পুরান ঢাকার হোসাইনী দালান এলাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি-কালে বোমা হামলার ( ২৪ অক্টোবর ২০১৫) দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে- হামলায় জঙ্গিরা গ্রেনেড ব্যবহার করেছে।
সবার জানা উচিত যে, মতাদর্শ কখনো বিলীন হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পরাজয় ও হিটলার আত্মহত্যা করার মধ্য দিয়ে কিন্তু ‘নাৎসি মতবাদ’ বিলীন হয়ে যায় নি। আইন করে কখনো মতাদর্শ ধ্বংস করা যায় না। মতাদর্শকে পরাজিত করতে হয় পাল্টা আরেকটি মতাদর্শের মাধ্যমে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ওহাবী ও জঙ্গি মতবাদের বিপরীতে মুসলিম সমাজ শক্ত কোন মতবাদ বর্তমানে দাঁড় করতে পারে নি। ফলে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে যতোই জঙ্গিবাদ বিরোধী আইন করুক না কেন জঙ্গিবাদকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।
গতকালকে শিয়াদের উপর হামলা হওয়ায় ওহাবী সুন্নি মতবাদগুলো এবং সেই সাথে শিয়া প্রসঙ্গটি সামনে চলে এসেছে। শিয়া প্রসঙ্গ আলোচনার পূর্ব এটা জানা থাকা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে শুধু শিয়া নয় সেই সাথে আছে আহমদিয়া সম্প্রদায়। এবং আহমদিয়াদের উপর চলে নীরব নির্যাতন। অনেকে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে ‘কাদিয়ানী’ বলে ডেকে থাকেন। কিন্তু কাদিয়ানী শব্দটি আহমদিয়ারা অপমান-বাচক শব্দ হিসেবে দেখে থাকেন। পাকিস্তানে আইন করে আহমদিয়াদের অ-মুসলিম ঘোষণা করা হয়।
ধর্মের ভিত্তেতে দেশ ভাগের পর জামাত-ই-ইসলামের স্রষ্টা মওদুদী আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই মওদুদী পাকিস্তানকে খোদাদাদ বা আল্লাহ দান বলে ঘোষণা করেন। অথচ এই মওদুদী জিন্নাহ, পাকিস্তান, মুসলিম লীগ সম্পর্কে অসংখ্য সমালোচনা করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান থেকে যখন তারা অতীতের লেখাগুলো পুনরায় ছাপা হয় তখন সেসব অংশ ছেঁটে ফেলা হয়। ‘আহমদিয়া সমস্যা’ নামে মওদুদী একটি বই লেখেন। পাকিস্তান সরকার বইটি নিষিদ্ধ করার আগেই ১৮ দিনে বইটির ৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবে মওদুদী আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে লাহোরে হামলা শুরু করলেন। এর ফলে কয়েক হাজার আহমদিয়া হত্যার শিকার হয়। এর জন্য মওদুদীকে গ্রেফতার করে বিচার হোল এবং ফাঁসির আদেশ দেয়া হোল। পরে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপে তার ফাঁসি রদ করা হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল; ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একজন আহমদিয়ার করব দেওয়াকে কেন্দ্র করে আহমদিয়াদের উপর অত্যাচারের সূত্রপাত হয় এবং আহমদিয়াদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালানো থেকে শুরু করে লুটপাটের মতো ভয়াবহ রূপ লাভ করলে ৪ মার্চ পাকিস্তানে প্রথম আঞ্চলিক মার্শাল ল জারি হয়। মূলত এই দাঙ্গার কারণেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রথম দেশ শাসনের স্বাদ গ্রহণ করে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে যে হত্যা শুরু হয় যা চলে ১১ মে পর্যন্ত। এবং তাতে নিহত হয় কম করে পাঁচ হাজার।
বাংলা উইকিপিডিয়াতে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামের বিবরণীতে তিনি কোন ধর্মে তার কোন উল্লেখ নেই। যারা লিখেছে তারা কি আহমদিয়া পরিচয়টুকুর কারণে এই বিষয়টি উল্লেখ করে নি? এই বিষয়ে সংশয় তেকেই যায়। যাই হোক আবদুস সালাম শেষ জীবনে হয়তো সংশয়বাদী ছিলেন তবে তিনি যেহেতু আহমদিয়া পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছে সেহেতু নোবেল পাওয়ার পর অনেক সংবাদপত্রে লেখা হোল আবদুস সালামের মত একজন আহমদিয়াকে নোবেল পুরষ্কার দেয়াটা পশ্চিমাদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র। পাকিস্তান সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ দেয়। তবে অনেকেই মনে করেন পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েই এই খেতাবটি দেয়। ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর অক্সফোর্ডের বাড়ীতে মারা যান আবদুস সালাম। মৃত্যুর পর তাঁকে দাফন করা হয় রাবওয়াতে। আহমদিয়াদের নিজেদের শহর- রাবওয়া। কিন্তু রাব-ওয়া নামটাও গ্রহণযোগ্য নয় সেখানে। রাবওয়া নাম বদলে রাষ্ট্রীয় হুকুমে নাম রাখা হয়েছে- চেনাব নগর। চেনাব নগরে আবদুস সালামের সমাধি-ফলকে লেখা ছিল: “Abdus Salam the First Muslim Nobel Laureate”। সমাধি-ফলক স্থাপনের পর পুলিশ সাথে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসে মুসলিম শব্দটা মুছে দেন। তাতে লাইনটি দাঁড়ালো “Abdus Salam the First Nobel Laureate”। এর যে কোন অর্থ হয় না তাতে কিছু আসে যায় না আইনের ও ধর্মের অনুসারীদের।
২০১৩ সালে শাহবাগের বিপরীতে হেফাজত ইসলামের জন্ম হয়। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবী পেশ করে। সেই দাবীর একটি দাবী ছিল-সরকারিভাবে কাদিয়ানীদের (আহমদিয়া) অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।বাংলাদেশে এক সময় কয়েক লক্ষ আহমদিয়া ছিল। বর্তমানে তা হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশে আহমদিয়া মসজিদে হামলা, ধরে ধরে কনভার্ট করার মতন ঘটনা ঘটছে নীরবে। কিন্তু প্রশাসন ও রাষ্ট্র সবসময় এই বিষয়টিতে উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে। বাংলাদেশে আহমদিয়াদের উপর হামলার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ১৯৯৯-২০০৬ পর্যন্ত। তবে বিএনপি-জামাত সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ২০০৩ সালে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর সবচেয়ে বড় হামলা আসে। সে সময় আমাদের পত্রিকাগুলো বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে।
এবার আসি শিয়া প্রসঙ্গে। মূলত ক্ষমতার-দ্বন্দ্ব থেকেই শিয়া-সুন্নি বিরোধ। এই বিরোধের সূচনা শুরু হয় আরবের বনু হাশিম ও বনু উমাইয়া গোত্রের ক্ষমতার লড়াই থেকে। নবী মুহাম্মদের জন্মেরও পূর্ব থেকে এই দ্বন্দ্ব চলে আসতেছে বংশ থেকে বংশানুক্রমে। বনু হাশিম গোত্রে যেহেতু নবী মোহাম্মদের জন্ম হয়েছে সেহেতু বনু উমাইয়ারা নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হারানো ভয়ে নবী মুহাম্মদ -এর নেতৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে। বনু হাশিম ও বনু উমাইয়াদের মাঝে কীরূপে শক্রতা ছিল তা জানার জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন।“ উহুদ যুদ্ধে নবী মোহাম্মদের চাচা আমীর হামজার লাশ কেটে কলিজা বের করে চিবিয়ে খেয়েছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও মুয়াবিয়ার মাতা হিন্দা!” আবু সুফিয়ানের স্ত্রীর হামজার লাশকেটে কলিজা কেটে খাওয়ার কারণ আবু সুফিয়ানের জোয়ান ছেলেদের মুহাম্মদের বাহিনীর হাত খুন হতে হয়। সেই প্রতিশোধ নিয়েছিল পুত্রহারা মা।
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর বনু হাশিম ও বনু উমাইয়াদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায়। নবী মুহাম্মদের লাশ ফেলে রেখে চলে খলিফা নির্বাচনের লড়াই! আলী যখন নবী মুহাম্মদের লাশের গোসল করাচ্ছিলেন এই ফাঁকে ওমর গ্রুপ খলিফা নির্বাচন করে ফেলে। বিরোধের শুরু এখান থেকেই। খলিফা হোন আবু বকর। এরপর ওসমান নিহত হওয়ার পর মদিনা-বাসী আলীকে খলিফা নির্বাচিত করে। আলী ক্ষমতায় এসে দুর্নীতিপরায়ণ উমাইয়া গভর্নরদের বরখাস্ত করা শুরু করেন। কিন্তু সব গভর্নর তা মেনে নিলেও মুয়াবিয়া খলিফা আলীর নির্দেশ মানলেন না! সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া সেই নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে পাল্টা খলিফা ঘোষণা করলেন। ৬৫৭ সালের জুলাই মাসে সিরিয়ার সিফফিনের ময়দানে আলীর বিপরীতে যুদ্ধে নামে মুয়াবিয়া। সেই যুদ্ধে আলী জয়ের পথেই ছিল। পরাজয়ের সম্ভবনা দেখে মুয়াবিয়া ধর্মের আশ্রয় নিলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরানের পাতা লাগিয়ে যুদ্ধ করতে নামলো। এতে আলীর বাহিনীর মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী কুরান সামনে রেখে যুদ্ধ করতে নামায় আলীর বাহিনীর অনেকেই যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। ফলে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন আলী এবং এই কারণে পরবর্তীতে আলীর রাজনৈতিক ও ক্ষমতার পরাজয় ঘটে। সে সময় যারা আলীর পক্ষে যারা ছিলেন তারা ‘শিয়ানে আলী’ বলে পরিচিত ছিলেন। যার অর্থ আলী’র পার্টি। সেই থেকে শিয়া শব্দের উৎপত্তি। এর-ই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সৃষ্টি হল কারবালার মতন মর্মান্তিক ইতিহাস। কারবালার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নবী বংশের বিনাশ শুরু হয়। তাহলে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে শিয়া-সুন্নি’র দ্বন্দ্বটা মূলত ক্ষমতার। শিয়া-সুন্নীর বিরোধ শুধু জামাল যুদ্ধের পর প্রকাশ্যে এসে যায়। তবে সূচনা হয় আবু বকরের খলিফা হওয়ার মধ্য দিয়ে। তাই এ দ্বন্দ্বটা শাসকদের মধ্যে যতোটুকু ছিল সাধারণ জনগণের মধ্যে এতোটা ছিল না। অতীতের মতন এখনো শাসক শ্রেণি শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বকে ধর্মের আলখাল্লায় হাজির করে মাত্র। বর্তমান ইরান ও সৌদি’র যে দ্বন্ধ সেটিও যতোটুকু না ধর্মীয় তার থেকে বেশি আঞ্চলিক প্রভাব, বর্তমান অবস্থান, অতীতের জাতি দ্বন্দ্ব। মনে রাখা দরকার ইরানীরা ছিল পারস্য যারা ধর্ম গ্রহণ করলেও সংস্কৃতি বিসর্জন দেয় নি কখনো।
জনগণের মধ্যে বিভাজন শুরু হয় সালাফি মতবাদের প্রবক্তা ইবনে তাইমিয়া’র মধ্য দিয়ে। ইবনে তাইমিয়া’র অনুসারীরা সালাফি নামে পরিচিত। ইবনে তাইমিয়া শুধু তার নিজ অনুসারীদেরকেই মুসলমান মনে করতেন ও ইসলামের অন্যান্য মতের অনুসারীদের কাফের/মুশরিক ফতোয়া দেন। তবে ইবনে তাইয়েমা জীবদ্দশায় তার মতবাদ তেমন প্রচার করতে পারেন নি। তৎকালীন আলেম ওলামাগণ তাকে পথভ্রষ্ট আখ্যা দেন। তার মৃত্যুর পর তার মতবাদ পুনর্জীবিত করেন নজদের মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব। ওহাবের মতাদর্শকেই বর্তমান পৃথিবী ওহাবী মতবাদ হিসেবে জানে। এই আব্দুল ওহাব ইবনে সৌদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন ও তারা পরস্পর পুত্র-কন্যাকে বিয়ে দেন। বর্তমান অসহিষ্ণু মতবাদের আরেক স্রস্টা এই ওহাব। যে মতবাদ সৌদি আরব রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। বর্তমান বিশ্বের বেশির ভাগ জঙ্গি-সংগঠন ওহাবী ও সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত জঙ্গি সংগঠন ISIL কিন্তু সালাফি সুন্নি সংগঠন। বর্তমানে বিশ্বে মুসলিমদের যে দ্বন্দ্ব তা মূলত রাজনৈতিক ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সেই দ্বন্দ্বে চাপা পড়ছে সাধারণ মানুষও। যেমন সৌদি’তে ওহাবীরা শক্তিশালী, মিশরে সালাফিরা ভারতীয় উপমহাদেশে মওদুদী-বাদীরা। এই তিন মতবাদ মানুষকে অসহিষ্ণুতা এবং অন্যকে অস্বীকার করা ছাড়া কিছুই শেখায় না। এই সব উগ্র ইসলামিক মতবাদের নিচে চাপা পড়েছে সুফী দর্শন।
মধ্যপ্রাচ্যের মতন বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নির শক্রতা ছিল না। বাংলার মাটিতে আহমদিয়াদের উপর নির্যাতন হলেও শিয়াদের উপর খুনা-খুনির মতন ঘটনা অতীতে ঘটেনি। এর আরেকটি কারণ শিয়ারা এখনে সংখ্যালঘু। তবে পেট্রো-ডলারের প্রভাবে ওহাবী মতবাদের ঢেউ যেহেতু সব জায়গা আছড়ে পড়ছে সেহেতু এই ধাক্কা বাংলাদেশেও আসছে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় বেশ কিছুসংখ্যক পারস্যদেশীয় (ইরানি) বণিক দেখতে পাওয়া যায়। ইরানের সাফাভি বংশীয়দের শাসনামলে সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা-হীনতার কারণে বিপুল সংখ্যক পারস্য-বাসীর (ইরানিদের) অভিবাসনের ফলে সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় শিয়া মতবাদের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। মুঘলদের বাংলা বিজয়ের পরে কিংবা তারও আগে থেকেই শিয়ারা বাংলায় আসতে শুরু করলেও মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এর সিংহাসনারোহণের পরে সপ্তদশ শতাব্দীর গোঁড়া থেকে শিয়ারা অধিক সংখ্যায় বাংলায় আসতে থাকে। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত বাংলা কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় সতেরো শতকে।
আমাদের ইতিহাসে স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব হিসেবে পরিচিত সিরাজ-উদ-দৌলা নিজেও ছিলেন ছিলেন শিয়া। আমাদের স্কুল বইতে যে দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসীনের কথা জানি সেই হাজী মুহম্মদ মুহসীন ছিলেন একজন শিয়া। এছাড়া দ্বি-জাতিতত্ত্বের মাধ্যমে যিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করলেন তিনি নিজে ছিলেন শিয়া খোজা সম্প্রদায়ের মানুষ। বিখ্যাত ইবনে সিনার, পারস্যীয় রসায়নশাস্ত্রের জনক জাবির ইবনে হাইয়ানও একজন শিয়া। এরকম অসংখ্য বিখ্যাত মানুষ আছে যে তারা শিয়া। এসব নিয়ে আমাদের অঞ্চলের মানুষ কখনো মাথা ঘামায় নি। কিন্তু কথাগুলো আজ বলতে হয়েছে এই কারণে যে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের জনক ওহাবী মতবাদের ঢেউ বাংলাদেশে আছড়ে পড়ছে। গতকাল শিয়াদের উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে, যেমনটি হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানে ১৬ জন মারা যান আর বাংলাদেশে মারা যায় ১ জন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় শিয়া মসজিদে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে থাকে। বিভিন্ন সময় পত্রিকার পাতায় মসজিদে বোমা হামলার ঘটনাগুলো দেখেন সেগুলোর ভেতরের খবর হল শিয়া মসজিদের হামলা। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের জন্মের পর থেকেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শিয়া-সুন্নি বিরোধ চলে আসছে। বর্তমান ইরান-সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব সেই শিয়া-সুন্নি বিরোধের-ই ফল। সুন্নিরা শিয়াদের মুসলিম হিসেবে মেনে নেয় না। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা হল শিয়া’রা হল ইসলাম বিকৃতি-কারী। লন্ডনের অনেক শিয়া মসজিদে উগ্রপন্থীরা লিখে যায়-শিয়া কাফের! যদিও বর্তমানে সৌদি আরবসহ অন্যরা ঠ্যালায় পড়ে শিয়াদের মুসলিম হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ ইরান একটি শক্তিশালী শিয়া রাষ্ট্র।
২০০৪ সালে জর্ডানের আম্মারে বিশ্বের খ্যাত প্রখ্যাত আলেম সমাজ মেনে নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হয়েছে এক আলোচনা/বিতর্ক সভায়। উক্ত বিতর্ক/আলোচনা সৌদি আরবের প্রখ্যাত স্বীকৃত ১৫ জন আলেম, সৌদি বাদশা আবদুল্লাহর সাক্ষর, বিখ্যাত আল আজাহার ভার্সিটির প্রধান মুফতি সহ সুন্নি আকিদার বিভিন্ন দেশের বড় বড় বা খ্যাতনামা আলেমগণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন আর মতৈক্যে পৌঁছেন। সেই সম্মেলনে ৫০টি দেশের ২০০’র বেশি ইসলামিক স্কলার মিলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে The Three Points of The Amman Message প্রণয়ন করেন। এই সনদে সৌদ আরবসহ সবগুলো মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান স্বাক্ষর করেন, বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন খালেদা জিয়া, মুসলিম এবং অমুসলিম দেশের শীর্ষ ইসলামী স্কলারগণ স্বাক্ষর করেন (এরমধ্যে সৌদি আরবের ১৫জন ইসলামিক স্কলার)।
সেই সনদের প্রথম পয়েন্টেই ছিল কারা মুসলিম আর কারা মুসলিম না। সনদ অনুযায়ী মুসলিম হচ্ছেন-
- Sunni Hanafi, 2. Sunni Maliki, 3. Sunni Shafi’i, 4. Sunni Hanbali, 5. Sunni Zahiri, 6. Shia Ja`fari
- Shia Zaydi, and 8. Ibadi
আরও অমুসলিম হিসেবে গণ্য হবেন না-
- The Ash`ari creed, 2. Real Tasawwuf (Sufism), and 3. True Salafi thought
তাহলে দেখে যাচ্ছে এতো কাল ধরে শিয়াদের অস্বীকার করে আসলেও বৈশ্বিক রাজনৈতিক কারণে আজ অন্যদের সাথে তাদেরকেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। তবে মন থেকে বিরোধের চিন্তাটা কিন্তু এখনো যায় নি। বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে দেওবন্দি ও সালাফিরা বাংলাদেশে শিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করে আসছে। কে মুসলিম কে অমুসলিম সেই ঠিকাদারি ব্যবসা এদের কে দিল তা কেউ জানতে চায় নি। অতীতেও রাষ্ট্র কখনো এদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় নি। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পরোক্ষ মদদের কারণে বাংলাদেশে আহমদিয়াদের উপর অত্যাচারের কোন বিচার আজ পর্যন্ত হয় নি। বৈশ্বিক রাজনীতির শিয়া-সুন্নির বিরোধে বাংলাদেশ অনেক আগেই প্রবেশ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিহীনতা, দুর্নীতি, সরকারের ব্যর্থতার ফলে সমাজে মৌলবাদী শক্তিগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠার সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করেছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের একমাত্র আরো কয়েকটি কারণ হচ্ছে; সামাজিকভাবে ওহাবীপন্থী মতবাদকে পরাজিত করতে না পারা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যর্থ প্রশাসন তৈরি করা। এছাড়া প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ সব কিছু মিলিয়ে আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া পাঠ্য বইতে বিভিন্ন উগ্রবাদী পড়াশুনা, বিভিন্ন মতাদর্শের ভিত্তিতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মের নামে ওহাবী মতবাদের পিস টিভি’র আগমণ সব কিছু মিলিয়ে আজকের ‘দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশ’ তৈরিতে সহায়তা করেছে।
অক্টোবর ২৫, ২০১৫