের আগ্রহ ও গবেষণার বিষয়-বস্তু প্রায় এক। তারা একসাথে প্রচুর পড়াশুনা করতেন, পাশাপাশি তারা পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে (রাজনৈতিক আন্দোলন) সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে ভুলতেন না। কারণ, তারা দুজনই এমন পরিবার থেকে এসেছে যে; যেখানে মানুষের  অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। মারির বাবা ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি, যিনি পোল্যান্ডে রাশিয়ান রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবসময় অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে পিয়ের পিতা রাজকীয় সাম্রাজ্যের বিপরীতে রাষ্ট্র বিপ্লবে বিশ্বাস রাখতেন। পিয়ের পিতা ছিলেন ডাক্তার। ১৮৭০ সালের দিকে তাঁর বাসা মূলত হাসপাতালে পরিণত হয়। কারণ যারা রাজতন্ত্রের সৈন্যদের সাথে রক্তাক্ত-যুদ্ধে আহত হতেন তিনি তাদের চিকিৎসা দিতেন।

পিয়ারের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ মারি কখনো ভুলেননি। তাই তো মারি তার ডায়রিতে লেখেন যে; ”ঐ দিন পিয়েরকে খুব তরুণ দেখাচ্ছিল! যদিও পিয়েরের বয়স ইতোমধ্যে ৩৫ বছর। আমি তার কথায় বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। কারণ তার কথাবলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ না হয়েও উপায় নেই। শুরুতে স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। তবে তাঁর হাসি ছিল মারাত্মক সুন্দর।” তবে প্রথমে দুইজনে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা কখনো বিয়ে করবেন না! কারণ মারি ইতোমধ্যে প্রথম প্রেমিক কাজিমিয়েরজ থেকে যে আঘাত পেয়েছেন, যার ক্ষত এখনো যায়নি। জেনে রাখা ভাল কাজিমিয়েরজ জোরাভস্কির যিনি পরবর্তীতে একজন বিখ্যাত গণিতবিদ হয়েছিলেন। অন্যদিকে পিয়ের একটি মেয়ের সাথে ভালোবাসায় জড়িয়েছিল কিন্তু মেয়েটি রহস্যজনক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন। যার কোন সমাধান কেউ করতে পারেনি। এই কারণে পিয়ের ঐ মৃত্যুর জন্যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি। এছাড়া মারি ও পিয়েরের স্বপ্নই ছিল মানুষের উপকার করার জন্যে বড় গবেষক হওয়া এবং বিজ্ঞানের প্রতি তাদের দুইজনেরই ভালোবাসা ছিল। আর এই কারণে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎই তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

পিয়ের মারিকে ভালোবেসে ফেলে। ভালোবাসার মূল কারণ; মারি এমন একটা মেয়ে যার সাথে সবকিছু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা যায়। এছাড়া মারি খুবই মনযোগী শ্রোতা এবং যখন কোন প্রশ্ন করে তখন তার মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। মারিও পিয়েরকে পছন্দ করে কিন্তু মারি পোল্যান্ডের ফিরে যেতে চান। এছাড়া ফরাসীকে বিয়ে করারও তাঁর কোন পরিকল্পনা নেই। তবে সে পিয়েরের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ কারণ পিয়ের তাঁকে ল্যাবরেটরি ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। মারি যখন গ্রীষ্মের ছুটিতে পোল্যান্ডের বেড়াতে আসেন তখন পিয়ের মারির কাছে একটার পর এক চিঠি লিখেছেন। পিয়ের মারিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন কিন্তু মারি পিয়েরকে না বলে দেন! এরপর পিয়ের মারিকে প্রস্তাব দেয় যে- ঠিক আছে; আমরা না হয় বিয়ে করব না তবে আমরা তো প্যারিসে একই ভবনে থাকতে পারি যাতে মাঝে-মধ্যে দুইজনে সাক্ষাৎ করতে পারি। মারি এই প্রস্তাবেও রাজি হয়নি। মারির মধ্যে সবসময় প্রিয়জন হারানোর ভয় কাজ করতো! কারণ ছোট বেলায় তিনি তাঁর বোন, মা’কে হারিয়েছেন। এছাড়া জীবনে প্রথম প্রেমিক কাজিমিয়েরজ যাকে সে বিয়ে করতে পারেননি। আর এই কারণে মারি আবারও ভয় পাচ্ছেন যে, একদিন হয়তো সে পিয়েরকেও হারিয়ে ফেলবেন। এছাড়া পোল্যান্ড ছেড়ে অন্য কোথাও স্থায়ী হওয়ার কোন পরিকল্পনা মারির ছিল না। অন্যদিকে পিয়ের মারি’কে বলে যে- ”তুমি যদি আমাকে বিয়ে কর তাহলে আমি পোল্যান্ডে স্থায়ী হতে রাজি আছি। পোলিশ ভাষা শিখে ওখানেই পদার্থ ও রসায়নের উপর শিক্ষকতা করবো।” মারি পিয়েরকে তাঁর ভয়ের কথা জানান। অন্যদিকে পিয়ের তাঁকে বিয়ে করার কথা বলেন। মারি নিজেও জানতেন যে, তিনি পিয়েরকে ভালোবাসেন কিন্তু ভালোবাসা আর সংসার করা দুইটা দুই জিনিষ। মারি তাঁর সিদ্ধান্ত জানানোর জন্যে কিছুদিন সময় নেন এবং শেষে মারি পিয়েরকে চিঠি লেখে যে- “আমি তোমাকে বিয়ে করে প্যারিসেই থাকবো। তোমাকে পোল্যান্ডে আসতে হবে না কারণ এখানে গবেষণার জন্যে এখানে কাজ পাওয়া সহজ নয়।”

৬.

মারি ও পিয়েরের বিয়েটা হয়েছিল একেবারে সাদামাটাভাবে। মারি পিয়েরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; সে কী তাঁর জন্যে একটি বিয়ে পোশাক বানিয়ে দেবে কিনা। যেমনটি মারি চেয়েছেন পিয়ের সূচিকর্ম জরি দিয়ে ঠিক তেমনটি বিয়ের পোশাক বানিয়ে দেন। মারি আসলে সাদামাটা একটা পোশাক চেয়েছেন, যেন তিনি ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময়ও সেটিকে ব্যবহার করতে পারেন। আর এর জন্যে কিছুটা কালো রঙের পোশাক সবচেয়ে মানানসই কারণ কাজ করার সময় পোশাক সহজেই নোংরা হয়ে যায়।

১৮৯৫ সালের জুলাই মাসে পিয়ের ও মারির বিয়ে হয়। বিয়েটা তারা প্যারিসের দক্ষিণে সেঅক্স (Sceaux) গ্রামে করেন, যেখানে পিয়েরের বাবা-মা বসবাস করতো। বিয়ের সময় মারির বয়স ছিল ২৮ আর পিয়েরের ৩৬। বিয়েতে তাদের মারির বাবা, বোন ও নিজের কাছের কিছু আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের দিনটা মারির জীবনে এক স্মরণীয় আনন্দঘন দিন ছিল। ঐদিন মারি তার নিজের নাম বদল করে মাদাম ক্যুরি রাখেন। পরবর্তীতে এই নামেই তিনি পরিচিতি পান। বিয়েতে বর-কনে উপহার হিসেবে একজোড়া সাইকেলও পান। বিয়ের দিন দুইজনে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। সে যুগে মেয়েদের সাইকেল চালানো খুব একটা স্বাভাবিকভাবে দেখা হতো না। শুধু যে পুরুষরা দেখত না তা নয়, মেয়েরাও ভাল চোখে দেখত না। কে কী ভাবছে তাদের নিয়ে এগুলো ভাবার সময় ছিল না। একদিন তো দুই জনে মিলে এতো বেশি সাইকেল চালিয়েছিলেন যে রাস্তা ও সময় দুটোই ভুলে অচেনা পথে চলে আসলেন। মারি তার ডায়রিতে লিখেছেন এভাবে; “আমরা যে পথে যাচ্ছিলাম সে পথে অনেক গুলো ঘোড়া ছিল। তাই ঘোড়াগুলোকে ছাড়িয়ে আমরা অনেক দূর সাইকেল চালাতে থাকি। যখন আমরা ফিরে আসছিলাম তখন ইতোমধ্যে রাত হয়ে গেছে। আকাশে চাঁদ উঠে গেছে। আর পথের গরুগুলো আমাদের দিকে বেশ অবাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে ছিল।”

প্যারিসে ফিরে এসে মারি ও পিয়ের তিন রুমের একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া নিলেন। তাঁরা খুব সাদাসিধা একটা বাসা চেয়েছেন! দরকার একটা বড় টেবিল, কয়েকটি চেয়ার ও শোয়ার জন্যে একটা খাট। লিভিং রুম ছিল তাঁদের অফিস ও কাজের জায়গা। তাঁরা সেখানেই বসেই নিজের পড়াশুনা করতেন।

বিয়ের পর পিয়ের তাঁর আগের শিক্ষকতার পেশাতেই আছে অন্যদিকে মারি তাঁর চুম্বকের উপর রিপোর্টের কাজ শেষ করায় আপাতত বেকার সময় কাটাচ্ছেন। মারি ল্যাবে কাজ করছেন, পাশাপাশি বাসার কাজ যেমন-বাসা পরিষ্কার, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করা, খাবার তৈরি করা ইত্যাদি করছেন। পিয়ের ও মারি দুইজনই একমত যে- এটা অন্যায় কারণ মারিকে দ্বিগুণ কাজ করতে হচ্ছে। এছাড়া মারি যেহেতু খাবার বানাতে খুব দক্ষ ছিল না তাই এক ঘণ্টা আগেই তাকে বাসায় গিয়ে খাবার তৈরি করতে হতো! মারি ভাবল, খাবার রান্না করার জন্যে খাবারের উপর তার পড়াশুনা করা উচিত। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। মারি খাবারের উপর কিছুটা পড়াশুনা শুরু করলেন। নিজের কাজের ডায়রিতেও খাবারের বিভিন্ন প্রস্তুতপ্রণালী লিখে রাখা শুরু করলেন।

প্রতিদিন মারি তাঁর বাজারের খাতা নিয়ে বের হতেন। সেখানে প্রতিদিনের খরচ সে টুকে রাখতেন। নতুন জামা-জুতা থেকে শুরু করে, সস্তা আপেলের দাম কোনটাই বাদ যেত না। মারিদের বিলাসিতা বলতে কিছু ছিল না। তবে মারি ফুল পছন্দ করতেন। তাই বিলাসিতা বলতে ঐ ফুল কেনা পর্যন্ত। মারিদের খাবারের টেবিলে সবসময় ফুল থাকতো। অর্থাভাব মারিদের কখনো পিছু ছাড়েনি। পিয়েরের সামান্য বেতনই তাদের একমাত্র ইনকাম ছিল। অন্যদিকে মারির গবেষণা শেষ হওয়ার ফলে তাঁর কোন ইনকাম ছিল না। মারি “বিজ্ঞান পুরস্কার” জেতার জন্যে দম লাগিয়ে পড়তে বসলেন। কারণ এই পুরষ্কারটা জিততে পারলে শিক্ষক হিসেবে চাকুরী পাওয়ার সুযোগ আছে। শেষ পর্যন্ত মারি প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করেন এবং মেয়েদের একটি স্কুলে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। মেয়েদের স্কুল হলেও পূর্বে সেখানে কোন নারী শিক্ষক ছিল না। মারি ছিলেন সেই স্কুলের প্রথম মহিলা শিক্ষক। স্কুলটি ছিল Sèvres  শহরে। মারি বাসা থেকে স্কুলে যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগতো। স্কুলে শিক্ষকতা চলাকালীন মারি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। মারি তাঁর প্রথম বাচ্চার আগমনে বেশ উৎফুল্ল ছিল। কিন্তু মারির শরীর খারাপ হতে শুরু করল! অন্যদিকে একই সময় পিয়েরের মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী।

৭.

মারি একটি ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে পড়লেন। ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার জন্যে তাঁকে একটা বিষয়ের উপর থিসিস এবং একটা একাডেমিক রিপোর্ট করতে হবে যা পূর্বে কেউ কখনো করেনি। যদি তার থিসিস গ্রহণ করা হয় তাহলেই সে পদার্থ বিজ্ঞানের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করতে পারবেন।

১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মারির প্রথম সন্তান ইরেনে (Irene) জন্মগ্রহণ করেন। স্বভাবিকভাবেই মারিকে এখন প্রচুর কাজ একসাথে করতে হচ্ছে। নিজের পড়া, কাজ, বাচ্চাকে দেখা থেকে শুরু করে হাজারো দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে এসে পড়েছে। একদিকে বাচ্চার দায়িত্ব অন্যদিকে গবেষণা। গবেষণা ছেড়ে দেওয়ার কোন ইচ্ছা মারির নেই। তখন আশ্চার্যভাবে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। পিয়েরের মা অনেকদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ায় পিয়েরের বাবা নাতনির দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন। সে সময় মা’য়ের পরিবর্তে কোন পুরুষ কিংবা নানা দায়িত্ব নেওয়া কোন স্বাভাবিক বিষয় ছিল না। কিন্তু মারির শ্বশুর কে কী ভাবল সে দিকে নজর না দিয়ে নাতনির দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। মারিরা বড় একটি বাড়ি ভাড়া করলেন যেন সবাই মিলে একসাথে থাকা যায়। দাদু সারাদিন নাতনিকে দেখ-ভাল করেন। অন্যদিকে নাতনিও দাদুকে পেয়ে ভীষণ খুশি। মারি এখন সপ্তাহে কয়েকদিন স্কুলে শিক্ষকতা করতে যান, অন্যদিনগুলোতে নিজের থিসিসের কাজ করেন। মারি একটি চ্যালেঞ্জিং থিসিসের জন্যে মুখিয়ে ছিল তাই সে নতুন একটা বিষয় থিসিসের জন্যে পছন্দ করে আর তা হল-রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তা।

৮.

১৯ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ক্রুক (William Crookes) ইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে কিছু জটিল পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। গবেষণায় তিনি কোন ধাতুর ঋণাত্মক এবং ধনাত্মক দুইটি প্রান্ত ব্যবহার করেন। যখন তিনি ধাতুর দুইটি প্রান্তকে পরস্পরের মুখোমুখি নিয়ে আসেন তখন দেখা যায় ধাতুর প্রান্ত দুইটির মাঝে স্ফুলিঙ্গ জন্ম নিচ্ছে এবং ধাতুর প্রান্তগুলোর মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি ধাতু দণ্ডের প্রতিটি প্রান্তের সাথে কাঁচের টিউব যুক্ত করে দেন এবং তার এক প্রান্ত ধনাত্মক চার্জ আর অন্য প্রান্তটি ঋণাত্মক চার্জ প্রাপ্ত হয়। এরপরে তিনি কাঁচের টিউব থেকে বায়ু বের করে টিউবটিকে সম্পূর্ণ বায়ু শূন্য করে ফেলেন। এবার যখন তিনি টিউবে বিদ্যুৎ সংযোগ করেন তখন টিউবের ভিতরে নীলচে-সবুজ আলোর আভা জ্বলে ওঠে। ক্রুক উজ্জ্বল এই আলোটির নাম দিলেন ক্যাথোড রে। অনেক বছর পরে ক্যাথোড আলোর রশ্মি ব্যবহৃত হবে টেলিভিশন সেট এবং কম্পিউটার স্ক্রিনের ফ্লোরোসেন্ট বাতিতে।

বিজ্ঞানী রন্টগেন তড়িৎক্ষরন নলে (discharge tube) 10-3mm পারদ চাপে বায়ুর মধ্যে তড়িৎরক্ষনের পরীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ করেন যে, নল থেকে কিছু দূরে অবস্থিত বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড আবৃত পর্দায় প্রতিপ্রভার সৃষ্টি হচ্ছে। পরে তিনি আবিষ্কার করেন যে, তড়িৎক্ষরন নল থেকে ক্যাথোড রশ্মি যখন নলের দেয়ালে পড়ে তখন এই রশ্মির উৎপত্তি হয়। তিনি এই রশ্মির নাম রাখেন এক্সরে রশ্মি বা এক্সরশ্মি। ভিলহেল্ম কনরাড রন্টগেন(জার্মান ভাষায় Wilhelm Conrad Röntgen ভিল্‌হেল্ম্‌ কন্‌রাট্‌ র‌্যন্ট্‌গ্‌ন্‌) (মার্চ ২৭, ১৮৪৫ – ফেব্রুয়ারি ১০, ১৯২৩) একজন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী যিনি পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার (১৯০১) লাভ করেন। তিনি এক্স রশ্মির আবিষ্কারক যাকে তার নামানুসারে রঞ্জন রশ্মিও বলা হয়। ২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পিওর অ্যান্ড কেমিস্ট্রি তার নামে ১১১তম মৌলের নামকরণ করে রন্টগেনিয়াম। ১৮৯৫ সালে তিনি সফলভাবে এক্সরে রশ্মি উদ্ভাবন করেন। একই বছর মারি ও পিয়ের ক্যুরি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন।

এক্সরে রশ্মি কীভাবে এতোটা শক্তিশালী হতে পারে এই প্রশ্নটা মারির মনে উদয় হল। আর এই কারণে মারি বিকিরণের উপর অঁতোয়ান অঁরি বেক্যরেল (ফরাসি: Antoine Henri Becquerel) সমস্ত লেখা পড়ে ফেললেন ১৮৯৬ সালে হেনরি বেকেরেল আবিষ্কার করেন যে- ইউরেনিয়াম লবণ একধরণের রশ্মি নিঃসরণ করে যাদের কোন কিছু ভেদ করার ক্ষমতা এক্স-রশ্মির সমতুল্য।  তিনি দেখান যে এই রশ্মিগুলো ফস্ফোরেসেন্সের মত নয়, বাইরের কোন শক্তির সাহায্য ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এরা নির্গত হয়। এই দুইটি আবিষ্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মারি ক্যুরি ইউরেনিয়াম রশ্মির উপর গবেষণা ও থিসিস লেখার সিন্ধান্ত নেন। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য মারি ক্যুরি ও পিয়েরে কুরির সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।

বিকিরণ পরিমাপ করার জন্যে মারি স্বামী পিয়ের ও দেবর জ্যাকের (Jacque) আবিষ্কার একটি ইলেকট্রোমিটার ব্যবহার করেন। যন্ত্রটিকে পিয়েরজ্যোবৈদ্যুতিক তরঙ্গ (Piezoelektricitet vågen)নামে ডাকা হতো। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে মারি আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম রশ্মি একটি নমুনার আশেপাশের বাতাসে তড়ি চালনা করেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি প্রথম যে বিষয় বুঝতে পারেন তা হচ্ছেঃ ইউরেনিয়াম যৌগ সমূহের কার্যকলাপ শুধুমাত্র এতে উপস্থিত ইউরেনিয়ামের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। তিনি হাইপোথিসিস দেন যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ একাধিক কণার সংঘর্ষের কারণ নয় বরং একটি পরমাণু নিজেই এর কারণ। প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী অণু অদৃশ্য; এই ধারণা ভুল প্রমাণে তাঁর হাইপোথিসিস গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তরঙ্গ ব্যাবহার করা সহজ ছিল না। অঁরি বেক্যরেল পূর্বে অনেকবার চেষ্টা করেও সফল হননি! কিন্তু মারি দমে যাওয়ার পাত্রী নন। তিন সপ্তাহের কঠোন পরিশ্রমের পর তরঙ্গ ব্যাবহারে মারি দক্ষ হয়ে উঠেন।

পরিমাপ যন্ত্রের উপরে রাখা আছে কৌণিকভাবে কাটা কাঁচের স্ফটিক এবং পরিমাপ যন্ত্রের দুই প্রান্তে চাপ প্রয়োগ করলে সেখানে স্বল্প মাত্রার বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। কাটা কাঁচের স্ফটিকের নিচে একটা প্লেট রাখা আছে আর সেই প্লেটের উপর কিছু হালকা ওজন সমৃদ্ধ পদার্থ। পদার্থের ওজন স্ফটিকের উপর চাপ দেয়। পদার্থের ওজন যত বেশি হয়, তত বেশি চাপ বাড়ে ফলে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। মারি ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণ মাপলেন স্ফটিকের সাথে তুলনা করে।

তিনি পরিমাপ করতে পারলেন উৎপাদিত বিদ্যুতের শক্তিমত্তা কতটা ছিল। তাকে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছিল কারণ পরিমাপক যন্ত্রটা এতটাই বেশি সংবেদনশীল ছিল সামান্য আঙুলের স্পর্শেও অনেক তারতম্য দেখা দেয়। মারি তেজস্ক্রিয়তার প্রবাহ থেকে ভারি বস্তু সরিয়ে নিলেন রবং আবার পূর্বের অবস্থানে আনলেন। ডান হাতে তিনি যখন বস্তুটি অপসারণ করছিলেন তখন হাতের দিকে খেয়াল করতে পারেন নি কারণ তাকে সব সময় গ্লাস প্লেটের উপর পতিত আলোক বিন্দুর উপর নিরবিচ্ছিন্ন মনোযোগ দিতে হচ্ছিল।   তাঁর  হাতে ধরা আছে একটা ঘড়ি। গ্লাস প্লেট থেকে বস্তুর ওজন সরিয়ে নিলে আলোর বিন্দু আগের অবস্থানে আসতে ঠিক কত সময় লাগে এটা জানা খুব জরুরী। পরিমাপ নেয়ার সময়েই তিনি বুঝতে পারলেন ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণ কতটা শক্তিশালী।

পিয়েরকে সাথে নিয়ে মেরি কুরি সবজির পুরনো বাক্স দিয়ে একটা কাপবোর্ড বানালেন। কাপবোর্ডের ছোট্ট প্রকোষ্ঠ বা চেম্বার তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করল। চেম্বারের মধ্যে তারা দুইটা ধাতব গোল প্লেট একটার পর আরেকটা কয়েক সেন্টিমিটার দুরত্বে স্থাপন করলেন। তেজস্ক্রিয়তা গবেষণার জন্য কিছু পদার্থকে মেরি কুরি নিচের প্লেটের উপর রেখে তারপর প্লেটে বিদ্যুৎ সংযোগ দিলেন। পরীক্ষার উদ্দেশ্য যদি নিচের প্লেটের পদার্থ থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ হয় তবে ধরে নেয়া যায় উপরের প্লেটে শক্তি সঞ্চয় হবে। নিচের প্লেটে বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে উপরের প্লেটে শক্তি সঞ্চয় হতে যে সময় লাগে মেরি কুরি সেটাকেই পরিমাপ করলেন। মেরি তেজস্ক্রিয়তার পরিমাপ নেয়ার সময় বর্ণনা করলেন, ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা বুঝতে হলে দুইটা ভিন্ন ভিন্ন খনিজ পদার্থের মধ্যে পারস্পারিক তুলনা করতে হবে। গবেষণার জন্য মেরি কুরি পৃথক খনিজ উপাদান তার স্কুলের রসায়ন শিক্ষক এবং প্যারিসের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম থেকে সংগ্রহ করলেন। এরপর ১৮৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেরি কুরি তার বিখ্যাত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ বের করার গবেষণা শুরু করলেন লিখে রাখতে লাগলএন পরীক্ষার ফলাফল।

যে কোন গবেষণায় একাগ্রতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন আবশ্যক। মারি তাঁর পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার কারণে তাঁর গবেষণায় সফল হয়েছে অথচ বেক্যরেলের (Antoine Henri Becquerel) মতন বিজ্ঞানী সফল হননি। ইতোমধ্যে মারি ইউরেনিয়াম ও তেজন্ত্রীয়তার উপর সিরিয়াস গবেষণার জন্যে নিজেকে প্রস্তুক করে নিয়েছেন। আর এই গবেষণায় তাঁর সঙ্গী হয়েছে জীবনসঙ্গী পিয়ের। বাতাসের অদৃশ্যে বিকিরণ প্রতিরোধ করতে মারি ও পিয়ের তাদের গবেষণার কক্ষটিতে কিছু পুরাতন উদ্ভিদ নিয়ে আসেন! এছাড়া তারা নিজেদের চেম্বারে দুই রাউন্ড ধাতু প্লেট  স্থাপন করেন।  প্লেটগুলোর মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার। পরীক্ষা করার জন্য নিচের প্লেটটিতে  মারি পাতলা এক স্তর রেখেছিলেন। এরপর প্লেটগুলোতে কারেন্টযুক্ত করেন।

৯.

মারি একটার পর একটা কঠিন উপাদানগুলোর (solid elements) উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তবে কোনটাই কোন রেডিয়েশন দিচ্ছিল না। শুধু খনিজ ইউরেনিয়াম এবং রৌপ্য-সাদা ধাতু থোরিয়াম ছাড়া। মারি বুঝতে পারলেন যে, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের মধ্যে থাকা পরমাণুতে কিছু একটা হচ্ছে।

ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি তিনি তখন আরও কতগুলো মৌলের সন্ধান শুরু করেন যারা তেজস্ক্রিয়তা দেয় এবং ১৮৯৮ সালে আবিষ্কার করেন যে থোরিয়ামে এই ধর্ম আছে। পিয়ের, মারির কাজে এতই আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে ১৮৯৮ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি কেলাসের উপর গবেষণা ছেড়ে মারির গবেষণায় সাহায্য শুরু করেন।

১৮৯৮ সালের ১৪ এপ্রিল ক্যুরিরা খুব আশাব্যঞ্জক ভাবে পিচব্লেন্ডের ১০০ গ্রামের একটি নমুনা পেয়েছিলেন এবং পেসল ও মর্টার দিয়ে একে চূর্ণ করেছিলেন। সেই সময়ে তাঁরা ধারনাও করতে পারেননি তাঁরা যা খুঁজছেন তা এত অল্প পরিমাণে রয়েছে যে তাঁদের পরবর্তীকালে এটার জন্য টনের পর টন খনিজ বিশ্লেষণ করতে হবে। ১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে ক্যুরি এবং তাঁর স্বামী যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন একটি মৌলের অস্তিত্ব ঘোষণা করেন যার নাম দেয়া হয় “পোলনিয়াম”, ক্যুরির জন্মস্থান পোল্যান্ডের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই নাম দিয়েছিলেন।

পোলোনিয়াম নিষ্কাশনে সফলতা লাভের পর তারা এই অন্য অংশটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। তারা বুঝতে পারছিলেন যে- অজানা অন্য একটি তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কৃত হয়ে যেতে পারে। ১৮৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তারা এই নতুন মৌলটি আবিষ্কার করেন। বোহেমীয় খনি থেকে প্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের অবশেষ নিয়ে কুরির নেতৃত্বে গবেষকদল তাদের সরঞ্জামহীন গবেষণাগারে দীর্ঘ ৪৫ মাস কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। ক্যুরিরা নতুন মৌলের নাম দিয়েছিলেন “রেডিয়াম”, এই শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘’রে”  থেকে। তাঁদের গবেষণা চালাতে চালাতেই তাঁরা ‘’তেজস্ক্রিয়তা’ শব্দটি প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁদের আবিষ্কারকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠানোর জন্য তাঁরা পোলনিয়াম এবং রেডিয়াম বিশুদ্ধ আকারে পাওয়ার চেষ্টা করেন। পিচব্লেন্ড হচ্ছে একটি জটিল খনিজ; এর গঠন উপাদানগুলো রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন।

গবেষণার জন্যে মারিদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল একটি বড়সড় ল্যাবরেটরি। পিয়ের তাঁর স্কুলের হেডমাস্টারকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি এই ব্যাপারে তাঁদের কোন সাহায্য করতে পারবেন কিনা। স্কুলে জরাজীর্ণ এক পরিত্যক্ত বড় চালাঘর ছিল। হেডমাস্টার সেই ঘরটি তাদের ল্যাবরেটরি বানানোর অনুমতি দেন। ঘরের পরিবেশ তেমন ভাল ছিল না! বিশেষ করে গরমে প্রচণ্ড গরম, আর শীতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। এছাড়া ঠাণ্ডা বাতাসের যন্ত্রণা তো আছেই। কিন্তু মারিরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যতদিন পর্যন্ত বড়সড় ভাল কোন ল্যাবরেটরি না হচ্ছে ততদিন এই ঘরটি তারা গবেষণার কাজে ব্যবহার করবে। তবে এতো বাজে পরিবেশেও তাদের কাজের গতি কখনো কমেনি। বরং ঘরটি পেয়ে দুইজনেই বেশ খুশি ছিল কারণ তাঁরা তাঁদের অবসর সময়টুকু এখানে এসে গবেষণার কাজে লাগাতে পারছে।

সমস্যার শেষ নেই! মারি ও পিয়ের পিচব্লেন্ডের উপর কাজ করছেন। সুতরাং তার জন্যে তাদের কয়েক টর পিচব্লেন্ডের প্রয়োজন। এছাড়া সস্তা দামে এগুলো কেনাও যায় না। অস্ট্রিয়াতে একটি খনিতে পিচব্লেন্ড পাওয়া যাচ্ছিল, খনি  থেকে ইউরেনিয়াম লবণ বের করে নেওয়া পর পর ফেলে দেয়া হয় মহামূল্যবান পিচব্লেন্ড। পিয়ের অনুরোধে সেই অকেজো ইউরেনিয়াম থেকে ১ টন পিচব্লেন্ড কয়লা বিনামূল্যে দিয়ে দেওয়া হল। কারণ যেখানে এটিকে আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেওয়া হতো। রাত নেই দিন নেই মারি ও পিয়ের শুধু কাজ করতে লাগলেন। প্রদীপ দেব তার লেখার ঘটনাটি বর্ণনা করছেন এভাবে- “এক খাবলি পিচব্লেন্ড নিয়ে সোডার দ্রবণ মিশিয়ে সিন্ধ করার পর পানিতে অদ্রবণীয় ও দ্রবণীয় অংশ পৃথক করেন। পরে অদ্রবণীয় অংশকে এসিডের দ্রবীভূত করার পর বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থে মিশিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে একটার পর একটা আলাদা করে ফেলে দেন। এইভাবে দিনের পর দিন বিরামহীন মিশ্রণ, দ্রবীভূত করণ, তাপন, ছ্যঁকন, বিশুদ্ধিকরণ চলতে থাকলেন। যে কোন মৌল পৃথক করার পর পিয়ের তাঁর ইলেকট্রোমিটারে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা মেপে দেখেন। পরীক্ষণীয় পিচব্লেন্ডের অবশেষ যতই কমতে থাকে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা তাতোই বাড়তে থাকে। বস্তা বস্তা পীচব্লেন্ড ছেঁকে তাঁরা বিন্দু বিন্দু রেডিয়াম সংগ্রহ করতে লাগলেন। ১৯৯ সালে শুরু করেছিলেন তাঁরা। ১৯০২ সালে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মাস পরে কুরি দম্পতি এক গ্রামের এক দশমাংশ পরিমাণ বিশুদ্ধ রেডিয়াম সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন এই অত্যাশ্চর্য শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় পদার্থের আবিষ্কারে। রেডিয়ামের উজ্জ্বল নীলাভ আলোর মতোই আলোকিত হয়ে উঠলেন কুরী ও মাদাম মেরি কুরি।”

১৯০৪ সালের মারির দ্বিতীয় কন্যা ইভের জন্ম গ্রহণ করেন। পয়সা উপার্জনের জন্যে মারিকে স্কুলে শিক্ষকতা করতে হতো। এরপর পিয়েরের সাথে গবেষণা অন্যদিকে বাসা ও বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্বটা পুরোটাই মারির ঘাড়ে। সুতরাং ব্যক্তি জীবনে মারির দম ফেলার সময় ছিল না। অনেক সময় পিয়ের অভিযোগ করতো যে, মারি ইভের সাথে অতিরিক্ত সময় কাটাচ্ছে! কারণ গবেষণায় মারির পূর্ণ মনোযোগ ও মারি যেন বেশি করে সময় দেয় তা ছিল পিয়েরের ইচ্ছা। মারি সব-সময় তাঁর সাথে একটি নোট বই রাখতো। যেখানে ইভেরের প্রতিটি মুহূর্তের কথাও টুকে রাখা হতো। যেমন- কবে সে হেসেছিল, কবে হামাগুড়ি দিয়েছিল কিংবা কবে প্রথম দাঁত উঠেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। পিয়ের বাচ্চাদের সাথে তেমন সময় দিত না, অন্যদিকে মারি যেন একজন পূর্ণ গবেষক হয় তিনি তা চাইতেন।

(এই পর্বে অনুবাদের সুবিধার্থে অনেক জায়গায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার নাম, সংজ্ঞা কিছু ঘটনা সরাসরি উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে অনেক সময় মূল বইয়ের বাহিরে গিয়ে কিছু বক্তব্য যুক্ত করা হয়েছে।)

One comment

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.