প্রিয় বালা বিশ্বাস: দিনাজপুর জেলা এখন কলংকের জঞ্জালে নিপতিত। এখানে রাজনৈতিক স্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার লক্ষে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়ানো হয়েছে। গত দেড় দশকে এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে! এইসব হামলায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জানের ক্ষতি না হলেও ও মালের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। সৃষ্টি হয়েছে চরম নিরাপত্তহীনতা। মনোবল ভেঙ্গেছে সংখ্যালঘুদের। জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় তাই অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
হাজার বছরের গৌরবোজ্জল ইতিহাস থেকে দিনাজপুরকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতামুক্ত জনপদ বলা যেত।। এমন কি ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভেঙ্গে গিয়ে ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি হয়েছিল তখনো এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ছিলনা। তখন রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ এবং অস্থিরতা থাকলেও দিনাজপুর শান্ত জনপদ ছিল । এখানে হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলিম কিংবা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুর বিদ্বেষমূলক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়না।
কিন্তু সাম্প্রাতিককালে এই অবস্থাটা অনেকটা বদলে গেছে। বিগত এক যুগে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প এসে লেগেছে এই জেলায়। ধর্মের নামে, রাজনীতির দুষ্ট চক্র আর নির্বাচনের বলীর পাঁঠা হতে হয়েছে এই জেলার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কটি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে এই জেলায়। যা এই জনপদের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে কলংকিত করেছে।
দেড় দশকে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলি হলো;
* ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০০১ সালে বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা।
* মসজিদ নির্মাণে বাধা দেয়ার মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ২০১২ সালের ৪ আগষ্ট চিরিরবন্দর উপজেলার বলাইবাজার এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা।
* জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনায় ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর চিরিরবন্দর উপজেলার ভূষিরবন্দর এবং খানসামা উপজেলার রামনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা।
* ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালের ৪/৫ জানুয়ারী দিনাজপুর সদর উপজেলার কর্ণাই, চিরিরবন্দর উপজেলার অঁকড়াবাড়ী, বীরগঞ্জ উপজেলার লাডডাবড়া, কহারোলের নিত্যানন্দ মন্দিরে হামলা, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে উপজেলার সোনাহার বাজারসহ আরো কয়েকটি বাজারে, ঠাকুরগাঁও সদরের গড়েয়া বাজারে, পীরগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা।
সবগুলো হামলার ঘটনাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঘটানো হয়েছে। সব ঘটনাতেই হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন হিন্দু জনগোষ্ঠী। দু/এক জায়গায় কিছুটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সবকটি ঘটনাকেই সাম্প্রদায়িকতার অর্থে হামলাকারীরা ব্যবহার করেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার সেই লোকালয়গুলোয় আমি ঘুরেছি। দেখেছি নির্যাতিত মানুষের হাহাকার, শুনেছি আর্তনাদ সেগুলো নিয়ে নিয়ে কিছু কিছু লিখেছি। কিছু লেখা জাতীয়, স্থানীয় এবং আঞ্চলিক দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। কিছু আছে অপ্রকাশিত। সংখ্যালঘু মানুষের সেই হাহাকার আর আর্তনাদ বন্ধ করার প্রকৃত উদ্যোগ কতদিনে সরকার নেবেন?
বিরল : শুকু চেয়ারম্যানের অত্যাচারে শত পরিবার ভারতে
.jpg)
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণ ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। ভোট দেয়া না দেয়ার খেলায় পাঁঠার মত বলী হতে হয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে। সংখ্যালঘু হয়ে জন্ম নেয়া যেন আজন্ম পাপ। যে সম্প্রীতির বন্ধনে এই বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান,বৌদ্ধ মিলে মিশে এককার হয়ে থাকতেন ২০০১ সালের নির্বাচনী সহিংসতায় তাতে ছেদ পড়ে। সহিংসতার প্রধানতম শিকারে পরিণত হন হিন্দু জনগোষ্ঠী!
‘‘২০০১ এর নির্বাচন সংখ্যালঘুদের জন্য ছিল অভিশাপ। ওই নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনদের হিংসাত্বক তৎপরতায় দেশের সংখ্যালঘু, ভিন্ন মতাবলম্বী ও শিক্ষকরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। প্রশাসনের অনৈতিক আনুকূল্য ও দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে এসময় এলাকায় এলকায় ব্যাপক লুটতরাজের ঘটনা ঘটে। এসময় অনেকেই ক্ষমতাসীনদের বাহিনী দ্বারা বর্বরোচিত হামলা, নির্যাতনে আহত হন। ক্ষমতাসীনদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে এলাকা ছেড়ে যায় বহু সংখ্যালঘু।’’–‘এসেছে নির্বাচন, বাড়বে নির্যাতন-আশংকায় সংখ্যালঘু’- রঞ্জন বকসী নুপু-দৈনিক সংবাদ ১৩.১৩.২০১৩
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় মঙ্গলপুর ইউনিয়নের একাধিক গ্রামে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন সংখ্যালঘুরা। শিকারপুর, রঘুনাথপুর, ধনগ্রামের সংখ্যালঘুদের মারধর, ভাংচুর, লুটপাটের ঘটনা ঘটায় আওয়ামী লীগ নেতা ও মঙ্গলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কছিমুদ্দিন আহমেদ শুকুর গুন্ডা বাহিনী।
যারা এই লেখা পড়ছেন তারা সম্ভবত খুব অবাক হচ্ছেন যে, আওয়ামী লীগ নেতার হাতেই এমন ঘটনা সম্ভব কি না? এমন প্রশ্ন কাজ করে আমার নিজের মধ্যেও। কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার তথ্য জানতে যখন এলাকায় যাই তখন দেখি এধরনের নির্যাতনে জামায়াত-বিএনপিকে যদি ওস্তাদ বলা যায় তাহলে অনেক ঘটনায় আওয়ামী লীগাররাও সাগরেদ হয়ে থাকে। বিরলের ঘটনায় কছিমুদ্দিন আহমেদ শুকু রীতিমত ওস্তাদের ভূমিকা পালন করেছেন।
যেভাবে ঘটনা শুরু : আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী সতীশ চন্দ্র রায়ের নির্বাচনী আসন দিনাজপুর-২ (বর্তমানে বিরল-বোচাগঞ্জ নিয়ে এই আসন গঠিত। পুর্বে আসনটি ছিল বিরল-কাহারোল নিয়ে)। তিনি একটানা ৪ দফা এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার নির্বাচনে প্রধানতম সহযোগি ছিলেন শুকু চেয়ারম্যান । মঙ্গলপুর ইউনিয়ন পরিষদে একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান তিনি। থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন স্বাধীনতার পর থেকে। তাই এলাকায় প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট।
.jpg)
কছিমুদ্দিন আহমেদ শুকু ২০১১ সালের নির্বাচনে দিনাজপুর-২ আসনে আওয়ামীলীগ থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। সতীশ চন্দ্র রায়কে ঐ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু দলের মনোনয়ন পেতে তিনি ব্যর্থ হন। যথারীতি নৌকার প্রার্থী হন সতীশ চন্দ্র রায়। এখান থেকে দুজনের বিরোধ শুরু। শুকু চেয়ারম্যান হিংস্র হয়ে উঠেন। শপথ করেন এই বলে, ‘অক মুই যেইস থাকি তুলি আনিছু ফের সেইথেনায় নিয়া যাম ( ওকে আমি যেখান থেকে তুলে এনেছি আবার সেখানেই নিয়ে যাব)।
শুকু দলীয় মনোনয়ন না পেলেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ৮ম সংসদের নির্বচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। নির্বাচনী প্রচারনায় সতীশ চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে খোলামেলা বলতে থাকেন। “পলিয়া, মালাউন” ইত্যাদি অসৌজন্যমূলক শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি সতীশকে আক্রমন করতে থাকেন নির্বাচনী সমাবেশের বক্তব্যে। একথাও বলেন যে, সতীশ মন্ত্রী থাকাকালে বিরল যেন ভারতের মত হয়ে গেছিল। হিন্দুরা বিরলকে ভারত মনে করত। তাই আবার ভারত হতে না চাইলে সতীশকে ঠেকাও।
কিন্তু অনেক কিছু করার পরেও শুকু বুঝতে পারেন যে, নির্বাচনে তিনি নিজেতো জিতবেন না, সতীশকেও ঠেকাতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। অথচ এই নির্বচনে তার মূল লক্ষ্য সতীশকে যেখান থেকে তুলে এনছেন সেখানেই ফিরিয়ে দেয়া। তিনি বুঝে ফেলেন বিশেষ কারিশমা ছাড়া নৌকার জয় ঠেকানো কঠিন। এরপর তার আঁতাত হয় ৪ দলীয় জোট প্রার্থী মাহবুবুর রহমানের সাথে। আঁতাতের অংশ হিসেবে শুকু তার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বসবাসরত হিন্দুদের বলে দেন, তারা যেন নির্বাচনে ভোট দিতে না যায়। কিন্তু হিন্দুরা এই নির্দেশনা মানতে রাজি ছিলনা। তাদের বক্তব্য ছিল, ভোট দেয়া তাদের অধিকার। তাই তারা ভোট দিতে যাবে।
.jpg)
শুকু বুঝে নেন হিন্দুরা তার কথা শুনছেন না। এরপরই গুন্ডা বাহিনী লেলিয়ে দেন হিন্দুদের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের আগের রাতে এবং নির্বাচনের দিন সকাল বেলা রঘুনাথপুর, শিকারপুরসহ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে শুকুর ছেলে হায়দারের নেতৃত্বে ব্যাপক হামলা চালানো হয়। হিন্দুদের মারধর, তাদের বড়ি-ঘর ভাংচুর ও মালামাল লুটপাট করা হয়। হামলা ও নির্যাতনের শিকার প্রায় ৫হাজার হিন্দু ভোট দিতে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনী ফলাফলে নৌকা সাড়ে তিন হাজার ভোটের ব্যবধানে ৪ দলীয় জোটের ধানের শীষের কাছে হেরে যায়।
নির্বাচন শেষ হলেও শুকুর গুন্ডাদের তান্ডব অব্যাহত থাকে। হিন্দুদের ‘শিক্ষা’ দিতে তার ধারাবাহিক নির্যাতন চলতে থাকে বিভিন্ন সময়ে। ভয় ও আতংকে এবং নিজেদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় মঙ্গলপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শত শত হিন্দু ভারতে চলে যায়। শুকুর অত্যাচারে ভারতে পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন হলেন:
রঘুনাথপুর গ্রামের
১. নোবানশু বর্মন,
২. দেবীমালা বর্মন,
৩. অমর্ত বর্মন,
৪. কৃষ্ণ বর্মন
৫. বিনয় বর্মন,
৬. বিনুমালা বর্মন,
৭. হরেন্দ্রনাথ রায়,
৮. বাঙ্গরু চন্দ্র রায়,
৯. ফটিক চন্দ্র রায়,
১০. মোহন লাল রায়।
শিকারপুর গ্রামের
১. তিনট চন্দ্র রায়,
২. ধীরেন চন্দ্র রায়,
৩. রবিন চন্দ্র রায়,
৪. রাজেন চন্দ্র রায়,
৫. টুকুলু চন্দ্র রায়,
৬. ভকুলু চন্দ্র রায়,
৭. পরেশ চন্দ্র রায়,
৮. ফুলকলি রায়,
৯. ভেদুয়া চন্দ্র রায়,
১০. মেনুকাবালা রায়,
১১. সদানন্দ রায়,
১২. কবিতা রায়
১৩. হরিপদ রায়,
১৪. তিলকবালা,
১৫. ছত্রিশ রায়,
১৬. সমিলা রায়,
১৭. আজেন রায়,
১৮. গরিবালা রায়,
১৯. প্রমোথ রায়,
২০. নীলাবালা রায়,
২১. সুবিন রায়,
২২. অবিন রায়,
২৩. ছবিন রায়,
২৪. কৃষ্ণ কান্ত রায়,
২৫. গীতা রায়,
২৬. মাঘু রায়,
২৭. ক্ষিরোবালা রায়,
২৮. উকিন রায়,
২৯. সত্যেন রায়,
৩০. অতিন রায়,
৩১. ডেভিদ চন্দ্র রায়,
৩২. অঞ্জনা রায়,
ধনগ্রাম গ্রামের
১. পাঁটাসু রায়
নোবানশু বর্মন, তার স্ত্রী দেবীমালা বর্মন, পুত্র অমর্ত বর্মন, কৃষ্ণ বর্মন ও বিনয় বর্মন ও মেয়ে বিনুমালা বর্মন ২০০১
সালে হামলার শিকার হওয়ার বছরখানেকের মধ্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যায়। ভারতের কালিয়াগঞ্জে আগের থেকে বসবাসরত তাদের আত্মীয় স্বজনের উপর ভরসা করে তারা স্বপরিবারে সেখানে যান। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। নোবানশুর আরেক পুত্র বদরু বর্মনও ঐ সময় ভারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পরে ফিরে আসেন। এখন রঘুনাথপুরেই বসবাস করছেন। তার বর্তমান বয়স ৩২। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ তার সাথে আমার (লেখকের) দেখা হয়েছিল মঙ্গলপুর ইউনিয়নের শিকারপুর বাজারে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার মা-বাবা, ভাই-বোন কেন দেশ ছেড়ে গেছেন?
উত্তর দেন বদরু এভাবে, ‘২০০১ সালের নির্বাচনত যা হইছে তা হামরা ভাষায় কহিবা পারমোনা। হামলা হওয়াতে সব্বাই ভয়ে অস্থির। মুক্তিযুদ্ধের সময় হামার এক কাকা মারা গেইছিল। এতে করি আব্বা বইললেন, অনেকে ইন্ডিয়া যাছে, হামরাও যাই। তারপর সবাই গেইল। আমিও গেইছিলাম, কিন্তু ভাল না লাগায় ফিরে আসিছি। ২০০১ সালত মোর বাড়িত যে অত্যাচার হইছে তাতে পাশের বাড়িগেলাও ভয়ে কুঁকড়ি গেইছিল। এই রকম অনেক লোক তখন ভয় নিয়া চলি গেইছেল। ওমরা আর আইসেনাই।
বদরু ফিরেছেন। তার মত আরো একজন ফিরেছেন। তিনি শিকারপুরের হরিপদ রায়। ভারত থেকে ফিরে এসে এখন নিজ বাড়িতে আছেন। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ তাকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঘর-বাড়ি ফেলে কেন গিয়েছিলেন?
হরিপদ বলেন, ‘পিটাপিটি মারামারিতে অতিষ্ট হই গেইনো। হাট করিবার গেইলে তোমার (লেখকের) স্বজাতিরা (মুসলমান) হাট করিবার দেয়না! মারেছে! এইলার তনে চলি গেইছিনো।”
হরিপদ বলতে থাকেন, ‘২০০১ সালোত নির্বাচন হইল। ভোট দিয়া বাড়িত আসিই নাই, তাতেই মারদাঙ্গা শুরু হই গেইল! দিনের পর দিন মাসের পর মাস লুকাই থাকিবা হইছে। গোরতে একখান বিল আছে, বাহাই বিল। সেইথে লুকাই থাকিছি। কখনো দিনোত লুকাইছি, কখনো রাইতত লুকাইছি। শয়তানগেলা এমন করি ফেলাইছিল যে, বাজারত উঠা যাছেলোনা, এ্যাংনা নুন পর্যন্ত আনা যাছেলোনা। এমন অবস্থা ভোটের একদিন আগের থাকি শুরু হই গেইছিলো। দেড় বছর খালি পালাই থাকিছি। এইভাবে হিন্দুগেলাক শেষ করি দিলো। হামার এইথে হউক আর অন্য জায়গাত হউক, হিন্দুলা শেষ হই গেইল। হামরা বাজারত, মঙ্গলপুরত কোনঠি যাবার পারছিনো না। একবারে ছারখার হই গেইনো। তখন একদিন আলাপ আলোচনা করিয়া সবাই একসাথে রওনা দিনো।
-একসাথে রওনা দিলেন? কতজন রওনা দিলেন?-প্রশ্ন করি আমি।
হরিপদ বলেন, ‘১৭ পরিবারের প্রায় ১০০ জনের মত। ছত্রিশ রায়, আজেন রায়, ভেদুয়া চন্দ্র রায়, সদানন্দ রায়, প্রমোথ রায়, সুবিন রায়, অবিন রায়, ছবিন রায়, কৃষ্ণ কান্ত রায়, মাঘু রায়, উকিন রায়, সত্যেন রায়, ,অতিন রায়, ডেভিদ চন্দ্র রায়, পরেশ চন্দ্র রায়ের পরিবার, হামার পরিবার সহ ১৭ পরিবার। দিনের বেলা বাড়িত থাকি বের হই। পাকুড়া সমকানী সীমান্ত দিয়া গভীর রাইতত ভারত যাই।’
-আবার ফিরে এলেন কেন?
হরিপদ বলেন, ‘ভারতে খারাপ ছিনো না। সেইখানকার লোকজন সহযোগিতা দিছে। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাইছে, রেশনও দিছে। কিন্তু যাওয়ার দেড় বছর পর মেয়ে দীনুবালার অসুখের খবর পাই। সে এইথেনায় জামাইক নিয়া ছিল। তার কঠিন অসুখের খবর পাই মন মানিলনা। মেয়েক দেখিবার আসিয়া আর যাই নাই। কিন্তু হামার আরো বেটা-বেটি ইন্ডিয়াত এখনো আছে।’
.jpg)
শিকারপুরে নিজের জমিতে কাজ করছিলেন ষাটোর্ধ হরিপদ রায়। তার সাথে কথা হচ্ছিল সেখানেই। আলাপের সময় সেখানে বেশ ক’জন মহিলা ছিলেন। তাদের একজন প্রমিলা রায় বললেন, ‘হামাক দিনের পর দিন পালাই থাকিবা হইছে। জারের সময়ও (শীতে) পুকুরে যাইয়া হাটু পানিতে জলুকের (এক ধরনের রক্তচোষা প্রাণী) মধ্যে লুকাই থাকিবা হইছে। মুছলমানলা হামার উপর যে নির্যাতন কইরছে তা মনে পইড়লে গা শিউরি উঠে।’
শিকারপুর, রঘুনাথপুর কিংবা মঙ্গলপুর কোথায় কোন মুসলমানের নেতৃত্বে হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে তা প্রকাশ্যে কেউ বলেন নাই। হামলা কে করেছে? প্রশ্ন করলেই ভয় আর আতংক নিয়ে বেশ ক’জন বলেন, ‘হামরা এ্যালায় নাম কঁহু আর পরে হামারউপর হামলা হউক’?
.jpg)
শিকারপুরের ৯০ বছর বয়সী বিধবা জয়মুনি জানালেন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর ‘হিন্দুর উপর পিটাপিটিতে’ তার স্বামী যতিন চন্দ্র রায় হার্ট এটাক করে মারা যায়। সকালে ঘরের ভিতরে তাকে মৃত পাওয়া যায়। স্বামী যখন মরা তখনো তার মেয়ে এবং ছেলের বউ লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল।
তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘বাঃ (পুত্রতুল্য সম্বোধন), হিন্দুর উপর কি নির্যাতন বন্ধ হবে নাই?’
আমি জয়মুনির প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নাই। তার কথায়, বাচনভঙ্গিতে শুধু উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। তিনি বলেন, যদি ঐ পিটাপিটিটা না হইলে হয়, মুছলমানগেলা হামলা না কইরলে হয় তাইলে মোক বিধবা হবার হইলনাহয়।’
-কনতো, কোন মুসলমান হামলা করেছে? প্রশ্ন করি আমি।
জয়মুনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কে নির্যাতন করেছে তোমরা কি বুজেন না? তাইলে তোমরা কিসের সাংবাদিক?’
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা এভাবে প্রকাশ্যে কারো নাম বলা এড়িয়ে গেছেন। তাদের ভয় আর আতংক এত বেশি যে, তারা মনে করেন, নাম বললেই হয়তো আবার হামলার শিকার হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রশাসনের উপর তাদের কোন আস্থা নাই। হামলা হলে প্রশাসন হামলাকারীদের পক্ষেই থাকে এটা তারা বিভিন্ন সময়ে দেখেছে।
অবশ্য প্রকাশ্যে না বললেও গোপনে অনেকেই বলেছেন। তারা সকল ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন কছিমুদ্দিন আহমেদ শুকুকে। সতীশ চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের স্পৃহায় হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা শুরু করেছিলেন তিনি তা বিভিন্নভাবে অব্যাহত রেখেছেন এখনো।
তিনি শিকারপুর বাজার সংলগ্ন একটি হিন্দু পরিবারের পুকুর দখল করার লক্ষে ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছেন। মোল্লাহার দিঘী নামের ঐ পুকুরের ভোগদখলরত গোপেন চন্দ্র রায় একাধিকবার নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলা করেছেন শুকু ও তার পুত্রের বিরুদ্ধে।
.jpg)
গোপেন রায় মোল্লাহার দিঘী নামের ঐ পুকুরটি ভোগ দখল করে আসছেন বাংলা ১৯৫৩ সাল থেকে। তার বক্তব্য এবং মামলার বিবরণ অনুযায়ী তিনি ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে পুকুরটি নিয়েছিলেন। তার দখলসত্বের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় সব ধরনের দলিল রয়েছে। কিন্তু একটি ভুয়া কাগজ তৈরী করে ২০০৯ সালে শুকু ও তার ছেলে হায়দার ৪/৫শ লোক নিয়ে পুকুরটি দখল করতে যায়। তারা গোপেনের স্ত্রী জনতা রানীর হাত ভেঙ্গে দেয়। পুত্র প্রণব কুমার রায়ের মাথা ফাটিয়ে দেয়।
২০০১ সালেও শুকু বাহিনী জনতা রানীর ওপর হামলা করেছিল এবং ঢিলমেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। তখন কোন মামলা না করলেও ২০০৯ সালের ঘটনায় শুকু, তার পুত্র হায়দার ও মামুন, তাদের সহযোগি সাইফুল, মন্টু, মহসীন, বাবুলসহ তাদের গুন্ডাবাহিনীর আরো অনেকের বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের করেন গোপেন চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, পুকুর দখল করতে শুকু চেয়ারম্যান নিজেই এসছিল। পুকুরপাড়ে বসে থেকে সে ছেলেদেরকে একে ধরো ওকে মারো বলে হুকুম দিচ্ছিল। তার নিদের্েেশই তার ছেলেরা আমার স্ত্রীকে লাঞ্চিত করে, পুত্রের মাথা ফাটিয়ে দেয়।
মঙ্গলপুরের কয়েকজন লেখককে তাদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুকু চেয়ারম্যান ডেয়ারিং লোক। বিগত নির্বাচনে তার ছেলে আব্দুস সালাম পিতার বিরুদ্ধে অন্য প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। এর প্রতিশোধ নিতে শুকুর লোকজন আব্দু সালামের জামাইকে পর্যন্ত খুন করে!
সংখ্যালঘু নির্যাতনের গডফাদার হলেন শুকু চেয়ারম্যান। ২০০১ সালের নির্বাচনে তার কথা না শোনার জন্য সেই যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন শুরু করেছেন তা অব্যাহত আছে এখনো। তার ভয়ে তটস্থ হিন্দুরা। তবে তিনি বরাবরই তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে থাকেন।
শুকু চেয়ারম্যান যা বলেন :
সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে শুকু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে লেখকের কথা হয়। সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো;
প্রশ্ন : আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো আপনি সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করেছেন, এখনো করছেন এবং হুমকী দিচ্ছেন?
শুকু : ২৭ বছর ধরে হিন্দুরা আমাকে বার বার চেয়ারম্যান করেছে। তারা আমাকে দেবতা জানত, এখনো জানে। তাদের যে কোন সমস্যা হলে এখনো তাদেরকে সাহায্য করি। কাজেই আমি বোকা না যে তাদের উপর হামলা চালাব, হুমকি দিব।
প্রশ্ন : কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আপনি আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী সতীশ চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন, তাকে ঠেকাতে তান্ডব চালিয়েছেন?
শুকু : সতীশকে এমপি বানানোই আমার ভুল হয়েছে। স্বাধীনতার পর হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি বিরল থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলাম। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জেলা আওয়ামীলীগ নমিনেশন দিল আমাকে। আমি ছিলাম অধ্যাপক ইউসুফ আলীর (সাবেক মন্ত্রী, মুজিবনগর সরকারে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক) শিষ্য। তিনি যখন মই মার্কায় মিজান গ্রুপে প্রার্থী হলেন আওয়ামীলীগের কর্মীরা তার দিশারী হলেন। কিন্তু তিনি যে ডাইভার্ড হয়ে গেছেন সেটা কাউকে বোঝাতে পারিনি। আমি দেখলাম, নিজে বর সাজলে বরযাত্রী পাব না। তখন বহু চিন্তা ভাবনা করে সতীশ বাবুকে বর সাজালাম। সতীশ রাজনীতি জানতনা। শিক্ষকতা করত, স্কুল আর বাড়িতে যাতায়াত করত। যদি তাকে ডেকে তার জন্য রিস্ক না নিতাম তাহলে আজ পর্যন্ত আমিই এমপি থাকতাম। তাকে প্রার্থী করতে গিয়ে ঢাকায় তোফায়েল ভাইয়ের (বর্তমানে মন্ত্রী) সাথে কি ঝগড়া। তিনি বললেন, ডিষ্ট্রিক্ট তোমাকে নমিনেশন দিল আর তুমি দিলা কি না একজন হিন্দুকে, যে কি না জীবনে রাজনীতিতে ছিলনা!
আমার জীবনে এটাই ভুল যে, তাকে (সতীশ) আমিই রাজনীতিতে নিয়ে এসেছি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আমি আওয়ামীলীগের মনোনয়ন নিব, সতীশ নেবে না এরকম একটা কথা হয়েছিল তার সাথে। কিন্তু তিনি সেই কথা রাখলেন না, নিজেই নমিনেশন নিলেন। তখন আমি বিদ্রোহী প্রার্থী হলাম আর সিদ্ধান্ত নিলাম যে, সে যে (সতীশ) রাস্তায় ছিল, আবারো তাকে সেখানেই নিয়ে যাব।
প্রশ্ন : নির্বাচনের সময় সে কারণেই আপনি হিন্দুদের উপর নির্যাতন করলেন আর এখনো করছেন?
শুকু : আমি নির্যাতন করিনাই, এখনো করছিনা। কাউকে হুমকিও দেই নাই। এটা করেছে বিএনপির লোকেরা। কিন্তু ব্লেইমটা দেয়া হয়েছে আমার উপরে। বরং সেই সময় আমি হিন্দুদেরকে প্রটেকশন দিয়েছি। অপরদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী নমিনেশন পাওয়ায় সতীশ রায় প্রকাশ্যে ধানের শীষের পক্ষে টাকা বিলি করেছে এবং ভোট চেয়েছে। এটা খালিদ নিজে জানে,শেখ হাসিনাও জানেন।
প্রশ্ন : কিন্তু নির্যাতিতরা প্রকাশ্যে না বললেও গোপনে আপনার বিরুদ্ধেই বলছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে ভারতে চলে গেছে।
শুকু : ২০০১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন হিন্দু পরিবার ভারতে গেছে বলে আমার জানা নাই। এমনিতেই কত হিন্দুর ছেলে এখানে আছে কিন্তু তাদের বাপ আছে ইন্ডিয়ায়। চ্যালেঞ্জ করে বলব, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেউ ভারতে যায় নাই।
সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা কথা কেউ কখনো স্বীকার করতে চায়না। এইসব বিষয় নিয়ে প্রশাসনও খুব একটা মাথা ঘামাতে চায়না। যারা নির্যাতিত হয় সাধারণভাবে তারা দরিদ্র। তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ করতে পারেনা আবার আইনী সহায়তা নিতেও আগ্রহী থাকেনা। এর কারণ আইনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কোন লাভ হয়না। ফলে যারা নির্যাতন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তারা নির্যাতন চালাতেই থাকে, গলাবাজিও চলতে থাকে। তাদের কোন শাস্তি হয় না।
অন লাইনে পত্রিকার লেখা- কলংকের জঞ্জালে নিপতিত দিনাজপুর
এই লেখা পরিশ্রম করে লেখা। সত্যি সত্যি সাংবাদিকতা করা হয়েছে বোঝা যায়। আজকাল মেনস্ট্রিম সংবাদপত্রে সংবাদিক পাওয়া যায় না। তাই আপনার এই তৃণমূল স্তরে গিয়ে রিসার্চ করা লেখা পড়ে ভাল লাগল।
বাংলাদেশে ধিরে ধিরে হিন্দু কমে যাচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে-ও হিন্দু কমছে, মুসলমান বাড়ছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুর জেলায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু। আসলে দুই বাংলা হিন্দু হল কি মুসলমান সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মের যা চরিত্র আজকের দিনে দেখা যাচ্ছে তাতে ইসলামি মত ও সংস্কৃতি-ই যদি বাংলার মূল ভাব হয়ে দারায় তা ভাল হবে না বলেই মনে হয়।
LikeLike
লেখাটা লিখেছেন- প্রিয় বালা বিশ্বাস। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা
LikeLike