সেকালের মুজিব অবমাননা

বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিঁড়তে চাওয়ায় ৩২ বছর বয়সী এক লোকের কান কেটে নেয় বঙ্গবন্ধু প্রেমী জনতা। নিশ্চিতভাবে বলা যায় এটা কোন সাধারণত জনতার কাজ ছিল না। কারণ ছবির জন্য কান কাটা নিশ্চয়ই কোন তেলবাজ মুজিব প্রেমীদের কাজ হবে। এই ঘটনা ১৯৭৩ সালের ৩ঠা জানুয়ারির ঘটনা। এই কান কাটার ঘটনা বুঝতে গেলে আপনাকে দুই দিনের আগের ঘটনা জানতে হবে।

হুংকার দেওয়া হয়- যেসব পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা বলা না হবে তাদের পত্রিকার অস্তিত্ব বিলোপ করে দেওয়া হবে।

নববর্ষের প্রথম দিন মানে ১ জানুয়ারিতে আমেরিকা বিরোধী মিছিলে গুলি করা বলে ২ জন ছাত্র নিহত হয়, আর আহত হয় ৭ জন। এই কারণে বঙ্গবন্ধু বিরোধী বিভিন্ন মিছিল সমাবেশের আয়োজন করা হয়। যদিও বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

এই দিনে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে হুশিয়ার করে বলা হয় দেশে বঙ্গবন্ধু অবমাননা সহ্য করা হবে না। এবং পত্রিকায় শেখ মুজিবের নামের আগে অবশ্যই বাধ্যতামূলকভাবে বঙ্গবন্ধু কথাটি লিখতে হবে। উল্লেখ্য, ছাত্রদের উপর গুলি করার ঘটনায় তৎকালীন কিছু ছাত্র সংগঠন শেখ মুজিবকে আর বঙ্গবন্ধু ডাকবেন না বলে ঘোষণা দেন। এবং ডাকসু থেকে বলা হয়েছিল – ডাকসু শেখ মুজিবকে জাতির জনক যে উপাধি দিয়েছিলো তা আজ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। এবং সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি জনসভায় ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন। রাজনীতির পরিহাস, ১৯৭২ সালের ৬ই মে এই ছাত্রনেতাই শেখ মুজিবর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেবার গৌরব অর্জন করেছিলেন। জনাব সেলিম ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিও প্রত্যাহার করে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন, “সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারে শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করা চলবে না।” তিনি বাড়িতে, অফিস-আদালতে ও দোকানে টানানো শেখ মুজিবর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলারও আহ্বান জানান।

ফলে আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ এতো ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা সমাবেশে ও মিছিলে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। তার মধ্যে কয়েকটি-

  • রব-ভাসানী-মোজাফ্ফর- বাংলার মীরজাফর
  • সামনে আছে জোর লড়াই-বঙ্গবন্ধু অস্ত্র চাই
  • লড়াই লড়াই লড়াই চাই- লড়াই করে বাঁচতে চাই
  • রব-সেলিমের -কল্লা চাই
  • বুলেটের বিরুদ্ধে- আমরাও প্রস্তুত
  • বঙ্গবন্ধুর অবমাননা- বাংলাদেশে সইবে না
  • রক্তের প্রতিশোধ-রক্তেই নিতে হবে
  • মুজিববাদ মানে না যারা-বাংলাদেশের শক্র তারা

লক্ষণীয় বিষয় হল এর দুই বছর পর মানে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের নিথর দেহ যখন ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বারের সিঁড়িতে পড়ে ছিল তখন কোন বীরপুঙ্গকে ঢাকার রাজপথে সামান্য মিছিল করতেও দেখা যায়নি। অথচ বঙ্গবন্ধু যখন জীবিত ছিলেন তখন তার ছবি ছিঁড়তে চাওয়ায় একজনের কানই এরা কেটে নিয়েছিল।

দৈনিক বাংলা, ৬ জানুয়ারি ১৯৭৩

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্র নেতা নূর আলম সিদ্দিকী মোজাফ্ফর গ্রুপ ন্যাপের সমালোচনা করে বলেন- “এই দল এতদিন ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হেরেমের রক্ষিতা। এই দলের নেতা মন্ত্রী হতে না পেরেই ক্ষেপে গেছেন বলেই তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন রক্ষিতাকে উপটোকনই দেওয়া যায়।“

এখানে আবারও বলে রাখি, এই মুজিব অবমাননার ঘটনা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ও হয়েছিল। এবং সেই অভিযোগ ছিল আমাদের জহির রায়হানের বিরুদ্ধে। যদিও তৎকালীন সরকার সেটা পাত্তা দেয়নি।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বরাবর জহির রায়হান পরিচালিত তথ্যচিত্রে মুজিব অবমাননার অভিযোগ ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১. ‘Stop Genocide’ তথ্যচিত্রের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ করা হয়; যেখানে লেলিনের বক্তব্য দিয়ে তথ্যচিত্রটি শুরু হয়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ফজলুল হক নামের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং প্রযোজক জহির রায়হানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে রাষ্ট্রপতি মুজিবের কাছে একটা চিঠি লেখে। ফজলুল হক অভিযোগ করে জহির রায়হান তার “স্টপ জেনোসাইড” প্রামাণ্যচিত্রে শেখ মুজিব, আওয়ামীলীগ এবং ছয় দফা দাবীকে অবজ্ঞা করেছেন। ফজলুল হক আরও অভিযোগ করে জহির রায়হান তার প্রামাণ্যচিত্রে ভ্লাদিমির ইলিচ ইলিয়ানোভ লেনিনের ছবি ব্যবহার করেছেন। ফজলুল হক মুজিবনগর সরকারকে জহির রায়হানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করে। কিন্তু ফলাফল ঘটে ঠিক উল্টো, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ জহির রায়হানের প্রামাণ্যচিত্রের উচ্ছসিত প্রশংসা করেন। স্টপ জেনোসাইড ১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কার জিতে নেয়। প্রামাণ্যচিত্রটি ১৯৭৫ সালে দিল্লির চলচ্চিত্র উৎসবে SIDLOC পুরষ্কার লাভ করে। জহির রায়হানের বিরুদ্ধে চিঠিটি ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল’ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে যার তথ্যসূত্র নিচে দেয়া হলোঃ Memo No. PS/SEC/III/110, Dated 10th Sept., 1971 

বরাবর

প্রধানমন্ত্রী,

বাংলাদেশ সরকার 

বিষয়ঃ জনাব ফজলুল হকের চিঠি, জহির রায়হান নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী প্রসঙ্গে। এখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক ফজলুল হকের চিঠির সংযুক্তি সন্বিবেশিত হয়েছে। চিঠিটি নিজেই এই চিঠি লেখার প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করছে। আমি আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি জনাব ফজলুল হক যেসব অভিযোগ দায়ের করেছে সেগুলো খতিয়ে দেখা হোক এবং গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুরোধ করা হইল।এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটির প্রদর্শনী বাতিল করে আমাকে জানানো হোক। 

(সৈয়দ নজরুল ইসলাম)

ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি

সংযুক্তিঃ চিঠির একটা অনুলিপি। 

স্যার,যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, বিষয়টা গভীর উদ্বেগের এবং আমার জানামতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ। জহির রায়হানের পরিচালনায় আমরা একটা প্রামাণ্যচিত্রের “স্টপ জেনোসাইড” প্রদর্শনী দেখলাম আজ কলকাতার এক ঘরোয়া আয়োজনে।

প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মানে আর্থের যোগান দিয়েছে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার এসোসিয়েশন এবং প্রযোজিত হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি এবং বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অফ ইন্টেলিজেনশিয়ালের যৌথ উদ্যোগে। প্রামাণ্যচিত্রটি ভারত সরকারের কাছে বিক্রি হতে পারে যাতে ভারত তার নিজ দেশে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে। 

প্রামাণ্যচিত্রটি শুরু হয়েছে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটা ছবি এবং তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যেখানে ইন্ডিয়াতে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প নিয়ে তেমন কিছুই প্রদর্শিত হয় নি।

আমার ধারণা এই প্রামাণ্যচিত্রের গুরুতর সমস্যা হলো এখানে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য বা তার কোন ছবি নেই বা আওয়ামীলীগ সম্পর্কে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি বা আমাদের ছয়দফা দাবী নিয়েও কিছু বলা হয়নি। 

আমি মনে করি যদি এই প্রামাণ্যচিত্র ভারতে বা বহির্বিশ্বে প্রচার হয় তাহলে দর্শকের মনে হতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে অন্যকোন উদ্দেশ্যে যেটা আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করি না। যদি এই প্রামাণ্যচিত্রটি ভারতের কোন পরিচালক নির্মাণ করতেন তাহলে হয়ত আমরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে পারতাম কিন্তু যেহেতু এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন আমাদের বাংলাদেশের একজন পরিচালক সেহেতু আমরা চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই প্রামাণ্যচিত্রের বিরোধীতা করছি এবং আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ ভারতীয় সরকারের মাধ্যমে জনসাধারণ দেখে ফেলার আগেই প্রামাণ্যচিত্রটি বন্ধে অতিসত্ত্বর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।তা যদি না করা হয় তাহলে আমি একাই প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করব। 

গভীর বিনয়াবনত,

ফজলুল হক

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক

প্রযত্নে, জনাব বিনয় রায়, ১১৪/এ পার্ক স্ট্রিট

কলকাতা-১৭

রাষ্ট্রপতি

বাংলাদেশ সরকার

মুজিবনগর

এসব তেলবাজরা ও রাজনৈতিক গুণ্ডারা সব সময় ছিল এখনও আছে। শেখ হাসিনা কিংবা তার পিতাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে থানায় গিয়ে মামলা করে আসে। আবার নেতা যখন থাকবে না এরা বাতাসে হারিয়ে যাবে। তেলবাজির এক ঐতিহাসিক ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি।

স্বাধীনতার পর লন্ডনে ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন ফারুক চৌধুরী। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঢাকায় পাকিস্তানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে লন্ডনে যখন বঙ্গবন্ধুর পেটে অপারেশন হচ্ছিল, তখন বঙ্গবন্ধুর কষ্টের কথা চিন্তা করে হাসপাতালের করিডোরে ফারুক চৌধুরী অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। (সূত্র:মুজিবের রক্ত লাল: এম আর আখতার মুকুল

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.