বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তারে শুধু সাধারণ মানুষের অসচেতনতা দায়ী নয় সাথে আছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানতে ঘাড়ত্যাড়া বিশ্বাস। এবং এই ঘাড়ত্যাড়া বিশ্বাস সকল ধর্মের সকল দেশের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে সমানভাবে রয়েছে। কোথাও চার্চ, কোথাও মন্দির কিংবা কোথাও মসজিদ এই ত্যাড়ামী করছে। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের মতন দেশগুলো করোনার সংক্রমণ ঠ্যাকাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সীমিত-ভাবে খোলা রাখার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা আমাদের দেশে সম্ভব হয়নি। কারণ আমরা তাদের থেকে এক কাঠি বেশি ধর্মপ্রাণ। অর্থনৈতিক অভাবের ভয়ে মানুষ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় হয়, এখানে তার বের হওয়ার কারণ উপার্জন। অন্যদিকে ধর্মীয়ভাবে ঘাড় ত্যাড়া মানুষগুলোর বের হওয়ার মূল কারণ ধর্মীয় ভয়-ভীতি ও পরকালের লাভ লোকসান। খাবারের ব্যবস্থা করে সাধারণ মানুষগুলোকে ঘরে রাখা গেলেও ধর্মপ্রাণখ্যাত এই ঘাড়ত্যাড়াতের ঘরে রাখা সম্ভব না। বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম প্রধান দেশ সেহেতু আমাদের ধর্মীয় নেতাদের উপরই এই লেখা।।
প্রথমে জেনে নিই ইউকিপিডিয়াতে মুফতি সম্পর্কে কী বলা আছে; মুফতি (আরবি: مفتي) হলেন একজন ইসলামি পণ্ডিত যিনি ইসলামি আইনশাস্ত্রের বিশদ ব্যাখ্যা এবং ইসলামের আলোকে বিভিন্ন ফতোয়া প্রদান করেন।
একজন ব্যক্তি মুফতি হতে গেলে প্রধানত কয়েকটি ধাপে যোগ্য হতে হয় এবং এই যোগ্যতা ইসলামি পণ্ডিতদের দ্বার নিশ্চিতকৃত হতে হয়। তাকে নিন্মোক্ত জিনিসসমূহ জানতে হয় একা প্রমাণের জন্য যে সে ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য:
• আরবি ভাষায় অভিজ্ঞ
• কোরআন ও হাদিস শাস্ত্রে পারদর্শী
• উসুল আল ফিকহ শাস্ত্রের পারদর্শী
• সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন
ফেসবুকে গত কয়েক মাস ধরে মুফতি ইব্রাহিমকে নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করছেন। মুফতি ইব্রাহিম হলেন সেই ব্যক্তি যিনি এন্টার্কটিকা ও স্বপ্নে করোনার সাক্ষাৎকার (তার এক মুরিদ সেই ইন্টার্ভিউ নিয়েছিল) প্রচার করে জনপরিচিতি পান। তারই ভাতিজা অথবা ভাতিজা হল আরেক ওয়াজকারী তারেক মনোয়ার। তারেক মনোয়ার জামাতের হুজুর এবং সেই সাথে তার চাচার মতন সমান চাপাবাজ। তারেক মনোয়ার নাকি রাজাকার কাদের মোল্লা আর নবীজীকে একসাথে স্বপ্নে দেখেছেন। এরা বাংলাদেশের টেলিভিশনে ধর্মের কথা বলে, মানুষকে ধর্মীয় জ্ঞান দান করেন। পূর্বে এরা সবাই ইসলামিক টিভির বক্তা ছিলেন। জাকির নায়েকের পর এন্টার্কটিকা হুজুর মানে মুফতি ইব্রাহিম সবসময় বক্তৃতা করতো। চাপাবাজি, মিথ্যা, ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে শুধু মুফতি ইব্রাহিম আর তারেক মনোয়ার দোষী নয় এই দোষে বাংলাদেশের অধিকাংশ হুজুর দোষী। কারণ বাংলাদেশে ধর্মীয় ইসলামের চেহারায় আসলে পলিটিকাল ইসলাম কাজ করে যাচ্ছে।
এখন ইন্টারনেট কল্যাণে হয়তো এসব হুজুরদের সব কিছু প্রচার পাচ্ছে। অথচ মানুষকে মিথ্যায় বুদ করে রাখা কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় গুজব প্রচার করে নিজেদের এবং ধর্মের সম্মান বাড়ানোর কাজ অনেক পুরনো। মানুষ চাঁদে যাওয়ার পর সেখানে আজান শুনতে পাওয়া, চাঁদ দুই ভাগ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া, এসে বিজ্ঞানীদের মুসলিম হয়ে যাওয়া এগুলো আমরা ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি। সুতরাং হুজুরদের এসব অভ্যাস যে নতুন নয় তা সহজে বলা যায়। তারা এগুলো বলতে পারে কারণ তাদের যে শ্রোতা তারা সমাজের নিম্নবিত্তের ধর্মান্ধ মানুষজন। যারা কখনো কিছু ভেবে দেখে না শুধু শুনে বিশ্বাস করে যায়।
করোনা সমস্যায় আমাদের সরকারের যে উদাসীনতা তা পূর্বের লেখায় উল্লেখ করেছি তাই নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষকে যখন ধর্মীয়গুরুরা সাবধান করার কথা, সতর্ক করার কথা যেন সমাজে রোগ না ছড়ায় তখন তারা সমাজে করোনা জীবাণু বিস্তারের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে আর এর বৈধতার জন্যে তাদের কাছে আছে কোরান এবং হাদিস। আমি যেহেতু ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিত নই তাই আমি বলতে পারবো না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। কিন্তু এই দুর্দিনে হুজুররা যে বিভক্ত তা স্পষ্ট। এবং দুঃখের বিষয় এই বিভক্তের সংখ্যাগরিষ্ঠ হল তারা যারা বলে- ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি বলে কিছু নাই। আল্লামা শফি মতন অন্যরাও তা বিশ্বাস করে এই কারণে শফীরা বলছে করোনা থেকে বাঁচতে হলে মানুষের উচিত- পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদের জামাতে ও জুমায় শরিক হওয়া এবং আল্লাহর নিকট এ আজাব হতে মুক্তির জন্য দোয়া করা। অথচ ছয় মাস আগে ইন্ডিয়া গিয়ে শফি নিজে চিকিৎসা নিয়ে আসছে। তখন আল্লাহ উপর ভরসা করেন নি। অন্যদিকে সালাফিপন্থী আহলে হাদিস গ্রুপের ধর্মীয় লিডার আব্দুর রাজ্জাক জনসমাবেশে দলিল
করে বলছেন যে ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি বলে কিছু নাই। ইসলামে এটা বলা আছে কিনা আমি জানি না তবে যদি বলা থাকে তাহলে ইসলামের যে সীমাবদ্ধতা তা এখানে স্পষ্ট। করোনা একটা সংক্রামক ব্যাধি আর এই কারণে মানুষকে ঘরে বন্দি থাকতে বলা হয়।
আমাদের ওয়াজে শিক্ষিত ভদ্রলোক যান না কিন্তু তারা এগুলোর প্রতিবাদও করেন না। প্রতি নিয়ত মিথ্যা বক্তব্য ও গুজব প্রচারের ফলে একসময় এগুলো সত্যের মতন শোনায়। এটাই পৃথিবীর পুরাতন একটা গুজব প্রচারের পদ্ধতি। অন্যদিকে আমাদের মুফতি আমির হামজা আরেক কাঠি সরেস; তিনি জনসমাবেশে প্রকাশ্যে ঘোষণাই করেছে; কোন মুসলমানের যদি করোনা হয় তাহলে কোরান মিথ্যা হয়ে যাবে। কোরান যেহেতু সামনে এনে দাঁড় করালেন এবং তিনি যেহেতু মুফতি সেহেতু এটাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ওলামা লীগ ২২ মার্চ সমাবে করে বলেছে-ছোঁয়াচে রোগ বা সংক্রামক রোগ বলতে ইসলামে কিছু নেই। ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু আছে বলে বিশ্বাস করা হাদীস শরীফের খিলাফ। কারণ হাদীস শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি বলেন “সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু নেই”। ওলামা লীগের কতোটা নির্বোধ ও বদমাইশ একটা দল তা নিচের ছবিতে স্পষ্ট।


করোনায় মানুষ বাহিরে গিয়ে নামাজ পড়বে কিনা তা নিয়ে অনেকের হাদিস শেয়ার দিচ্ছে যেখানে বলা আছে যে মহামারি হলে জুম্মার নামাজও বন্ধ থাকতে পারবে। আবার ইসলাম সংক্রামক ব্যাধি আছে এমনটা স্বীকার করে নিচ্ছে। তবে মজার বিষয় হল হাদিসগুলো আবার আমরা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাই। তাই কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা বলা বেশ মুশকিল। আর এই কারণে সম্ভবত আমার ইয়ামেনে কলিগ বললেন; আমি হাদিস সেভাবে ফলো করি না কারণ যারা হাদিস বর্ণনা করেছেন তারা কেউ তো নবী ছিল না। এদের মধ্যে অনেকে মিথ্যা বলছে অনেকে স্বার্থের কারণে হাদিস বিকৃতি করেছে এই কারণে কোরানটাই ফলো করি। যাই হোক এটা ছিল তার বক্তব্য। তো, পাঠকের স্বার্থে নিচে হাদিসগুলো উল্লেখ করা হয় এবং বিভিন্ন মুফতির ও মানুষের যুক্তি যুক্ত করা হল।

১) ছোঁয়াচে রোগ বিশ্বাস করা কুফরী
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পেঁচা অশুভ নয়, ছোঁয়াচে রোগ নেই এবং কোন জিনিস অশুভ হওয়া ভিত্তিহীন। (আবু দাউদ, হাদিস নং: ৩৯২১, ৩৯১৬, ৩৯১২
হাদিসে আরো আছে- জাহিলী যুগের চারটি বৈশিষ্ট্যের একটি হচ্ছে ছোঁয়াচে রোগ সংক্রমিত হওয়ার ধারণা -(তিরমিযী, হাদিস নং: ১০০১)
আইয়ামে জাহেলিয়াতে ছফর মাসকে অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা হতো।
কোন রোগ ব্যাধিকে সংক্রামক এবং ছোঁয়াচে মনে করা, কোন নির্দিষ্ট মাস অথবা দিনকে অশুভ বা কুলক্ষণ মনে করাটা কুফরির অন্তর্ভুক্ত ! এ প্রসঙ্গে হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছেন আসুন একটু দেখি-
১। হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- “সংক্রামক বলতে কিছু নেই। তারকার ( উদয় বা অস্ত যাওয়ার) কারণে বৃষ্টি হওয়া ভিত্তিহীন এবং ছফর মাসে অশুভ বলতে কিছু নেই।” [ মুসলিম শরীফ – কিতাবুস সালাম – ৩২ নং অনুচ্ছেদ – হাদিস ৫৫৯৯]
২। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-“ যে কোন বিষয়কেই অশুভ ও কুলক্ষণে মনে করা শির্কের অন্তর্ভুক্ত। তিনি এ বাক্যটি তিনবার উল্লেখ করেছেন!” [মুসনাদে আহমদ ১ম খণ্ড ৪৩৮ পৃষ্ঠা]
৩। হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- “ছোঁয়াচে এবং অশুভ বলে কিছু নেই !” [মুসলিম – কিতাবুস সালাম -৩৩নং পরিচ্ছেদ-হাদিস ৫৬০৭ ]
৪। হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- “রোগ সংক্রমণ, কুলক্ষণ ও হামাহ বলে কিছু নেই এবং সফর মাসও অশুভ নয়।” [ইবনে মাজাহ]
৫। হযরত ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত হাদীসেও হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একই ধরনের বক্তব্য রয়েছে।-“রোগ সংক্রমণ, কুলক্ষণ ও হামাহ বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রসূল! কোনো উট চর্মরোগে আক্রান্ত হলে অন্য উট তার সংস্পর্শে এসে চর্ম রোগাক্রান্ত হয়। তখন তিনি বললেন, এটা তাক্বদীর! তা না হলে প্রথম উটটিকে কে চর্ম রোগাক্রান্ত করেছে?” [ইবনে মাজাহ]
৬। ‘রোগ-ব্যাধি (তার নিজস্ব ক্ষমতায়) একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে লেগে যায় না।’ [সহীহ মুসলিম, হাদিস : ৫৭৪২]
৭। হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন যে, হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “ছোঁয়াচে ব্যাধি, ক্ষুধা, পেট কামড়ানো কীট ও পাখির কুলক্ষণ বলে কোনো কিছু নেই। জনৈক বেদুঈন আরব জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রসূলুল্লাহ! তবে সেই উটপালের অবস্থা কি যা কোনো বালুকাময় প্রান্তরে অবস্থান করে এবং সুস্থ-সবল থাকে? অতঃপর তথায় কোনো খুজলী-পাঁচড়ায় আক্রান্ত উট তাদের মধ্যে এসে পড়ে এবং সবগুলোকে ঐ রোগে আক্রান্ত করে ছাড়ে? (এর জবাবে) তিনি বললেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে রোগাক্রান্ত করেছিলো?” [সহীহ মুসলিম]
হাদীসগুলোর সারমর্ম একত্রে করলে হাবিবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বক্তব্য এভাবে দাঁড়ায়:
ক. “ছোঁয়াচে রোগ, সংক্রামকতা ও অশুভ লক্ষণ বলে কিছু নেই।”
খ. “কোনো কিছুকে অশুভ বা কুলক্ষণ বলে গণ্য করোনা।”
গ. “রোগের সংক্রামক হওয়ার কোন ভিত্তি নেই বা রোগের সংক্রামকতা বলতে কিছু নেই। কোন কিছুকে অমঙ্গলজনক মনে করার কোনো কারণ নেই। পেঁচার মধ্যে কূলক্ষণের কিছু নেই, আর সফর মাসেও অশুভ বলতে কিছু নেই।”
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত- “রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত জনৈক ব্যক্তির হাত ধরে তাঁর হাত নিজের আহারের পাত্রের মধ্যে রেখে বলেন, আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে এবং আল্লাহর নামে খাও”। [আত-তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ]
রোগ সংক্রমণ বা ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে পূর্ণ বিশ্বাস করলে এ ধরনের ব্যাধির রোগীরা সবাই অস্পৃশ্যে পরিণত হবে। মানবতার হক আদায় তখন নিদারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। কেউ এ ধরনের রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করতে এগিয়ে আসবেনা। ফলে আল্লাহর অগণিত বান্দা চিকিৎসা বা সেবা-শুশ্রূষা থেকে বঞ্চিত হবে।
এখন যেমন হচ্ছে।
তাই করোনাসহ কোন রোগকেই সংক্রামক বা ছোঁয়াচে বিশ্বাস করা যাবেনা। বিশ্বাস করলে ঈমানহারা হতে হবে। লিংক: এখানে
২) পরস্পর-বিরোধী হাদিস: কোনটি মানবেন?
নির্ভরযোগ্য হাদিস মতে, ইসলামের নবী মুহম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বলেছেন, “সংক্রমণ বলে কিছু নেই।”
আবার, অন্য একটি হাদিস মতে, নবী বলেছেন, “কুষ্ঠ রোগী দেখলে তোমরা সেভাবে পালাবে, যেভাবে পালাও তোমরা সিংহ দেখলে।”
আরেকটি হাদিস জানায়, প্লেগ রোগ দেখা দিলে কী করতে হবে, তা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “কোনো ভূমিতে প্লেগ দেখা দিলে তোমরা সেখান যাবে না, আর তোমাদের ভূমিতে প্লেগ দেখা দিলে সেখান থেকে সরবে না।”
অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে, নবী মুহম্মদ বিন আব্দুল্লাহর নির্দেশ হলো, “সুস্থকে অসুস্থের সাথে মিশিয়ো না।”
স্পষ্টত: প্রথম হাদিসের বক্তব্যের সাথে বাকীগুলোর সংঘাত আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: বাংলাদেশের ইসলামিক ধর্মগুরুগণ প্রথম হাসিদটির ওপর ভিত্তি করে বাঙালী মুসলিম সাধারণকে বলে যাচ্ছেন, করোনাভাইরাসকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই; কারণ, ইসলামে সংক্রমণ বলে কোনো কিছু নেই।
এ-ধর্মগুরুগণ বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা দেখিয়ে মানুষের মধ্যে প্রয়োজনীয় আন্তর্ব্যক্তিক সামাজিক দূরত্ব (৬/৭ ফীট) মেনে চলার বিষয়টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ভীড় গা-ঘেঁষা ধর্মসভা ও মসজিদে নামাজ পড়াতে উৎসাহিত করছেন।
বাংলাদেশে যদি করোনাভাইরাস চীন, কোরিয়া, ইতালি, স্পেইনের মতো আঘাত হানে, তখন এর পরিণতির দায়িত্ব ঐ ধর্মগুরুগণ নেবেন না। হয়তো মৃত্যুকে পাপের ফল হিসেবে নির্দেশ করবেন কিংবা নবীর প্রথম হাদিস চেপে যেয়ে তাঁর অন্য হাদিসের ওপর আলোকপাত করে তারা বলবেন, হাদিসের কথা না মানলে এমনই হয়।
যদিও আমি কোনো পরিস্থিতিতেই কামনা করি না, তবুও বলিঃ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে যখন খোদ ধর্মগুরুদের প্রাণ যাবে, তখন তাদের অনুসারীগণ বুঝবেন সংক্রমণ সত্য কিনা এবং সংক্রমণ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন কিনা।
বিঃদ্রঃ হাদিসগুলো ইংরেজি থেকে ভাবানূদিত (লিংক- এখানে
সব কিছুতে ১৫০০ বছর আগে যাওয়াটাও এক ধরণের ভাইরাস। মানুষ মহাকাশে ঘুমানো কী ঠিক হবে, মঙ্গলে বসবাস করার কী বৈধ এসব খুঁজতে গেলেও তো উত্তর পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে হুজুরদের কোন দোষারোপ করছি তার আরেকটা কারণ করোনার প্রভাবে যেসব জায়গায় লক ডাউন করা হয়েছে সেখানে হুজুররা সবাইকে ডেকে নিয়ে মসজিদে নামাজ পরাচ্ছে। হুজুরদের যুক্তি হল; মসজিদে ভাইরাস ছড়ায় না। আফসোস মক্কা মদিনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও হুজুরদের চোখ খোলে নাই।

করোনা ভাইরাস এর ঔষধ একদিন না একদিন আবিষ্কার হবে। মানুষ এই রোগ থেকে মুক্তি পাবে কিন্তু আমাদের এই সামাজিক ভাইরাস থেকে মুক্তির উপায় কী? নিচে তাদের কর্মকাণ্ডের কয়েকটা নমুনা দেওয়া হল। হেসে কিংবা অবজ্ঞা করে এদের এতকাল এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই কারণ মহামারির সময় এসব হুজুরদের কর্মকাণ্ডে লক্ষ লক্ষ লোক ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে আর মারা যেতে পারে হাজার হাজার। অথচ এরা ঠিকই থাকবে অতীতের মতন দায় হীন, দায়িত্বহীন।
পৃথিবীতে যখন করোনা ভাইরাসে হাজার হাজার বয়স্ক মানুষ মারা যাচ্ছে তখন আমাদের দেশের হুজুররা ওয়াজ মাহফিলে করোনা ভাইরাসকে আল্লাহ সৈন্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। এবং বলেছে এটা কাফেরদের জন্যে গজব এই ভাইরাস মুসলিমদের কিছু করতে পারবে না। একটাবার ভাবুন আপনার ধর্ম কী এতোটাই বর্বরতা শিক্ষা দেয়, খোদা এতোটাই স্বার্থপর? শুধু এখানেই থেমে থাকেনি এরা এগুলো মানুষের মাঝেও বিতরণ করেছে! এই দেশের মানুষ গুজব, মিথ্যায় কোনটাই আলাদা করতে পারে না, অন্যদিকে ধর্মভীরু। তাই এসব হুজুরদের প্রভাব আমাদের সমাজে সবসময় ছিল এখনও আছে। যা থেকে সহজে আমাদের মুক্তি নাই।



করোনা রোধে সৌদি আরবকে ধন্যবাদ দিতে হবে। কারণ তারা যদি এসব মূর্খ মোল্লাদের কথায় মক্কা মদিনা চালু রাখতো তাহলে ওমরা আর হজ্বের কারণে সৌদি আরবে আরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হতো এবং হজ্ব ও ওমরার কারণে আরও বেশি ভাইরাস দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়তো। এখানে তারা বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। মূর্খ নাগরিক সমাজের জন্যে বোঝা আর মূর্খ ও নির্বোধ ধর্মগুরু সমাজের জন্যে অভিশাপ এটা আমরা যতো দ্রুত বুঝবো ততো আমাদের মঙ্গল।

করোনার ইস্যুতে এই দেশের মানুষের বিবেক বোধের বিভিন্ন ধারণা আমরা পাইলাম। তো, কবি নজরুল অনেক আগেই আমাদের চরিত্র সম্পর্কে তার কবিতায় বলে গেছেন। কবিতার কিছু অংশ-
এই ভারতের মহামানবের সাগর-তীরে’ হে ঋষি,
তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল চরিতেছে দিবানিশি!
গোষ্ঠে গোষ্ঠে আত্নকলহ অজাযুদ্ধের মেলা,
এদের রুধিরে নিত্য রাঙিছে ভারত-সাগর-বেলা।
পশুরাজ যবে ঘাড় ভেঙে খায় একটারে ধরে আসি’
আরটা তখনো দিব্যি মোটায়ে হ’তেছে খোদার কাসি!
শুনে হাসি পায় ইহাদেরও নাকি আছে গো ধর্ম জাতি,
রাম-ছাগল আর ব্রহ্ম-ছাগল আরেক ছাগল পাতি!
চিরঞ্জীব জগলুল- কাজী নজরুল ইসলাম
