“ইনতেকাম” শব্দের অর্থ প্রতিশোধ। ইনতেকাম নিতে গিয়েই ইসলামের প্রথম উগ্রবাদী দল ও কোরানের প্রথম রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়। ইসলামের প্রথম উগ্রবাদী দলের জন্ম কোন প্রেক্ষিতে হয়েছে এবং কোরান কীভাবে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহৃত হয়, শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব কীভাবে শুরু হয় সবকিছুর পেছনে রয়েছে এই ইনতেকাম!
নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আরবের রাষ্ট্র প্রধান অর্থাৎ খলিফা কে হবে তা নিয়ে খলিফা পদের দাবীদাররা দ্বন্দ্ব জড়িয়ে পড়েন। খলিফা প্রতিযোগিতার সবাই ছিলেন নবীজির আত্মীয়: শ্বশুর, মেয়ে জামাইরা, চাচাত ভাই। ফলে নবীজির লাশ ফেলে রেখে চলে খলিফা নির্বাচনের লড়াই। এখানে স্মরণ রাখা উচিত আত্মীয়তার চাদরে মূলত আরবের গোত্র গত দ্বন্দ্বই আবার মাথা চাঙা দিয়ে উঠে।
নবী মুহাম্মদ ও সুফিয়ান (মুয়াবিয়ার পিতা) কোরাইশ বংশের দুই গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের দুই জনের পূর্ব পুরুষ ছিলেন আবদে মনাফ। আবদে মনাফের দুই পুত্র ছিল: আবদে শামস ও আবদে হাশিম। পরবর্তীতে ক্ষমতার লড়াই চলে এই গোত্রের মধ্যে। আবদে শামসের মৃত্যুর পর পুত্র উমাইয়া নেতৃত্বের দাবী করলে এই নিয়ে আবদে হাশিমের সাথে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এর ফলে কোরাইশরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়: হাশিমী গোত্র ও উমাইয়া গোত্র। মক্কার কাবা গৃহের দায়িত্ব চলে যায় হাশিমী গোত্রের হাতে অন্যদিকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব যায় উমাইয়া গোত্রের হাতে। কাবা শরীফ হাত ছাড়া হওয়ায় উমাইয়া গোত্র অর্থের দিক থেকে হাশিমী গোত্র থেকে পিছিয়ে পড়েও প্রশাসনিক দক্ষতা, কূটনৈতিক বিষয়ে তারা বেশ দক্ষতা অর্জন করে। ফলে দিনকে দিন হাশিমী ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে বিরোধ বাড়তেই থাকে। এমনকি এক দলের হাতে অন্যদলের রক্তারক্তি ছিল তৎকালীন স্বাভাবিক ঘটনা। কালের পরিক্রমায় হাশিমী গোত্রে জন্ম নেয় নবী মুহাম্মদ ও হযরত আলি। হযরত আলি ছিলেন নবীর সবচেয়ে কাছের মানুষ। সম্পর্কে তাঁর চাচাত ভাই ও মেয়ের ( হযরত ফাতেমা) জামাই ও প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী। যিনি কখনো মূর্তি পূজাও করেন নি।
আলির বীরত্বের জন্যে আলি’কে বলা হতো Lion Of God. নবী মুহাম্মদ ও খাদিজার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন হযরত আলি। ইসলাম ধর্ম যখন শিশু ঘরে সেই সময় থেকেই আলি নবী মুহাম্মদের ইসলাম জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেন। এমনকি কোরাইশরা যখন নবী মুহাম্মদকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আলি নবীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। নবীজির সাথে আলি’র সম্পর্ক কীরূপ ছিল তা বোঝা যায় নবীজির এই উক্তিতেই-“যে লোক আমার আলিকে দুঃখ দেবে, মনে করো সে আমাকেই দুঃখ দিল, যে লোক আমার আলির বিরুদ্ধাচরণ করবে, মনে করো সে আমারই বিরুদ্ধাচরণ করলো।” এছাড়াও নবীজী যখন স্ত্রীগণের উপর বিরক্ত হয়ে তাদের ত্যাগ করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন-“প্রফেটের তরফ থেকে আলি চাইলে যে কোন নবী-পত্নীকে ডিভোর্স দিতে পারবেন।”
খলিফা ইস্যুতে কথা উঠলে সকল ঐতিহাসিকগণ একটি কথা বলে থাকেন যে, নবী মুহাম্মদ খলিফা নির্বাচন করে যেতে পারেন নাই। সুতরাং কথাটি স্পষ্ট যে তিনি চেয়েছিলেন খলিফা নির্বাচন করতে কিন্তু খলিফা নির্বাচন করে যেতে পারেন নাই। মৃত্যু শয্যায় তিনি কাগজ কলম আনতে বলেছিলেন তখন ওমরের বাঁধার কারণে নবীজি আসলে কাকে খলিফা করে যেতেন কিংবা নির্দেশ দিতে চেয়েছিলেন তা আর জানার কোন সুযোগ নেই। ফলে নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর সাথে সাথে খলিফা পদের ভাগীদাররা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। আলি যখন তাঁর প্রিয় নবীকে গোসল করাচ্ছিলেন সেই ফাঁকে বৃদ্ধ আবু বকরকে খলিফা নির্বাচিত করা হয়। এখানে স্মরণ রাখা উচিত ওসমানের মৃত্যুর পর জনগণের তরফ থেকে আলি’কে খলিফা নির্বাচিত করা হোক এমন দাবী ওঠা ছাড়া কোন খলিফাই গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় দখল করেনি। বৃদ্ধ আবু বকরকে প্রথম খলিফা করা হয় উমাইয়া গোত্রের কাছে যেন ক্ষমতায় আসে সেই লক্ষ্যে। কারণ বৃদ্ধ আবু বকরকে খলিফা করা হলে স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী ক্ষমতা চলে আসবে উমরের হাতে এবং পরবর্তীতে খলিফার দাবীদার হবে উমাইয়ারা। অন্যদিকে হাশিমী গোত্রের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন আলি।
শিয়ারা নবী মুহাম্মদের কন্যা, আলির স্ত্রী হযরত ফাতেমা’কে হলি মা হিসেবে গণ্য করেন। যেভাবে খ্রিস্টানরা মাতা মরিয়মকে হলি মা হিসেবে দেখেন। ফাতেমা বিবি খাদিজা ও নবীর কন্যা ছিলেন, ছিলেন আলির স্ত্রী এবং ইমাম হাসান-হোসেনের মা। সে জন্যে তিনি শিয়াদের কাছে পবিত্র মাতা হিসেবে বিবেচিত। নবী মুহাম্মদ মারা যেতে না যেতেই খলিফার পদ দখলকে কেন্দ্র করে মা ফাতেমা’র ঘরে আগুন দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ওমর। অথচ ইসলামের প্রথম যুগে বিশ্বাস ও আইন ছিল যে- যে ব্যক্তি মুসলিম হয়ে অন্য মুসলিমকে হত্যা করবে সে জাহান্নামে যাবে। এটি ছিল ইসলামের মূল বিশ্বাসের একটি। এবং কোন ব্যক্তি এই কাজ করলে তার কঠিন সাজার হুকুম ছিল। কিন্তু হযরত ওসমানের সময় হযরত ওমরের পুত্রের হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তির মধ্য দিয়ে সাম্যবাদ ইসলামের আরেক দফা ভাঙনের সূত্রপাত হয়। হযরত ওমরের পুত্র ওবায়দুল্লাহ একসাথে তিনটি খুন করে। এর নিহত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন মুসলিম। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মে সবাই আশা করেছিল ওবায়দুল্লাহ ফাঁসির হুকুম হবে কিন্তু হযরত ওসমান ওবায়দুল্লাহ’কে বেকসুর খালাস দেন। অনেকেই ইতিহাস না জেনে কিংবা এক ধরনের কল্পনা প্রসূত ধারণা থেকে বলে থাকেন যে, ইসলামের সত্যযুগ ছিল চার খলিফার আমল। অথচ ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ক্ষমতার লোভে আরবের গোত্র দ্বন্দ্ব মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠে। সেই দ্বন্দ্বে আহত হয়ে গর্ভাবস্থায় মারা যান নবী মুহাম্মদের কন্যা হযরত ফাতেমা। ওমর ফাতেমার ঘরে ঢোকার জন্যে দরজায় জোরে লাথি মারেন। দুর্ভাগ্যবশত এই লাথিতে আহত হোন ফাতেমা। পরবর্তীতে তিনি তাঁর স্বামী’কে বলে যান-তিনি মারা গেলে তাঁর দাফন যেন অতি গোপনে করা হয় তাতে ওমরের মতন লোক তাঁর জানাজায় অংশ নিতে না পারে। পরবর্তীতে তার নির্দেশ অনুসারেই রাতের আঁধারেই তাঁকে দাফন করা হয়। বনু হাশেমের গোত্রের মানুষ ছাড়া খুব কম সংখ্যক সাহাবী জানাজায় শরীক হোন। এখানে পয়েন্ট করর বিষয় হল; অন্য খলিফাদের দাফন নবীর কবরের পাশে হলেও ফাতেমার কবর হয় অন্যত্র। (রাতের আঁধারে কবর দেওয়ার প্রসঙ্গে ভিন্ন মত আছে অনেকেই বলেন যে; তিনি লজ্জাবতী ছিলেন তাই ওনার কবরে যাতে বেশি মানুষ না আসে তার জন্যে রাতের আঁধারে করব দেওয়া হয়।) এছাড়াও আবু বকরকে খলিফা করায় আলি, ফাতেমা অসন্তুষ্ট হোন। পরবর্তীতে পিতার সম্পত্তির ভাগ চাইলে আবু বকর ফাতেমাকে বলে দেন যে, এই সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় ভাবে দান করা হয়েছে। সুতরাং এই সম্পত্তির ভাগ তিনি ফাতেমাকে দিতে পারেন না।
হযরত আয়েশা ছিলেন নবীজির পুরাতন সাহাবি আবু বকরের কন্যা। হয়রত আয়েশা ছিলেন সুন্দরী অহংকারী মহিলা। কিন্তু সেই অহংকারেও চূর্ণ হয় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। গলার প্রিয় খুঁজতে গিয়ে তিনি তিনি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁকে ফেরে রেখেই সবাই চলে যায়। সেই সময় সাফওয়ান নামক এক সাহাবির সাথে দেখা হয়। কারণ সাফওয়ান ছিলেন কাফেলার পেছনে আসা শেষ মানুষ। সাফওয়ান নবীর স্ত্রীকে চিনতে পারেন এবং নিজের উঠের পিঠে করে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। ২০ মাইল দূরে মধ্যরাতে আয়েশা নিজের দলে এসে পৌছাতে সক্ষম হোন। আয়েশা যে মিসিং ছিলেন তা কেউ খেয়ালই করে নি। কিন্তু দেরি করে ফিরে আসা নিয়ে অনেকে তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে থাকেন। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে যে হযরত আয়েশা ছিলেন পবিত্র ও নির্দোষ। কিন্তু আরবের লোকেরা নবী পত্নী হওয়ার পরও আয়েশার নামে কুৎসা রটানো বন্ধ করে নাই। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলি ও ফাতিমা আয়েশা’কে ডিভোর্স দিওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু নবীজি তা দেন নি। এরপর প্রায় এক মাস পর নবীজি ঘোষণা করলেন যে, আল্লাহ বলেছেন- যে ব্যক্তি নবী পত্নীর বিরুদ্ধে অহেতুক কুৎসা রটনা করবে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এবং কোন অভিযোগ করতে করলে কম করে চারজন ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে থাকতে হবে। বর্তমান শরিয়া আইনে যে চারজন পুরুষ সাক্ষীর কথা বলা হয় তা এই ঘটনা থেকে ধার করা কিংবা এই ঘটনা থেকে শরিয়া আইনটি করা হয়। যদিও আয়াতটি ছিল এক অসহায় নির্দোষ নারীকে অপবাদ করা থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। কারণ চারজন মানুষের সামনে বা সাক্ষী রেখে কেউ অপরাধ করবে না সুতরাং বর্তমানে যারা শরিয়া আইনের পক্ষে কথা বলে তারা আসলে অপরাধীর পক্ষেই কথা বলছে। যাই হোক আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরে আসি।
পূর্বের সূত্র ধরেই মনমালিন্যের কারণে হযরত আয়েশা কখনো চান নি হযরত আলি খলিফা হোক। পরবর্তীতে আবু বকর মারা যাওয়ার পর আবু বকরের একজন বিধবা স্ত্রী’কে বিয়ে করেন এবং সে ঘরের পুত্র সন্তান যার নামও ছিল মুহাম্মদ তাকে পুত্র হিসেবে আলি গ্রহণ করেন। সম্পর্কের হিসাবে আলি ও আয়েশা মেয়ের জামাই-শাশুড়ি আবার অন্যদিকে কন্যা-পিতার সম্পর্কেও জড়িয়ে যায়। তবে তৎকালীন আরব সমাজে এটি স্বাভাবিক একটি প্রথা হিসেবে বিবেচিত ছিল। তবে শিয়ারা হরত আয়েশাকে পবিত্র নারী হিসেবে জ্ঞান করে না। তারা কারণ হিসেবে উল্লেখ করে যে, আয়েশা যদি শুদ্ধতম নারী হতেন তাহলে আল্লাহ তাঁকে শাসন করার জন্যে সুরা নাজিল করতেন না। তার নামে কুৎসা রটানোর সাহসও কেউ পেত না। তাই নবীর পরিবার বলতে শিয়ারা ফাতেমার পরিবারকে বুঝিয়ে থাকেন। এই বিষয়ে রেফারেন্স হিসেবে নবীজির বিভিন্ন উক্তি, ঘটনার বর্ণনা ও হাদিস রেফারেনস হিসেবে তারা ব্যবহার করে থাকে।
ওমর মারা যাওয়ার আগে নিজের স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার জন্যে ওমর খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন আব্দুর রহমান বিন আউফ ও তার ওমরের পুত্র আব্দুল্লাহ হাতে। তারা যখন ষড়যন্ত্র করে নবী মুহাম্মদের দুই কন্যার স্বামী সত্তর বয়স্ক ওসমানের নাম ঘোষণা করেন তখন হযরত আলি চিৎকার করে বললেন-নাহ আমি মানি না, এটা প্রহসন, ধর্মের নামে মিথ্যাচার, অন্যায়, এটা প্রতারণা। ওসমানের শাসন আমলে আরবে বিদ্রোহ মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠতে থাকে। স্বজনপ্রীতি, দুঃশাসনের কারণে সাধারণ জনতা ওসমানের বাড়িও ঘেরাও করে। এতো কিছু পরও ওসমান ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা ক্ষমতা ছাড়ার জন্য রাজি হয় নাই। ফলে আততায়ীর হাতেই নিজ ঘরে খুন হোন ওসমান। ওসমান খুন হওয়ার পর গুজব কিংবা লোক কানাকানি ছড়িয়ে পড়ে যে এই হত্যায় আলির হাত রয়েছে। আলি-পন্থীরা যে সিংহাসন দখলের জন্যে ২৫ বছর সংগ্রাম করল নির্যাতন সহ্য করল তাদের সেই ক্ষমতা দখলের সময় খুব সুখকর ছিল না। কারণ একদিনে জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ অন্যদিকে ওসমানের বিচারের দাবী। আবার ওসমানকে যারা হত্যা করেছে তাদের একটা বড় অংশ আলির সাথে যোগ দিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আলি ক্ষমতা আরোহণ খুব সুখকর ছিল না।
এখানে স্মরণ রাখা উচিত যে, ইতোমধ্যে আরবের আশে পাশের সব জায়গা, এছাড়া রাজ্য পরিচালনার বড় বড় পদ সবগুলো মক্কার উমাইয়া গোত্র দখল করে নেয়। ফলে মদিনার মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় এছাড়া হাশিমী গোত্রের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন আলি। সিরিয়ার শাসন মুয়াবিয়া ছিলেন যেমন চতুর তেমনি ক্ষমতাধর মানুষ। তার পরামর্শেই মূলত ওসমান শাসন কাজ পরিচালন করতেন। মুয়াবিয়া ছিলেন আবু সুফিয়ানের সন্তান। মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর এক প্রকার বাধ্য হয়ে আবু সুফিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।এছাড়া নবী মুহাম্মদের দলের হাতেই খুন হোন সুফিয়ানদের অন্য সদস্যরা। মুহাম্মদের দলের হাতে আবু সুফিয়ান গোত্রের পরাজয়ের গ্লানি তারা কখনো ভোলে নি। এই কারণেই নবী বংশ ধ্বংস না করা পর্যন্ত মুয়াবিয়া বংশ শান্ত হয় নাই। মুয়াবিয়া সুদর্শন, চতুর, বুদ্ধিমান ছিলেন ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন। মুয়াবিয়া ঠিকই জানতেন পৃথিবীর সবাই মুয়াবিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিলেও আলি কখনো মেনে নেবে না। অন্য দিকে আলিও জানতেন মুয়াবিয়া তাকে ছেড়ে দেবে না। বনু হাশিম ও উমাইয়াদের মধ্যে কীরূপ দ্বন্দ্ব ছিল তা জানার জানা প্রয়োজন-আবু সুফিয়ানের জোয়ান ছেলে নবী মুহাম্মদের বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ায় সেই খুনের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন পুত্রহারা মা হিন্দা। উহুদ যুদ্ধে নবী মোহাম্মদের চাচা আমীর হামজার লাশ কেটে কলিজা বের করে চিবিয়ে খেয়েছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও মুয়াবিয়ার মা হিন্দা। তাই আলি জানত ষড়যন্ত্র করে হোক কিংবা যুদ্ধ করে হোক সে আলিতে পরাজিত করতে চাইবে। অনেকে প্রশ্ন করে যে; ওসমান খুনের বদলা নেওয়াকে কেন্দ্র করে হযরত আয়েশা ও হযরত আলীর মধ্যে যে যুদ্ধ হল তখন মুয়াবিয়া নীরব ভূমিকা পালন করল কেন? এর উত্তর খুন সহজ। কারণ যুদ্ধটা হচ্ছে নবীর পরিবারের মধ্যে তাই মুয়াবিয়া তাদের হানাহানিতে না জড়িয়ে রক্তপাত দেখেছিলেন মাত্র। আলি ও আয়েশার যুদ্ধ ইতিহাসে উঠের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। সেই যুদ্ধে আয়েশা পরাজিত হোন এবং নিজের কর্মের জন্যে আলির কাছে ক্ষমা চান। সেই যুদ্ধে সাহাবিরা অংশগ্রহণ করেন এবং নিহত হোন। তবে জামাল যুদ্ধের দায় নিতে হয় শেষ পর্যন্ত আলিকেই। ইসলামের ইতিহাসে জামাল যুদ্ধ প্রথম যুদ্ধ যেখানে একজন নারীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল আরব পুরুষরা।
৬৫৭ সালের জুলাই মাসে সিরিয়ার সিফফিনের ময়দানে আলির বিপরীতে যুদ্ধে নামে মুয়াবিয়া। সেই যুদ্ধে আলি থেকে কুট কৌশল ও সামরিক সৈন্যে আলি থেকে মুয়াবিয়ার শক্তি বেশি হলেও সেই যুদ্ধে আলি জয়ের পথেই ছিলেন। আলি মুয়াবিয়া থেকে বড় যোদ্ধা হলেও কূটকৌশলে তিনি দক্ষ ছিলেন না। তিনি বড় যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু বড় রাজনৈতিক নেতা নন। ফলে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখে মুয়াবিয়া তার শেষ অস্ত্র ধর্মের আশ্রয় নিলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরানের পাতা লাগিয়ে যুদ্ধ করতে নামলো। এতে আলীর বাহিনীর মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী কুরান সামনে রেখে যুদ্ধ করতে নামায় আলীর বাহিনীর অনেকেই যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তারা মুয়াবিয়ার কথা ফাঁদে পড়ে মুয়াবিয়ার সুরে যুদ্ধ বন্ধ করে কোরানের মাধ্যমে সমাধানের পথে এগুতে বলেন। মুয়াবিয়াও তখন নিজের কিছু লোক আলির শিবিরে পাঠিয়ে ওসমান হত্যাকারীদের বিচারেরও দাবী তোলেন। কারণ মুয়াবিয়া জানতেন এই খুনে আলির হাত না থাকলেও বর্তমানে আলির শিবিরের অনেকেই ওসমান হত্যায় জড়িত। একদিনে ওসমান হত্যার দাবী অন্যদিকে কোরানের মাধ্যমে সমাধানের দাবী সব কিছু মিলিয়ে আলি বুঝে গেছেন তিনি ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন। তিনি তার লোকদের যতোই বোঝেতে চেষ্টা করছেন যে আর কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলে আমরা জিতে যাব। মুয়াবিয়া একটা শয়তান। সে ছলনা করে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছে কিন্তু সে সময় কেউ আলির কথা শুনল না। আলি মুয়াবিয়ার অতীত ইতিহাস সবাইকে স্মরণ করতে অনুরোধ জানান। তারপরও তার সৈন্যরা যুদ্ধ করতে আর রাজা হল না। ফলে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন আলি। এবং এই কারণে পরবর্তীতে আলীর রাজনৈতিক ও ক্ষমতার পরাজয় ঘটে। সিফফিনের ময়দানে মুয়াবিয়ার হাতেই হয় প্রথম কোরানের রাজনৈতিক ব্যবহার। মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধির কারণে আলির পক্ষ অনেকেই ত্যাগ করেন তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাব অন্যতম।
ইসলামের প্রথম উগ্রবাদী দল খারিজি:
ওসমান কে পছন্দ না করলেও ওসমান হত্যায় আলির সমর্থন ছিল না, এমনকি ওসমানকে রক্ষা করার জন্যে একসময় আলি নিজের ছেলেদের ওসমানের কাছে পাঠান। কিন্তু ওসমান হত্যা পরবর্তীতে ওসমানের হত্যাকারীদের অধিকাংশ আলিকে সমর্থন করে থাকায় ওসমান হত্যায় আলি জড়িত এমনই একটা ধারনা মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়। যদিও আলি ক্ষমতায় বসার ইচ্ছুক ছিলেন না কারণ তিনি জানতেন তিনি ক্ষমতায় বসলে ওসমান হত্যায় তাঁকে পরোক্ষভাবে জড়িত করা হবে তাই তিনি প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে সবার চাপে পড়ে ক্ষমতা গ্রহণে সম্মত হোন। মুয়াবিয়া নিজের স্বার্থে আলির বিরুদ্ধে নিজের পক্ষে মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্যে নিহত ওসমানের রক্তাক্ত পাঞ্জাবী ও তার স্ত্রীর কাটা আঙ্গুলের অংশ জনসম্মুখে ঝুলিয়ে রাখেন। মুয়াবিয়ার কৌশলের কাছে আলি পরাজিত হোন এবং নিজের দলের লোকদের চাপে পড়ে তিনি সন্ধি করতে সম্মত হোন। সেই সময় আলি পক্ষের একটি অংশ আলি ভুল করেছেন বলে আলির দল থেকে বেরিয়ে যান। তারাই খারিজি (Those who go out) নামে পরিচিত। হযরত আলি ভুল করেছেন এটাই ছিল তাদের যুক্তি। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এমন ধারণা জন্মায় যে; পাপী ব্যক্তি শাসক হওয়ার অযোগ্য। আলি যেহেতু মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেছেন সেহেতু আলি নিজেও অযোগ্য হয়ে গেছেন। তারা এতোটাই চরমপন্থী অবস্থায় চলে গেছে যে তারা অন্য মুসলিমদের কাফের হিসেবেও আখ্যায়িত করা শুরু করে। তারা মনে করতো যে পাপ হল কুফর অর্থাৎ আল্লাহকে অবিশ্বাস করা। সুতরাং কেউ পাপ করলে পাপের ফলে সে অবিশ্বাসী হয়ে যায়। এই ধরণের ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা যাবে এদের হত্যা করা যাবে। এমনকি এরা যদি নবীজির সাহাবিও হোন তারপরও এদের হত্যা করা যাবে। এরা এতোটাই উগ্র ছিল যে এদের সাথে কেউ যদি একমত না হতো তাহলে তাদের কাফের এবং তাদের হত্যার করতে এদের একটুও বাঁধত না। বলা হয়ে থাকে এসব খারিজিরা বেশির ভাগ ছিল বেদুইন ও অশিক্ষিত। এরা কোরান হাদিস সম্পর্কে খুব একটা বুঝত না। কিন্তু এরা সংখ্যায় কম হলেও চেতনায় এতোটাই উন্মাদ ছিল যে এদের অগ্রাহ্য করা কোন শাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে আলি এদেরকে নিজের দলে আনার চেষ্টা করেন। নিজে ব্যক্তিগতভাবে চিঠিও লেখেন। খারিজিরা উল্টো আলিকে জবাব দেয়; আলি আপনি নিজেই কোরান বোঝেন না।
খারিজিদের হারুবিয়াহ নামেও উল্লেখ করা হয়। কারণ আলির বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের আওয়াজ তোলা হয় হারুবা নামক স্থানে তাই তাদেরকে অনেকে হারুবিয়া নামেও অভিহিত করা হয়। আলির দল ত্যাগ করে খারিজিরা আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাবকে তাদের দলপতি নির্বাচিত করে। এবং পরবর্তীতে তার নেতৃত্বে নাহরাওয়ান নামক স্থানে তারা শিবির স্থাপন করে। তারা সেখান থেকে আলির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে খারিজিদের সাথে আলিকে যুদ্ধ করতে হয়। সেই যুদ্ধে খারিজিদের দলপতি সহ অনেক খারিজি নিহত হয়। প্রাণে বাঁচে মাত্র ৪’শ জন। বতর্মানে জঙ্গিরা যেভাবে বেহেস্তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শরীরে বোমা নিয়ে হামলা করে খারিজিরা ঠিক একই ভাবে যুদ্ধের ময়দানে উচ্চারণ করেছিল- Hasten to Paradise! to Paradise! পরবর্তীতে খারিজিরা সিরিয়ার শাসক মুয়াবিয়া, ও তার উপদেষ্টা মিশরের শাসনকর্তা আমর ইবন আস কে হত্যার চেষ্টা চালায়। সৌভাগ্যক্রমে তারা দুইজন নিহত না হলেও হযরত আলী মসজিদ থেকে আসার পথে খারিজি আব্দুর রহমান ইবন মুলযিমের হাতে নিহত হোন। খারিজিরা এতোটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে, পরবর্তীতে উমাইয়া, আব্বাসিয় শাসকরা এদের যন্ত্রণায় অস্থির ছিলেন। তারা মেসোপটেমিয়া পূর্ব আরব ও উত্তর আফ্রিকার উপকূলে অশান্তির সৃষ্টি করে। অবশেষে মিসরের ফাতেমি শাসনগণ খারিজিদের শক্তি সমূলে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। ফলে রাজনৈতিক প্রচারণা বর্জন করে তারা শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
মুয়াবিয়ার, খারিজির ইতিহাস অনেক পুরাতন হলেও তাদের অনুসারীরা এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন-সিরিয়াস ISIS সালাফি সুন্নি দল হলেও তারা খারিজিদের মতন বাংলাদেশের আরেক জামাত-ই-ইসলামকে ইসলামের শত্রু কাফের হিসেবে তারা তাদের ম্যাগাজিন-এ উল্লেখ করেছে। যেমনটি করেছিল খারিজিরা। এছাড়াও বাংলাদেশের মতন পৃথিবীর অনেক দেশেই বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও স্বার্থ হাসিল করার জন্যে কোরানকে সামনে নিয়ে আসে। ঠিক যেমনটি করেছিল মুয়াবিয়া সিফফিনের ময়দানে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো খারিজিদের মতন একই ধরণের ফতোয়া দিয়ে থাকে। তাদের মতের মতন না হলে সে কাফের কিংবা প্রকৃত মুসলমান নয় এমন তত্ত্ব তারা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জামাত শিবির, ওহাবীপন্থী, আহলে হাদিস দলগুলোকে অনেকে খারিজিদের বংশধর মনে করে থাকে। বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নির বিরোধ নেই।কিন্তু আরব অঞ্চলে শিয়া সুন্নির মধ্যে যে বিরোধ এবং অন্যকে অস্বীকার করার যে প্রবণতা তা বুঝতে গেলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। তাকাতে হবে শত বছরের পুরনো ইনতেকামের দিকে।
সহায়ক গ্রস্থ-
After The Phophet-The Epic Story of the Shia-Sunni Split in Islam by Lesley Hazleton
ইসলামের জন্ম বিকাশ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।
সহায়ক হিসেবে- উইকিপিডিয়া।