
বাংলাদেশে প্রবাসীকে দুইভাবে ভাগ করা হয়-মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রবাসী , মানে ইউরোপ আমেরিকার প্রবাসী। গত কয়েকদিন ধরে ইতালির প্রবাসীদের উপর মানুষের বেশ ক্ষোভ, ঘৃণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার মূল কারণ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস তাদের হাত ধরে দেশে প্রবেশ করেছে। কথা সত্য করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়নি বরং অন্য দেশের মতন আমাদের দেশেও বিদেশ ফেরত মানুষের হাত ধরে এই ভাইরাস দেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু মানুষ যেভাবে প্রবাসীদের দেশে আসার জন্যে প্রবাসীদের গালাগাল করছে তা কিছুটা অদ্ভুত এবং বোধহীনও বটে।
প্রথমত একটা কথা আমাদের জানা প্রয়োজন তাহলো; ইউরোপের প্রবাসী মানেই সবার গ্রিন কার্ড আছে কিংবা সবাই খুব ফুলটাইম বৈধভাবে কাজ করে তা নয়। ইতালির মতন দেশে প্রচুর মানুষ আছে যাদের বৈধ কাগজ নেই, কেউবা কাজ করে অবৈধভাবে কিংবা কেউবা পার্টটাইম কাজ করে একটা বাসায় অনেকের সাথে শেয়ার করে সেখানে থাকে। করোনার এই সময় যেহেতু সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে ফলে অনেক মানুষের কাজ-কামের পথ বন্ধ। এখানকার নাগরিকরা যেসব অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে তা কখনো অন্যরা পাবে না যদি সে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক না হয়।
বাংলাদেশ এমন কোন রাষ্ট্র নয় যেখানে মানুষ চিকিৎসার জন্যে ছুটে যাবে। উল্টো বাংলাদেশে পয়সা দিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। আমার নিজের একজন পরিচিত মানুষ আছেন যিনি ইতালিতে সামারের সময় কাজ করেন অন্যসময় কাজ থাকে না বিধায় দেশে চলে যান। তবে দেশে তিনি বলে বেড়ান; তিনি শুধু চার-পাঁচ মাস কাজ করেন অন্য সময় দেশে থাকতে পছন্দ করেন। তো, বাংলাদেশে যে মানুষগুলোকে গালাগাল করা হচ্ছে এদের বেশির ভাগই করোনা থেকে বাঁচতে দেশে যাননি, বরং গিয়েছে অর্থনৈতিক কষ্ট থেকে বাঁচতে। অনেকের হয়তো ইতালিতে ভাল একটা দোকান আছে কিন্তু এখন সব বন্ধ সেহেতু দেশে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে সে লাভবান হবে। কিন্তু যেহেতু ইউরোপের মতন একটা দেশে কাজ করে সেহেতু এই অর্থনৈতিক ক্ষতির সত্যটা এরা আপনজনকেও বলবে না। আমার পরিচিত কয়েকটি পরিবার ইউরোপে থাকে। এরা কেউ পরিবার নিয়ে দেশে চলে যায়নি এমনকি চিন্তাও করেনি কারণ তাদের এখানকার নাগরিক। আর যদি কেউ প্রাণ বাঁচাতেও দেশে চলে আসে সেখানে দোষের কী আছে? যুদ্ধের সময় কিংবা ঢাকায় যদি মহামারি কিছু ঘটে তাহলে তো শহরের লোকজন গ্রামে চলে যাবে। তখন কী গ্রামের লোকদের বলা উচিত হবে; কাজের জন্যে ঢাকায় গিয়ে এখন প্রাণ বাঁচাতে গ্রামে ভাগলে কেন? নাকি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে তাদের প্রথম কর্তব্য?
হারারি তার একটা প্রবন্ধে উল্লেখ লিখেছেন; ফ্রান্সিসকো দ্য এগুইয়া নামের এক ব্যক্তি, যিনি গুটিবসন্তের বাহক ছিলেন- তিনি ১৫২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মেক্সিকোতে অবতরণ করলেন। মানে এই লোকটিই গুটিবসন্তের বাহক ছিলেন যা ফলে গুটিবসন্ত মহামারী আকারে হানা দিয়েছিল পুরো মধ্য-আমেরিকায়, প্রাণনাশ করেছিল আনুমানিক মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের। তো, এই প্রবাসীরা যখন আসল তাদের জন্যে বাংলাদেশ সরকার কী ব্যবস্থা করেছে এই প্রশ্নটা করার চাইতে সবচেয়ে সহজ গালাগাল করা। প্রবাসীরা রেমিটেন্স যোদ্ধা বলে আলাদা কোন সম্মান কিংবা টাইটেল দেওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করি না কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবার অবদান আছে এমনকি যে ভিক্ষা করে তাও। এয়ারপোর্টে সময় মতন ব্যাগ এবং একজন মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক আচরণ পেলেই মানুষ খুশি। বাংলাদেশে যারা ফিরে এসেছে তাদের সবাইকে মৌখিকভাবে বলে দিয়েছে বাড়িতে থাকার জন্যে। বাংলাদেশের যে কোন মানুষকেই জিজ্ঞেস করুন বিদেশ থেকে ফিরলে কীভাবে বাড়িতে থাকতে হবে মানে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে তা বিশদভাবে কেউ বলতে পারবে না। এয়ারপোর্টে কোন গাইড বুক দিয়েছে যে কীভাবে থাকতে হবে? না কিছুই দেয়নি মৌখিকভাবে কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েই সরকার দায়িত্ব শেষ করেছে। বিমানবন্দরে যে করোনা সনাক্তের মেশিনও ঠিক মতন ছিল না তা আমাদের অজানা নয়। সারা পৃথিবীতে যখন করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে এই তথ্যের পরও সরকার কোন প্রস্তুতি নেয়নি কারণ সরকার তখন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জন্মদিনের অনুষ্ঠান করেননি কিন্তু তার নামে রাজনীতি করার দলটি সারা পৃথিবী যখন করোনা ভাইরাসে দিশেহারা হাজার হাজার মানুষ যখন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে তখন পটাকা উৎসব করেছে। করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার জন্মদিনের উৎসব বাতিল করেছে নাকি করোনা ভাইরাসের কারণে বিদেশীরা নিজ দেশ ছেড়ে অন্য কোন দেশে যাওয়া বন্ধ করাতে অনুষ্ঠান বাতিল করেছে তাও এখন এক প্রশ্ন। কারণ করোনা ভাইরাসের কারণে অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়করা তাদের বৈদেশিক সফর বাতিল করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
প্রবাসীরা নিয়ম মানে না এটা অবশ্যই প্রবাসীদের দোষ তবে তাদের গাইড লাইন দেওয়া, তারা বের হলে যেন শাস্তি হয় এমন আইন প্রয়োগ করা তো সরকারের দায়িত্ব। সরকারের সমালোচনা করলে যেহেতু রাতের বেলায় তুলে নিয়ে যাওয়া কিংবা এলাকায় মাইর খাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেহেতু সব কিছুর জন্যে দোষ দেওয়া যেতে পারে প্রবাসীদের। যে সরকার নিজে করোনা বিস্তারের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি জেলায় জন্ম দিন পালন করে, নির্বাচন করে তো তাদের কথা এখন কে শুনবে কিংবা বিশ্বাস করতে চাইবে? বাংলাদেশে এর্ন্টাটিকা হুজুরের কথা যতো লোক বিশ্বাস করে তার থেকে কম লোক সরকারের কথা বিশ্বাস করে।
যদি প্রবাসীদের ঘাড়ে সব দোষ যদি দিয়েও দিই তারপরও কথা আসে আমাদের হাসপাতালে ডাক্তারদের নিরাপত্তার জন্যে সরকার কী দিয়েছে? উত্তর কিচ্ছু না। ডাক্তারের পেশা যেহেতু সেবা করা সেহেতু তার অন্য কোন জিনিসের দরকার নাই এমনকি নিরাপত্তারও দরকার নাই সে শুধু সেবা দিয়ে যাবে। তিন মাস সময় পাওয়ার পরও সরকার ডাক্তারদের জন্যে কোন জিনিসের জোগাড় করেনি এই হল আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা। রাষ্ট্র কোন ব্যক্তি নয় রাষ্ট্র হল কতোগুলো প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সিস্টেম। আমরা যেহেতু ব্যক্তি কেন্দ্রিক রাষ্ট্রে বাস করি সে কারণে সব কিছুতে আমাদের মমতাময়ী (!) প্রধানমন্ত্রীর গুণগান দিয়ে সব কিছুর সমাধান করি। করোনার মতন ভাইরাসের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে তেল দিয়ে আমাদের মন্ত্রীদের উদ্ভট কথাবার্তা বন্ধ নেই। কারণ মন্ত্রীরা শিখে গেছেন যে; তেল দিলেই হবে কোন কাজ করার দরকার নেই।
“প্রধানমন্ত্রী নামাজ পড়ে দিন শুরু করেন, করোনা আতঙ্ক হতে পারে না”-শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ বিষয়ক উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম।
“করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজনে চীনের মত হাসপাতাল বানানো হবে।”- মুস্তফা কামাল।
“শেখ হাসিনা আল্লাহওয়ালা মানুষ, করোনা কিছুই করবে না।”- শামিম ওসমান।
“করোনা ভয়ংকর শক্তিশালী, আমরা তার চেয়েও শক্তিশালী!”- ওবায়দুল কাদের।
“শেখ হাসিনার মত নেত্রী পাওয়ায় করোনা প্রতিরোধ করতে পারছি।”- মোহাম্মদ নাছিম।
“করোনা নিয়ে বিএনপি জামায়াত জনগনকে আতঙ্কিত করছে।”- হাছান মাহমুদ
“করোনা মারাত্মক রোগ নয়,এটা সর্দি-জ্বরের মত।”- আব্দুল মোমেন।
“আল্লাহ নিজে আসলেও কিছু করতে পারবেন না।”- জাহিদ ফারুক।
“করোনা প্রতিরোধে ঢাকা বিমানবন্দরের মত ব্যাবস্থা উন্নত দেশগুলোতেও নেই।”- শাহরিয়ার আলম।
“করোনা নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা,ইতালির চেয়েও বেশী সফল বাংলাদেশ।”- জাহিদ মালেক
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করা যেন মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে। ঐ টাকায় জনসেবা মূলক কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে। অথচ হয়েছে উল্টো! ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় জনগণকে বকুল ফুলের মালা দিয়ে বিয়ে দেওয়ার যিনি বলেছিলেন তিনি আবার নিজের ছেলেকে সোনার মুকুটে বিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ সেই বিয়ের কথা যেমনি ভুলেনি তেমনি পৃথিবীর এ খারাপ সময়ে জন্মদিনের পটাকাবাজি ভুলবে না। আর ভুলবেন না, ডেঙ্গু থেকে করোনা প্রতিটি মহামারিতে সরকারের নির্লিপ্ততা ও ভণ্ডামি।