সবার আগে আমাদের ধারণা থাকা উচিত সমাজে নবী কিংবা অবতার কখন আসে। সমাজে যখন তীব্র বিশৃঙ্খলা দেখা দিত, সমাজে আইনের শাসন বলে কিছুই থাকত না, অন্যায় অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। সাধারণ মানুষ সমাজে শৃঙ্খলা, বিচারের সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য কারু জন্য অপেক্ষা করত ঠিক সেই সময়টিতে সমাজের অবতারের আগমন ঘটত। ভারতীয় সমাজ থেকে শুরু করে আরবের মরু ভূমির মাটিতে ঠিক একই বিষয় ঘটেছে। অবতারদের বিষয়ে নানা সমালোচনা, দ্বি-মত থাকা সত্ত্বেও আপনাকে মেনে নিতে হবে যে, সমাজের একটি বিশেষ সময়ে তাদের আগমন ঘটেছে এবং ঘটনার ধারাবাহিকতায় তাঁরা হিরো হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন- আরবে যখন বিভিন্ন গোত্রে হানাহানি চলছিল তখন নারী আর পুরুষের অনুপাত প্রায় ২৫:৭৫ হয়। ফলে গোত্রগুলোর মধ্যে হানাহানি থামানোর জন্যে, সবাইকে এক ছায়ার তলে আনার লক্ষ্যে নতুন ধর্মের আগমনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এক ঈশ্বরের ধারণা আরবে পূর্বেই ছিল, নবী মুহম্মদের হাতে তা প্রতিষ্ঠা পায় মাত্র। সময়ের পরিক্রমায়, ভক্তদের কল্পনায়, লেখকের লেখনীতে তাদের সাথে জুড়ে যায় নানা উপাখ্যান! অবতার সাধারণ মানুষের মতন দেখতে হলেও যেহেতু তাঁরা অসাধারণ মানব সেহেতু সময়ের প্রেক্ষাপটে, ভবিষ্যৎ গ্রহণযোগ্যতার নিমিত্তে, অবতারদের শক্তিশালী ইমেজ সৃষ্টির লক্ষ্যে অবতারদের সাথে বিভিন্ন কাল্পনিক ও অবাস্তব ঘটনা যোগ করা হোত।
অবতারদের জন্ম সাধারণ মানুষের মতন মাতৃগর্ভে হলেও তাঁদের জন্মে অলৌকিকতার একটা ছাপ থাকত। যেমন-জিশুর জন্ম হয় কুমারী মায়ের গর্ভে! শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হওয়ার ইতিহাসে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময়ও মামা কংসকে হত্যার ভবিষ্যতবাণী ছিল। কৃষ্ণের জন্মের পর বসুদেব কারাগার থেকে পালিয়ে কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে পালক মাতা যশোদা’র কাছে দিয়ে আসেন। ধর্মীয় ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাথে পৌরাণিক গল্পেও অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। যেমন- গ্রিক সাহিত্যের নাট্যকার সফোক্লিস এর ‘ইডিপাস।”
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পূর্বে যে ভবিষ্যৎ বাণী তা সত্য হয়। মামা কংস শতো চেষ্টা করেও নিয়তি খণ্ডাতে পারেন নি। ধর্মীয় উপাখ্যানগুলো’তে হর-হামেশায় নিয়তির কথা আছে। প্রথম কথা, নিয়তি কী? সহজ উত্তর-নিয়তি হল বিধির বিধান। যা মানুষ কোন অবতারের পক্ষেও খণ্ডানো সম্ভব নয়। সেই প্রমাণ আমরা পাই ‘বিষাদ সিন্ধু’তে। হ্যাঁ, মীর মশারফ হোসেনের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ সেই নিয়তির উপর ভর করেই রচিত হয়েছে। ‘বিষাদ সিন্ধু’ নিয়ে আলোচনার পূর্বে সফোক্লিস-এর ইডিপাস-এর নিয়তি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
ইডিপাস উপাখ্যান
‘ইডিপাস’ গ্রিক সাহিত্যের বিয়োগান্তক নাটক। মানুষের শতো প্রচেষ্টায় যে ঈশ্বরের নিয়তি খণ্ডানো সম্ভব নয় তারই বিয়োগান্তক উপাখ্যান। ইডিপাস-এর বিয়োগান্তক কাহিনীটি আবর্তিত হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসের থিবস নগরীতে। ক্যাডমাস এর বংশধর লাইয়াস ছিলেন থিবস নগরের রাজা। রানীর নাম জোকাস্টা। রাজদম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান। সেকালে দৈববাণী শোনার জন্য ডেলফাই তে অবস্থিত দেবতা অ্যাপোলোর উপাসনালয়ে যাওয়ার রীতি ছিল । দৈববাণী করে পুরুষ নয়, নারী পুরোহিতরা-এদের বলে পিথিয়া। থিবস এর কাছে রাজদম্পতি সন্তানহীনার কথা বলা হল। পিথিয়ার মাধ্যমে ভয়ানক এক দৈববাণী হল: যে সন্তান জন্ম নেবে সে প্রথমে পিতা’কে হত্যা করবে অতঃপর নিজের মাকে বিয়ে করবে। অর্থাৎ সন্তান হবে পিতৃঘাতী ও মাতৃ-বিবাহিত। মানব চরিত্রের ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ নামে আমরা যে বিষয়টি জানি সেটি ইডিপাস থেকেই ধার করা। দেবতাদের এমন অমোঘ-বাণী রাজা-রাণী দুই জনই ভেঙে পড়লেন। অতঃপর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ছেলে ইডিপাসকে হত্যা করতে জল্লাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাজা লাউস। এছাড়াও আদেশ ছিল যে, শিশুর দুই পায়ে তীক্ষ্ন শলাকা প্রবিষ্ট করার। হত্যা করতে গিয়েও জল্লাদ হত্যা করতে পারল না। দয়া হল জল্লাদের। জল্লাদ শিশুটিকে না মেরে সে নির্জন পাহাড়ে রেখে আসে। শিশুটির চিৎকার এক মেষপালক শুনতে পায়। শিশুটিকে পাওয়ার পর মেষপালক শিশুটিকে তুলে দেন কোরিন্থ রাজ্যের রাজা পলিউবাসের কাছে। নিঃসন্তান কোরিন্থ রাজ্যের রাজা পলিউবাস ও রানি মেরোপির সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে শিশু ইডিপাসকে। শলাকা বিদ্ধ করায় শিশুটির পা ফুলে যায়। পা ফোলা বলে শিশুটির নাম রাখা হয় স্ফীত-পদ বা Oedipus বা ইডিপাস।
কোরিন্থ রাজ্যে বড় হতে থাকা ইডিপাস একদিন সেই দৈববাণীর কথা জানতে পারেন। এক মাতাল থেকে আরও জানতে পারে যে, রাজা পলিবিয়াস আর রানী মেরোপ তার আসল পিতা-মাতা নয়। সম্ভবত মাতালটি ছিল শিশু ইডিপাসকে কুড়িয়ে পাওয়া মেষপালক থিওক্লাইমেনাস-এর কোন বন্ধু। ইডিপাস কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য ভবিষ্যতবাণী করা সেই পুরোহিতের কাছে যায়। পুরোহিত তাকে তার আসল বাবা-মার পরিচয় না জানালেও ভবিষ্যতবাণীটা জানিয়ে দেয়। পুরোহিতের ভবিষ্যতবাণী যেন সত্য না হতে পারে সেজন্য ইডিপাস আর ক্রোরিন্থে নি গিয়ে অন্য দিকে রওনা দেয়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যেতে যেতে থিবস নগরী’র পথেই উপস্থিত হয় ইডিপাস! ডাভলিয়া নামক তিন রাস্তার মোড়ে ইডিপাস উপস্থিত হয়। রাস্তা পেরুনো নিয়ে এক অভিজাত লোকের সাথে ইডিপাসের লাগল ঝগড়া। ঝগড়ার এক পর্যায় ইডিপাস তাঁকে হত্যা করে। সেই অভিজাত ব্যক্তিটি আর কেউ ছিল না, তিনি ছিলেন থিবস নগরীর রাজা তার জন্মদাতা পিতা-লাইয়াস! তারপর ইডিপাস থিবস নগরীর দিকে হাঁটতে থাকে। থিবস নগরীর তোড়ন মুখে এক স্ফিংক্স-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। স্ফিংক্সটি দেখতে ছিল অদ্ভুত! অর্ধেক নারী অর্ধেক সিংহর মতন- আবার পাখির মতো ডানাও আছে। স্ফিংক্সটি প্রায়ই থিবস নগরীতে এসে অত্যাচার করে। স্ফিংক্স এর জ্বালায় থিবসবাসী ছিল অতিষ্ঠ । স্ফিংক্স সবাইকে ধাঁধা জিগ্যেস করে। ধাঁধার সঠিক উত্তর দিতে না পারলে উত্তরদাতাকে খেয়ে ফেলে। স্ফিংক্স এর প্রশ্নটি ছিল-কোন জিনিস সকালে চার পায়ে হাটে, দুপুরে দুই পায়ে আর রাতে তিন পায়ে হাটে? উত্তরটা ছিল, মানুষ। মানুষ শিশুকালে হাত ও পায়ের সাহায্যে চলে, যৌবনে দুই পায়ে হাঁটে এবং বৃদ্ধ হলে লাঠিতে ভর দিয়ে তিন (দুই পা, এক হাত) পায়ে হাঁটে! উত্তর দিতে পারলে স্ফিংক্স নিজে আত্মহত্যা করবে এই ছিল শর্ত! ইডিপাস উত্তর দিতে সক্ষম হোন। ধাঁধার উত্তর পেয়ে স্ফিংক্স নিজেকে হত্যা করে। থিবস হয় বিপদমুক্ত। অন্যদিকে রাজ্যের অবস্থা ভাল ছিল না তারউপর রাজ্যের রাজা হলেন নিহত। তাই থিবস এর জনগণ ইডিপাসকে রাজা বানাল। নিয়ম অনুসারে সদ্য বিধবা রানী জোকাস্টা’র সাথে বিয়ে হয় ইডিপাস। ইডিপাস কর্তৃক রাজাকে হত্যা ও রানী’কে বিবাহ করার মধ্য দিয়ে পুরোহিতের ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়ে যায়। এর পরের ঘটনা হৃদয়বিদারক। ইডিপাস ও রানী জোকাস্টার সংসারে জন্ম নেয় দুই পুত্র সন্তান ও দুই কন্যা শিশু। অনেক বছর পরে যখন রাজ্যে আবার অশান্তি দেখা দেয়। এই অশান্তির কারণের জানার জন্য রাজা ইডিপাস এক অন্ধ পয়গম্বরের ডাকেন। অন্ধ পয়গম্বর ইডিপাসের পাপের কথা জানিয়ে দেন। ইডিপাস তার অপরাধ জানার পর ইডিপাস ভেঙে পড়েন। রানী করেন আত্মহত্যা। স্বর্গে গেলে যেন নিচের চোখ দিয়ে পিতা-মাতা’কে দেখতে না পারেন তার জন্য ইডিপাস নিজের চোখ উপড়ে ফেলেন। ইডিপাস রাজসিংহাসন ত্যাগ করেন, জনগণ তাকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে। শেষ পর্যন্ত কন্যা হাত ধরে রাজ্য থেকে বেড়িয়ে যান রাজা ইডিপাস। এই হল ইডিপাস-এর সংক্ষিপ্ত কাহিনী।

নিয়তির সুতোয় গাথা ছিল কারবালা:
এবার নজর ফেরানো যাক ‘বিষাদ সিন্ধু’র দিকে। বিষাদ সিন্ধু’তেও আমরা বিধাতার নিয়তিকে অস্বীকার করতে পারব না। সেখানেও সৃষ্টি হবে বিয়োগান্তক আখ্যান! হিজরির ৬১ সালের ১০ই মহরম তারিখে মদিনার অধিপতি নবী মুহম্মদের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন পরিবারের ৭২ জন সহস্যসহ কারবালা-ভূমিতে এজিদ/ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনী’র হাতে প্রাণ ত্যাগ করেন। মুয়াবিয়া’র পুত্র ইয়াজিদের হাতে নবী মুহম্মদের দৌহিত্ররা যে নিহত হবেন ‘বিষাদ সিন্ধু’তে আমরা তারও ভবিষ্যতবাণী পাই!
একদিন নবী মুহম্মদ তার শিষ্যদের প্রতি ধর্মোপদেশ দিচ্ছিলেন, সে সময় স্বর্গের প্রধান দূত ‘জেব্রাইল’ এসে নবী’কে পরমেশ্বরের আদেশ-বাক্য শুনিয়ে গেলেন। অতঃপর নবী মুহম্মদ ক্ষণকাল নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। প্রিয় নবী’র মলিন মুখ দেখে শিষ্যরা কেউ বিচলিত হয়ে পড়লেন কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলেন না। শিষ্যদের অবস্থা দেখে মুহম্মদ জিজ্ঞেস করলেন-তোমরা দুঃখিত কেন? শিষ্যগণ বললেন-আপনার মলিন মুখ দেখলে আমরা ভাল থাকি কী করে? আমরা বুঝতে পারছি সামান্য কিছুতে আপনি নিস্তব্ধ হোন নি। অতঃপর মুহম্মদ বলিলেন-তোমাদের মধ্যে কারো সন্তান আমার প্রাণাধিক প্রিয়তম হাসান-হোসেনের পরশ শক্র হবে; হাসানকে বিষপান করিয়ে মারবে এবং হোসেনকে অস্ত্রাঘাতে নিধন করবে। এখানে পাঠকের স্মরণ রাখা উচিত যে, গ্রিক পুরাণের দেবী থেটিস-এর পুত্র অ্যাকিলিস কে জন্মের পর মা থেটিস তাকে স্টিক্স নদীতে একবার নিমজ্জিত করেন। এর ফলে অ্যাকিলিস-এর সারা শরীর মৃত্যুহীন হয়ে যায় কিন্তু গোড়ালির যে অংশ ধরে থেটিস অ্যাকিলিসকে জলে ডুবিয়েছিলেন, সেই অংশটি অজয় থেকে যায়। ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী গোয়ালিতে তীর-বিদ্ধ হয়ে মারা যান অ্যাকিলিস। হোসেনের উপাখ্যানে আমরা অ্যাকিলিসের ছায়া পাই। নবী মুহম্মদ তাঁর প্রিয় দৌহিত্র হোসেনের যে জায়গায় চুমু খেয়েছেন সেই জায়গাগুলো চিরজীবী হয়ে গেছে। যাই হোক, নবী মুহাম্মদের কথা শুনে শিষ্যগণ নির্বাক হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তারা বলিতে লাগিলেন কার সন্তানদের মাধ্যমে এটি সংগঠিত হবে তা জানতে পারলে আমরা এর প্রতিকারের উপায় করতে পারতাম। যদি তা না বলেন তাহলে আমরা একত্রে বিষপান করে আত্মহত্যা করব। আত্মহত্যায় যদি নকর-বাস হয় তাহলে আমরা আজ হতে স্ত্রী’গণকে পরিত্যাগ করব। প্রাণ থাকতে তাদের মুখ আর আমরা দেখব না।
নবী মুহম্মদ বললেন,-তোমরা যতো কিছুই করার চেষ্টা কর না কেন, ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য্যে বাঁধা দেওয়ার সাধ্য কারো নাই। তাঁর কলম রদ করবার সাধ্য কারো নাই। তাই তোমরা কেন দুঃখে থাকবে, কেন নিজের স্ত্রী’দের কষ্ট দেবে? এটাও তো মহাপাপ! তোমরা কষ্ট পাবে বলে আমি বিষয়টি তোমাদের জানাতে চাই নি। তবে তোমরা যেহেতু সব কিছু শুনতে আগ্রহী তাহলো শোন-তোমাদের মধ্যে আমার প্রিয় মাবিয়া/মুয়াবিয়া’র এক পুত্র জন্মাবে। সেই পুত্র জগতে ইয়াজিদ নামে খ্যাত হবে। সেই ইয়াজিদ একদিন হাসান-হোসেনের শক্র হয়ে তাঁদের হত্যা করবে। মুয়াবিয়া তখনও বিয়ে করেন নাই। তিনি ধর্ম সাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা করলেন-জীবিত থাকিতে বিবাহের নাম মুখে আনবেন না। এমন কি ইচ্ছে করে কখনো স্ত্রী’লোকের মুখও দর্শন করবেন না। নবী মুহম্মদ বললেন, মুয়াবিয়া তোমার মতন ঈশ্বর ভক্ত মানুষের এমন প্রতিজ্ঞা করা অনুচিত কারণ ঈশ্বরের বিধান কেউ খণ্ডাতে পারবে না।
নিয়তির কী খেলা! একদিন মুয়াবিয়া মূত্রত্যাগের পর কুলুপ নেওয়ার সময় এক বিষযুক্ত কুলুপ নিয়ে ফেলে। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নবী মুহম্মদ যখন তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করতে যাবেন তখন ফেরেশতা এসে বললেন; হে মুহম্মদ, তুমি কী করতে যাচ্ছ! ঈশ্বরের নামে এগুলো করতে যেও না। এগুলো তাঁর লীলা। তোমার শত চেষ্টায় কোন কাজ হবে না। এই অসুখের একমাত্র ঔষধ স্ত্রী-সহবাস। নবী মুহম্মদ সকলের উদ্দেশে বললেন-এই অসুখের একটি মাত্র ঔষধ তা হল স্ত্রী-সহবাস। মুয়াবিয়া যদি স্ত্রী-সহবাসে রাজি হয় তাহলেই তার প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব! প্রাণ রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে মুয়াবিয়া এক বয়স্ক স্ত্রী’র সাথে সহবাস করলেন। ফলে মুয়াবিয়া সুস্থ হয়ে উঠলেন অন্যদিকে মুয়াবিয়ার বয়স্কা স্ত্রী গর্ভবতী হলেন। মুয়াবিয়া মনে মনে ঠিক করে রাখলেন যে, যদি পুত্র সন্তান হলে তিনি তাকে তখনই মেরে ফেলবেন। যে দিন পুত্র সন্তান জন্মাল সেদিন পুত্রকে হত্যার জন্য আঁতুল ঘরে গেলেন। কিন্তু পুত্রের মুখ দেখে শিশু ইয়াজিদকে ভালোবেসে ফেললেন, হাত থেকে পড়ে গেল হত্যা করার তলওয়ার। মুয়াবিয়া পুত্রের প্রাণহরণ করবেন কী উল্টো পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত দিলেন। নিজের জীবন থেকে বেশি ইয়াজিদকে ভালবাসতে লাগলেন।
এভাবে দিন দিন যেতে লাগল। মুয়াবিয়া পুত্রের মায়ায় জড়ালেও নবী মুহাম্মদের ভবিষ্যতবাণী ভুললেন না। তাই মুয়াবিয়া নিজের পুত্র’কে হাসান-হোসেন থেকে দূরের রাখবার জন্য দামেস্ক নগরীতে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। নবী মুহম্মদ ও আলী’র অনুমতি পেয়ে পরিবারসহ দামেস্ক নগরীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। যাবার বেলায় মুহম্মদ বললেন, মুয়াবিয়া দামেস্ক কেন এই জগত হতে অন্য জগতে গেলেও ঈশ্বরের বাক্য লঙ্ঘন হবে না! যাবার বেলায়, আলী মুয়াবিয়া’র হাতে দামেস্ক নগরী’র শাসনভার তুলে দিলেন।
এই দিকে সময়ের সাথে সাথে জল গড়াতে লাগল। মদিনায় হাসান-হোসেন, দামেস্ক’য় ইয়াজিদ বড় হতে লাগল। এর মাঝে নবী মুহাম্মদ প্রাণ ত্যাগ করলেন, হাসান-হোসেন মাতৃহারা, পিতৃহারা হইল। যুবক ইয়াজিদ আবদুল জব্বরের সুন্দরী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্ত্রী জয়নাব-এর প্রেমে পড়ল। জয়নাব’কে পাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে আবদুল জব্বরের সাথে জয়নাবের তালাক করিয়ে, জব্বরকে পাগল বানাল। মুয়াবিয়া’র বয়স তখন কম হোল না। পিতা’র অসুস্থতার সুযোগে ইয়াজিদ রাজসিংহাসন দখল, জয়নাবকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করল। মাঝপথে বাঁধ সাধল ইমাম হাসান। ইয়াজিদ জয়নাব’কে বিয়ের প্রস্তাব দিতে লোক পাঠালে মাঝ পথে রাজদূতের সাথে সাক্ষাৎ হয় ইমাম হাসানের। ইমাম হাসান ইয়াজিদের মতন ধনী নন, চেহারায় ইয়াজিদের মতন সুন্দর নন। তারপরও যখন শুনলেন জয়নাবের কাছে ইয়াজিদের বিয়ের প্রস্তাব যাচ্ছে সেহেতু তিনিও নিজের নামটি জয়নাবের কাছে হাজির করার হুকুম দিলেন। হাসান আগেই জানতেন জয়নাবকে বিয়ে করার জন্য ইয়াজিদ ষড়যন্ত্র করে জব্বরের সাথে তালাক করিয়েছে। জয়নাব ধনী, রূপবান, শক্তিমান ভবিষ্যৎ শাসক ইয়াজিদের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে বিয়ে করলেন ইমাম হাসনকে। ইমাম হাসানের যোগ্যতা তিনি গরীব শাসক কিন্তু সৎ, হৃদয় তাঁর মনোহর। এছাড়া নবী মুহম্মদের দৌহিত্র তিনি। ধন-দৌলতে কখনো লোভ ছিল না জয়নাবের তার প্রমাণ আমরা আবদুল জব্বরের সংসারেই দেখেছি। তাই তিনি নিজের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য ইমাম হাসানের কাছে নিজেকে সপে দিলেন। শিশুকাল থেকেই হাসান-হোসেন প্রতি এক ধরণের বিদ্বেষ ছিল ইয়াজিদের। তাই তিনি কখনো হাসানদের বাদশা মানেন নি। তার স্পষ্ট জবাব-যাদের দুই বেলা খাওয়ার সামর্থ্য নেই, যাদের সন্ধ্যার পর প্রদীপ জ্বালিয়ে আঁধার দূর করতে হয় সেই হাসানদের কাছে কেন আমি মাথা নত করব। জয়নাবের বিয়ে করার ঘটনায় ইয়াজিদের হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে।
হাসানের প্রথম স্ত্রী হাসনে বানু’র ঘরে জন্ম নেয় একমাত্র সন্তান মহাবীর কাশেম। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন জায়দা। অতঃপর ঘরে এলেন জয়নাব। জয়নাব এর কথা পড়তে গেলে মনে পড়ে ট্রয় নগরী’র হেলেনের কথা। হেলেনকে কেন্দ্র করে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ অতঃপর জয় পায় গ্রিকরা। কিন্তু যে হেলেনের জন্য এত কিছু তাকে মেনেলাউস কাছে পেয়েছিলেন কি না তা আজো অজানা। ইতিহাস আর মিথলজি, উভয় মাধ্যমই ট্রয় নগরী ধ্বংসের জন্য হেলেনকেই দায়ী করে থাকে। হেলেন আসলে নিয়তির ক্রীড়নক বই আর কিছুই ছিলেন না। হেলেনের সেই উপাখ্যানেও নিয়তি ছিল, দেবতাদের ভবিষ্যতবাণী ছিল এবং সেই ভবিষ্যতবাণী কারবালার মতন মাথা নিতে হয়েছিল। জয়নাবকে হাসনে বানু সহজভাবে মেনে নিলেও জায়দা মেনে নিতে পারেন নি। এই দিকে হাসান-হোসেনকে দেখতে চেয়েও ইয়াজিদের ষড়যন্ত্রে তাদের না দেশেই মারা যান বৃদ্ধ মুয়াবিয়া। মৃত্যুর আগে মুয়াবিয়া ছেলেকে অভিশাপ দেন, ছেলের মুখ দেখা থেকে বিরত থাকেন এবং নবী মুহম্মদের ভবিষ্যতবাণী যে সত্য হতে যাচ্ছে তা ভেবে শিহরিত হোন, ক্ষমা চান ঈশ্বরের কাছে। হত্যা করতে এসে যে শিশুর মুখ দেখে মুয়াবিয়ার হাতের অস্ত্র পড়ে যায় সেই ইয়াজিদ পিতার মৃত্যুর পর কাঁদলেন না।
মুয়াবিয়া মারা যাওয়ার পর বাদশা হয় ইয়াজিদ। দামেস্কর জনগণ মন থেকে ইয়াজিদকে মেনে নিতে পারলেন না। ইয়াজিদ বাদশা হয়ে মদিনার অধিবাসীদের তার আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়। মদিনার অধিবাসীরা তা অস্বীকার করলে ইয়াজিদ খাস লোক মারওয়ানকে মদিনা আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। মদিনার সেনাদলের সাথে মারওয়ানের সেনাদলের যুদ্ধ হয় এবং মারওয়ান পরাজিত হয়। পরে মারওয়ান মায়মুনা নামের এক বৃদ্ধার সাথে ইমাম হাসানকে হত্যার ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করে। মায়মুনা ইমাম হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী জায়েদার মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে ইমাম হাসানকে হত্যা করে। ইমাম হোসেন এই হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। মহরম মাসের আট তারিখে ইমাম হোসেন কারবালা প্রান্তরে পৌঁছেন। এখানে ইয়াজিদ সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হোন তিনি। ইয়াজিদ বাহিনী ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়। ফলে ইমামের পরিবার ও সাথীরা ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন। এ অবস্থার মধ্যেও ইমাম হোসেন তাঁর মেয়ে সাকিনার সাথে ইমাম হাসানের ছেলে কাসেমের বিয়ে দেন। অবশেষে মহরমের দশ তারিখে ইয়াজিদের সেনাদলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ইমাম হোসেন তাঁর সকল সঙ্গী-সাথীসহ ইয়াজিদ বাহিনী’র হাতে নিয়ত হোন (শাহাদাত)। সেই যুদ্ধে নবী বংশের ৭২ জন সদস্য মারা যান। যার বেশির ভাগই ছিল শিশু ও নারী। ইমাম হোসেনের ছয় মাস বয়সী একজন পুত্রও ছিলেন। বলতে গেলে এই এক যুদ্ধেই নবীর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হাসান পরিবার ইয়াজিদের মতন ধনী ছিল না। যার তেমন কোন শক্তিশালী সৈন্য বাহিনীও ছিল না। তার বিপরীতে ইয়াজিদ ছিলেন বিশাল শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী’র অধিকারী। তাহলে প্রশ্ন আসে, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও হোসেন কেন যুদ্ধ করতে কারবালায় আসল। তিনি কী জানতেন না তিনি এই যুদ্ধে পরাজিত হবে। এখানে দুইটি বিষয় আছে এক, হোসেন নিশ্চিত পরাজয় জেনেই যুদ্ধ করতে এসেছেন। কারণ তিনি ইয়াজিদের রাজতন্ত্র মেনে নেবেন না। অন্যদিকে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন মিরাকল কিছু একটা ঘটে গিয়ে যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হবেন। যুদ্ধে বিজয়ের পর ইমাম হোসেনের মাথা কেটে ফেলা হয়। সিমার হোসেন পুরস্কারের লোভে ইমাম হোসেনের কাটা মাথা নিয়ে দামেশকের দিকে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে রাত হলে সে আজর নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। আজর সিমারের নিকট থেকে নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানতে পেরে তাকে পরামর্শ দেয় যেন সে তা তার হেফাজতে রাখে যাতে রাতে কেউ তা চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে। সিমার হোসেন এতে রাজি হয়। আজর তার পরিবারের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে,এ মাথা তারা কারবালায় নিয়ে যাবে এবং সেখানে দাফন করবে। পরদিন সকালে সিমার হোসেন তার নিকট থেকে মাথা চাইলে সে তা দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু সিমার হোসেন একটি কাটা মাথা হলেই চলে যাবে এ কথা বললে আজর প্রথমে তার বড় ছেলেকে হত্যা করে মাথা কেটে এনে শিমারকে দেয়। কিন্তু শিমার এ মাথা নিতে অস্বীকার করে আবারও একটি কাটা মাথার কথা বলে। এভাবে এ ব্যক্তি পরপর তার তিন ছেলেকেই হত্যা করে মাথা কেটে শিমারকে দেয়। কিন্তু সিমার হোসেন মনে করে আজর হয়ত অর্থের লোভে ইমামের মাথা দিতে চাচ্ছে না। অবশেষে সিমার হোসেন আজর’কে ও তার স্ত্রী’কে হত্যা করে ইমামের মাথা নিয়ে ইয়াজিদের দরবারে উপস্থিত হয়। ইয়াজিদের দরবার হতে সেই মাথা ঊর্ধ্বে উঠে যেতে যেতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়। এই হল মূলক মীর মোশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’র কাহিনী।
কারবালা’র ঘটনা সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য শোকের হলেও এই দিনটিতে সবচেয়ে বেশি হৃদয়ে ধারণ করে শিয়া সম্প্রদায়। হাসান-হোসেনদের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেই ‘শিয়া সম্প্রদায়’ বিকাশ লাভ করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের মতন বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নি’র মধ্যে খুনা-খুনি নেই। ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই আরবের কয়েকজনের সামনে কারবালার বিষয়টি উপস্থাপন করি। তারা সুন্নি হওয়ায় প্রথমেই এক বাক্যে বলল; এই ইতিহাস মিথ্যা এই ইতিহাস শিয়াদের বাড়িয়ে বলা ইতিহাস। এই ইতিহাসকে ব্যবহার করে সহানুভূতির কৌশলে সমগ্র বিশ্ব তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অতিরিক্ত শিয়া বিদ্বেষ দেখার পর আলোচনা আর আগালাম না। বাংলাদেশে ইমান-হোসেনের কাহিনী জনপ্রিয়তা পায় বিষাদ সিন্ধুর মাধ্যমে। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে জিশু আবার ফিরে আসবেন তেমনি শিয়ারা বিশ্বাস করেন তাঁদের উপর ইসলামের শুরু থেকেই যে অবিচার হয়েছে ইমাম মাহদী এসে সেই অন্যায়ের বিচার করবেন। এছাড়া খ্রিস্টানদের একটি অংশ জিশু’র উপর যে অত্যাচার হয়েছে তা উপলব্ধি করার জন্য জিশুর স্মরণে নিজের শরীর ক্ষম-বিক্ষত করে যেমনটি করে শিয়ারা আশুরায়। তবে এই প্রথাটি সুন্নি’রা মহাপাপ হিসেবে জ্ঞান করে।
হোসেনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়:
কারস্টেন হোলগার” রচিত ‘জিসাস লিভড ইন ইন্ডিয়া’র মতন জিসাস কী ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর ভারতে এসেছিলেন কিনা কিংবা ড্যান ব্রাউনের ‘দি দ্যা ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসের মতন জিশু কী আদও বিবাহিত ছিলেন কিনা। জিশুর বংশধররা পৃথিবীতে আছেন কিনা এমন বিতর্কিত কিংবা কল্পনাকৃত ঘটনার মতন ধরে নিতে হবে হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ইতিহাস টুকু।
সনাতন ধর্মে সরস্বত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের আদি নিবাস মূলত উত্তর ভারতে। সেই সম্প্রদায়ের আবার সাতটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের মধ্যে মোহ্যাল ব্রাহ্মণ ছাড়াও রয়েছে ভিমাল, বলি, চিবড়! আমার আলোচনা মোহ্যাল ব্রাহ্মণদের প্রসঙ্গে। হিন্দু শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণদের কাজ যজ্ঞ,উপাসনাদি ইত্যাদিতে আবদ্ধ থাকলেও ‘দত্ত’ ব্রাহ্মণদের ইতিহাস কিছুটা ব্যতিক্রম। ‘দত্ত’রা হচ্ছে এই মোহ্যাল গোষ্ঠীর একমাত্র যোদ্ধা বংশীয় ব্রাহ্মণ, যারা একই সাথে হোসেনী ব্রাহ্মণ নামেও পরিচিত। ভারতের পুনের হোসেনী ব্রাহ্মণদের দাবি (যাদের আদি নিবাস ছিল পাঞ্জাব), তাদের পূর্ব-পুরুষরা নবী মুহাম্মদের দৌহিত্র ও হযরত আলী’র পুত্র ইমাম হোসেন-এর পক্ষে কারবালায় (বর্তমান ইরাক) লড়াই করেছেন। তাই মুসলিমদের সাথে সাথে হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ও মহরম উদযাপন করে কারবালার সেই করুণ ইতিহাসকে স্মরণ করে থাকেন। তাদের মতে, আনুমানিক ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, সেই সময়কার প্রায় ৫০০ ‘দত্ত’ ব্রাহ্মণ তাদের পূর্ব ইতিহাসের অংশ হিসেবে ইমাম হোসেন এর নামের ‘হোসেন’ অংশটি নিজেদের উপাধির অংশ করে নেন এবং নিজেদের ‘হোসেনি ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন।
স্থানীয়দের মধ্যে, এই হোসেনী ব্রাহ্মণদের পূর্ব-পুরুষ ছিলেন-রাহাব দত্ত। যিনি বন্ধু ইমাম হোসেনের জন্যে লড়াই করতে সুদূর আরব দেশে যান। নিজের ছেলেদের সাথে নিয়ে লড়াই করেন ইয়াজিদ এর বিরুদ্ধে। যুদ্ধে তাঁর সব সন্তান নিহত হয়। বলা হয়, ইমাম হোসেন তাঁর প্রতি রাহাব দত্তের এই ভালোবাসা দেখে তাঁকে সুলতান উপাধি দেন এবং তাঁকে ভারতে চলে যেতে অনুরোধ করেন। রাহাব দত্ত পরবর্তীতে ভারতে ফিরে আসেন ঠিকই এবং তাঁর নামের সাথে ‘হোসেনী’ যুক্ত করে নেন। কর্নেল রামস্বরূপ বকশী যিনি এই হোসেনী ব্রাহ্মণদেরই বংশধর, তিনি মনে করেন- “প্রতিবছর মুসলিমদের পাশাপাশি আশুরা উদযাপন হিন্দু-মুসলিম ভাতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা এই উপমহাদেশের কয়েকশ বছরের হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানেরই প্রতীক।” তারা মনে করেন, রাহাব দত্তের সাথে মোহাম্মদের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং আরবে তিনি বেশ সম্মানিত ছিলেন। কারবালার যুদ্ধে তিনি তাঁর সাত পুত্রের জীবন উৎসর্গ করেন যাদের নাম যথাক্রমে: পোরো, রাম সিং , হারাস সিং, রাই পান, সাহাস রাই, শের খান, ধারো।
দত্ত ব্রাহ্মণরা এবং শিয়া অনুসারীরা তাদের যুদ্ধ ত্যাগ করেননি যতদিন না পর্যন্ত ইয়াজিদ ক্ষমতা ছাড়ছিলেন। ইমাম হোসেনের মৃত্যুর পর মাত্র ৪০ দিন ইয়াজিদ ক্ষমতায় ছিলেন। দুঃসাহসিক হোসেনী ব্রাহ্মণরা একাত্ম হন আমির আল মোখতারের এর সাথে। যাকে আমরা মোখতারের বিদ্রোহ হিসেবে জানি। যিনি ইমাম হোসেনের সবচেয়ে কাছের অনুসারী ছিলেন। তারা কুফার দুর্গ আক্রমণ করেন এবং ইয়াজিদের গভর্নর ওবাইদুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে রাখা যেতে পারে, হযরত আলি কর সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনার মত গুরুত্বপূর্ণ পদে দত্ত ব্রাহ্মণদের নিয়োগ করেছিলেন বাসরার যুদ্ধে যা “উটের যুদ্ধ” নামে খ্যাত। (সূত্র- Brahmins Fought for Imam Hussain in the Battle of Karbala)
বলা হয় পরবর্তীতে, সুন্নি মুসলিমরা যখন শিয়াদের এবং দত্ত ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করল তখন সাত পুত্র হারানোর ক্ষোভে দুঃখে রাহাব দত্ত আফগানিস্তান চলে যান। অন্যান্য দত্ত ব্রাহ্মণরা আরব ছেড়ে আনুমানিক ৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের শিয়ালকোটে চলে আসেন। কেউবা রাজস্থানের পুশকারেও চলে যান। এছাড়া রাহাব দত্তের অন্যান্য বংশধরদের মধ্যে মোহদারা এখনও আফগানিস্তানে রয়েছেন। আজও ভারতে হোসেনি ব্রাহ্মণরা মহরম পালন করেন অন্যান্য মুসলিমদের সাথে। এদের অনেকেই এখন দত্ত, শর্মা, ভরদ্বাজ ইত্যাদি ব্যবহার করেন।
মীর মোশারফ হোসেন-এর ‘বিষাদ সিন্ধু’তে আজর নামে যে ব্যক্তির কথা উল্লেখ আছে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ভারতীয় লোক। মোফারফ হোসেন হয়তো এরকম কোন ঘটনা শুনেই বিষাদ সিন্ধু’তে আজর চরিত্রটি যুক্ত করে থাকতে পারেন। বর্তমান ভারতে হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা ৫ লাখ। এছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তানেও হোসেনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। এখন কথা আসে, আরবের ময়দানে আবার ব্রাহ্মণ পাওয়া গেলে কি ভাবে? হোসেনি ব্রাহ্মণদের ভাষ্যমতে মুহম্মদের পরিবারের সাথে এই ব্রাহ্মণদের সম্পর্ক ছিল। তাহলে প্রশ্ন আসে এই সম্পর্কের কথা ইসলামের কোন ইতিহাসে লেখা আছে কিনা? আবার আরেকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে হাজির হয় সেটি হল, ভারতে হোসেনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের জবানবন্দি অনুযায়ী বিষাদ সিন্ধুর বর্ণনা অনুযায়ী আজর তিন জনের মাথা উৎসর্গ করেন নি, বরং সাতজন পুত্রকে উৎসর্গ করেছিলেন। তবে এখানে ব্যক্তির নাম আজর নয় রাহাব সিং দত্ত (Rahab Sidh Datt)!
তবে ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, বর্তমান সময়ে জিশু খ্রিস্ট ভারতের এসেছিলেন কিনা সেই ইতিহাসের মতন রাহাব দত্ত ইমাম হোসেনের সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন কিনা সেই ইতিহাস ধোঁয়াশায় থেকেই যায়। ইমাম হোসেনের সাথে দেখা হোক বা না হোক, সেই ইতিহাস হয়তো মিথ! কিন্তু পাঁচ লক্ষ মানুষ হিন্দু হয়েও ইমাম হোসেনের চেতনা ধারণা করে এটি কিন্তু মিথ্যে নয়। এটাই বাস্তবতা! বি.জে.পি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন আরএসএস যখন হিন্দু ধর্মে অ-হিন্দুদের দীক্ষিত করার কর্মসূচী ‘পুরখো কে ঘর ওয়াপসি’ হাতে নিলো তখন সবার আগে হোসেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ইস্যুটি সামনে এসে যায়। কারণ তারা হিন্দু হয়েও শিয়া মুসলিমদের একটি বিশ্বাস একই সাথে লালন করে।
হোসেন’কে কোন ভারতীয় সাহায্য করেছে আর সেই ইতিহাস ইরানে থাকবে না এটি অসম্ভব বিষয়। কিন্তু অনেকেই বলেন ইরানে শিয়া’দের ইতিহাসে এই বিষয়টি উল্লেখ নেই। এই ইতিহাস কতোটুকু সত্য নাকি মিথ সেই ভরসার জায়গা হল ইরানের শিয়াদের ইতিহাস। বাংলা ব্লগে ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে যারা জ্ঞান রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম পারভেজ আলম এই বিষয়ে বলেন-“উমাইয়ার খেলাফতের আমলে শিয়া মুভমেন্টের মূল জায়গা ছিল পূর্ব ইরান আর আফগানিস্তান। ইরানের খোরাসান ছিল শিয়া মুভমেন্টের জায়গা। শিয়া ডিসিডেন্টরা পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বসতি করেছিল হতে পারে তাদের মাধ্যমেই এই কিংবদন্তি-গুলার জন্ম হয়েছে। ভারতবর্ষের লোকজনরে সাথে নিয়া উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল আব্বাসিয়রা, আব্বাসিয়রাও অতিতে শিয়া ছিল। প্লাস আব্বাসিয়রা প্রাচীন হিন্দু বৌদ্ধ ঐতিহ্যরে যথেষ্ট সম্মান করতো, অনেক বই পত্র অনুবাদ করছে, ভারতীয় পণ্ডিতদের বাগদাদে নিয়া গেছে, এইসব কাহিনী ঐসময়ও জন্ম হইতে পারে।”
হোসেনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একজন সদস্য সাক্ষাৎকারে বলেন, হোসেনী ব্রাহ্মণদের গলায় একটা চিহ্ন দেখা যায়। অতীতে এই চিহ্নের বিষয়ে আমার জানা ছিল না কিন্তু আমি লক্ষ্য করে দেখলাম আমার ছেলের মতন আমার গলার মধ্যেও একটি চিহ্ন আছে। এই চিহ্ন টি খুব ছোট আকারের হয়। এই চিহ্নটি জন্মগত-ভাবে হয়। হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০% মানুষের গলার মধ্যে জন্মগত-ভাবে একটি চিহ্ন থাকে। এই চিহ্নটি হল কারবালা’র যে sacrificeহয়েছিল তারই চিহ্ন!আমরা আমাদের পরিবারের যে কোন উৎসবে সবার আগে ঈশ্বরকে তারপর হোসেনকে পূজা/স্মরণ করে কাজ শুরু করি।
যারা ভাবছেন এমন বিশ্বাস থাকা সম্ভব কিনা তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই মোহাম্মদ আলী জিন্না’র কথা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন শিয়া খোজা সম্প্রদায়ের মানুষ। খোজাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-আচরণ সহজে কোনও পরিচিত ছাঁচের মধ্যে ফেলে বিচার করা চলে না। বার্নাড লিউইস খোজাদের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এরা “এক পাতলা মুসলিম আচ্ছাদনের তলায় হিন্দু মনো-ভাবাপন্ন। ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অধীনে এ এক বিশিষ্ট সম্প্রদায়, যার মধ্যে হিন্দু-মুসলিম দুয়েরই মিশ্রণ।” তাই সবশেষে যে কথাটি বলা যায়, হোসেনের সাথে ব্রাহ্মণরা লড়েছিল কিনা, তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল কিনা তা স্পষ্ট করে বলা না গেলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের বাহিরে হোসেইন বেঁচে আছেন ‘হোসেনী ব্রাহ্মণ’ সম্প্রদায়ের মধ্যে। এটাই সত্য এটাই বাস্তবতা।
তথ্য-সহায়তায়-
Brahmins Fought for Imam Hussain in the Battle of Karbala
http://hussainibrahmin.tumblr.com
বিষাদ সিন্ধু-মীর মোশারফ হোসেন
কারবালা: বিচার ও নাজাত-পারভেজ আলম
ইডিপাস: যার জীবনের শেষ সুরটি ছিল বিষাদের –ইমন জুবায়ের
উইকি-সোর্স
অক্টোবর ২৯, ২০১৫