শিশুদের তৈরি করা বই শিশুদের হাতে!

10_book_festival_rupganj_020114_0031

বাংলাদেশ সরকার ১ম শ্রেণি হতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই সরবরাহ করে থাকে। নতুন বছরের শুরুতে শিশুদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্যে সরকার থেকে চাপ থাকে। ফলে যে কোন মূল্যে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিটি স্কুলে কম করে তিনটি নতুন বই কাজ পাওয়া কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে হয়। সকল বই দিতে জানুয়ারি মাস, বড় জোর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ সময় পাওয়া যায়। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, নিয়ম অনুসারে নির্দিষ্ট তারিখের পরে প্রতিদিনের জন্য আলাদা করে বড় অংকের জরিমানা দিতে কারিগর প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য থাকে। সুতরাং যতো দেরি ততো বেশি জরিমানা সবার গুণতে হয়।

উন্নত দেশের মতন বাংলাদেশেও কয়েকটি আইন আছে। যেমন ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেওয়া আইনত অপরাধ তেমনি আইনত অপরাধ শিশুশ্রম। তত্ত্বে ও আইনি ভাষায় অনেক কিছু বলে গেলেও বাস্তবতা হল, পেটে খিদে আসলে শিশুরাও শিশুশ্রম আইন মানে না। বাধ্য হয় আইন ভাঙতে। একদিনে বেয়াইনী অন্যদিকে পেটের খিদা। বাংলাদেশে বই তৈরি পেছনে তাদের শ্রম আছে তাদের বড় অংশটি হচ্ছে শিশু!

বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনামূল্যে বিতরণ করার সকল বই তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রেস বলতে আমাদের নেত্রপটে ছোট অন্ধকার জায়গা, রংয়ের কালিতে ভরপুর একটি দৃশ্য ভেসে উঠে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বড় বড় প্রেস গড়ে উঠেছে। সেই প্রেসগুলো’তে দৈনিক ৩ লক্ষ বই উৎপাদন করা সম্ভব। প্রাইমারি বইয়ের টেন্ডার করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। এবং সেটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার। তাই যে কেউ এই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারে। অনেকের একটি ভুল ধারণা যে; ভারতকে ইচ্ছে করে বই উৎপাদনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দরদাম করে যদি শ্রীলঙ্কা আমাদের বই দেওয়ার টেন্ডার পায় তারাও বই উৎপাদন ও বিলি করার আইনি অধিকার রাখে। গত ২০১৪ সালে কয়েক লক্ষের মতন বই করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রেসগুলো। তবে আমাদের যেহেতু সক্ষমতা বেড়েছে সেহেতু আমাদের দেশের সব বই আমরা এখন উৎপাদন করার ক্ষমতা রাখি। উল্লেখ করা প্রয়োজন-টেন্ডারে অংশগ্রহণের সময় আপনার কয়টি ওয়েব মেশিন (পত্রিকা ছাপে যে মেশিনগুলোতে শুধু বইয়ের জন্যে ফোল্ডারের সাইজ থাকে), কতোগুলো ফোর কালার মেশিন আছে (মানে একবারে কালার হয়ে বের হয়। মৌলিক কালার চারটি এই চার রঙের মিশ্রণে সব রঙ তৈরি করার যায়) , কতোগুলো ভাজাই মেশিন আছে (পাতা ভাজ করে), কতোগুলো গ্লু মেশিন আছে (বইয়ে আঠা লাগানো মেশিন), কতোগুলো কাটিং মেশিন আছে (বই হওয়ার পর কাটিং হল শেষ স্টেপ) এবং কতোগুলো স্টেপেন মেশিন আছে (২৫/৫০ টা করে বান্ডিল বানান হয়) সবগুলো উল্লেখ করতে হয়। তাই সক্ষমতার বাহিরে গিয়ে বই চাওয়ার সুযোগ নেই।

বইয়ের টেন্ডার পাওয়ার পর বই তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আলাদা একটি গ্রুপ তাদের সাথে কাজ করে। তাদের ডাকা হয় বাইন্ডার হিসেবে। বাইন্ডারও কতোগুলো বই, কতো ফর্মা (প্রতিটি বইয়ের দাম হয় ফর্মা হিসেবে। কালার কিংবা সাদাকালো ফর্মার আলাদা আলাদা দাম), কতোগুলো পেস্টিং। পেস্টিং হল জোরা লাগানো। উদাহরণ দিচ্ছি। যেমন-একটি বই হবে ৬৫ পেইজের। ৮*৮-৬৪। আলাদা এই পেইজটাকে তখন চার ফর্মা কিংবা দুই ফর্মার মেশিনে এক সাথে ছেপে কাটিং করে বইয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই কাজ মেশিনে করা সম্ভব নয়। তাই এর দায়িত্ব বাইন্ডারের। শুধু এটাই নয় বইয়ের পেইজ ছাপার পর কোন পেইজের পর কোন পেইজ তার সেটআপ, বাইন্ডিং সব তাদের দায়িত্ব। এর জন্যে অনেক লোক বলের দরকার হয়। এতো লোকজন যে কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রাখা সম্ভব হয় না বলে তারা কয়েক মাসের জন্যে কাজ অনুযায়ী বাইন্ডারের মাধ্যমে এসব শেষ করে। বই তৈরিতে কোম্পানির লোক ও বাইন্ডারের লোক একসাথে তৈরি করে। তারপরই একটা বই তৈরি হয়।

এই বাইন্ডারের আবার কাজ করার জন্যে আলাদা কিছু দক্ষ কারিগর থাকে। এর বাহিরের প্রায় সবাই থাকে অস্থায়ী। এবং এদের বেশির ভাগ গ্রামের শিশু। যেমন স্কুল বন্ধ কিংবা মাঠে ধান কাটার কাজ নেই সুতরাং তারা ঢাকায় এসে বই বানানোর কাজগুলো করে। বাইন্ডার ও তার লোকজনের বেশির ভাগের বাড়ি আবার ঢাকার আশে-পাশেই থাকে। শিশুদের নেওয়ার প্রধান কারণ; সস্তা শ্রম। একজন দক্ষ কিংবা বয়স্ক মানুষকে দৈনিক যদি ১৮০ টাকা বাইন্ডারের দিকে হয় সেখানে একটা শিশুকে খাটাতে পারলে ৮০ টাকা দিলেই খুশি। সব শিশু যে পরিশ্রমের কাজগুলো করে তা নয় কিছু কাজ আছে খুব পরিশ্রমের নয় তবে দৈনিক যে কোন কাজ ১০ ঘণ্টার উপর করা অবশ্যই কঠিন। যেটি যদি পেস্টিং এর মতন বসে বসে পাতা জোড়া লাগানোর কাজও হয়।

বাইন্ডারের লোকজন কাজ করে রোজ হিসেবে। একদিনে তারা সর্বোচ্চ তিন রোজ করতে পারে। যেমন-প্রথম রোজ সকাল ৮-বিকাল ৪টা। দ্বিতীয় রোজ বিকাল ৪-রাত ১০টা। তৃতীয় রোজ রাত ১০-২ কিংবা রাত ৪টা। এতো দীর্ঘ সময় ধরে শিশুরাও কাজ করে। কাজ পাওয়ার প্রথম মাসে রাত ২ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় না। রাত ২ টা কিংবা ৪টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় কাজ শেষ হওয়ার মাস দেড়েক আগ থেকে। এমনকি সেই সময় শুক্রবার বলে কোন ছুটিও থাকে না। শুক্রবারে হয়তো বিকাল ৪টা কিংবা রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সত্যি কথা কী বই তৈরির কাজ খুবই পরিশ্রমের। কাজ ভুল কিংবা কোন সমস্যা হলে বাইন্ডার থেকে এসব শিশুদের গায়ে হাত তোলা কিংবা গালাগালি করার ঘটনা নিয়মিত ঘটে। এসব শিশুদের বয়স সাধারণত ৬ বছর থেকে শুরু করে ১৫ বছর বয়সী। পারিবারিক অভাবের কারণে এসব শিশুদের বড় অংশের স্কুলে যেতে পারে নি কিংবা কেউ কেউ গেলেও তা নিয়মিত নয়। মূলত অভাবের কারণে তারা বইয়ের কাজ করতে আসে।

এবার আসি কয়েকটি বিষয়ে। যেমন-

বইয়ের কাগজের মান খারাপ হয়ে কেন?
বই দিতে দেরি হয় কেন?
কিছু স্কুলে সবগুলো নতুন বই যায় না কেন?

বইয়ের কাগজ খারাপ কেন?

পত্রিকার মালিকদের কাগজ আমদানির অনুমতি থাকলেও বই তৈরির মালিকদের এই অনুমতিটি নেই। পাঠ্যপুস্তক অধিদপ্তর ইচ্ছে করে এই অনুমতিটা দিচ্ছে না। টেন্ডারে যেহেতু দামা-দামি করে বই বানানোর অর্ডার জিনতে হবে সেহেতু মালিক বইয়ের কাগজ যেখান থেকেই আসুক না কেন ওজনে ঠিক হলেই তো হলো। কিন্তু দেশীয় কাগজ ব্যবসায়ীদের সাথে সিন্ডিকেট করে এরা কাগজ আমদানির উপর নিষেধ আরোপ করে রেখেছে। যেমন-বাচ্চাদের বই ১২০ গ্রাম (৩% কম বেশি হতে পারবে)। সুতরাং বইতে ১২০ গ্রামের কাগজ দিলেই তো হলো। সেটি বই কোম্পানির মালিক যেখান থেকেই আমদানি করুক না কেন। ফলে বাধ্য হয়ে দেশীয় পচা কাগজ বেশি দামে কিনে বই বানাতে বাধ্য হচ্ছে মালিক পক্ষ। বাংলাদেশে কাগজের সবচেয়ে বড় কোম্পানি হল- চট্টগ্রামের ম্যাপস। বসুন্ধরার মতন আরো অনেক কোম্পানি কাগজ উৎপাদন করে থাকে। যেহেতু বইয়ের টেন্ডার ও কাজ একই সাথে শুরু হয় সুতরাং একই সময় সবার প্রচুর পরিমাণে কাগজের দরকার হয়। এই সুযোগগুলো বড় বড় কাগজের কোম্পানি কাজে লাগায়। কাগজের অভাবে একটা দিন উৎপাদন বন্ধ থাকা মানে কয়েক লক্ষ টাকার আর্থিক ক্ষতি। সুতরাং তখন কোম্পানি যদি নিম্মমানের কাগজও পাঠায় তা দিয়েই কাজ শুরু করতে হয়। কাগজের একটা কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে অনেক সময় এতো বাজে কাগজ পাঠায় যা মেশিনেও চলতে চায় না। যেমন-ওয়েব মেশিনে ঘণ্টায় এভারেজ ২০ হাজার ফর্মা ছাপা যায়। এই সময় কাগজের রোল অনেক জোরে ঘুরতে থাকে। বাজে কাগজ হলে কাগজ বারে বারে ছিঁড়ে যায়। ফলে উৎপাদন কম হয়। সামগ্রিক দিন থেকে মালিকের ক্ষতি।

বই দিতে দেরি হয় কেন? ও অন্যান্য আলাপ।

বই দেওয়ার দায়িত্বে থাকে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিগুলো। কাগজের স্বল্পতা, উৎপাদনে দেরি হওয়া, হরতাল কিংবা রাজনৈতিক দাঙ্গা হাঙ্গামার কারণে বই পৌছাতে অনেক সময়ই দেরি হয়। বই সরবরাহ করতে গেলেও রাস্তায় পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। এমনকি বইয়ের গাড়ি থেকে মফস্বলে বই নামাতে গেলে স্থানীয় মাস্তানদের চাঁদা দিতে হয়। বিষয়টি দুঃখজনক তারপরও বলতে হয় অনেক সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ ঘুষ ছাড়া বই রিসিভ করতে চায় না। বই রিসিভ করার সাইন ছাড়া যেহেতু পাঠ্যপুস্তক অধিদপ্তর থেকে টাকার চেক তোলা যাবে না সেহেতু তারা এই সুযোগটি কাজে লাগায়। প্রতিবার বই দিতে গেলে কম করে ২০০-৫০০ টাকা ঘুষ অনেক জায়গায় দিতে হয়।

কিছু স্কুলে নতুন বই সবগুলো যায় না কেন?

বইয়ের টেন্ডার যারা নেয় তাদের অনেকে আবার ট্রান্সপোর্টের লোকদের সাথে চুক্তি করে। যেমন ধরেন- বই দিতে হবে ১০ লাখ। ট্রান্সপোর্টের লোকদের বলল আমরা করব ৯ লাখ। এক লাখ করব না। তবে বই কম দিলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে রিসিভ কপি নিয়ে আসতে হবে। তখন এসব ট্রান্সপোর্টের লোকজন ঘুষ দিয়ে এই কাজ করে। ফলে কিছু স্কুলে বিশেষ করে গ্রামের স্কুলগুলোর সবগুলোতে বই অনেক সময় যায় না। যেমন ধরেন- ১০০টা নতুন বাংলা বইয়ের জায়গায় গেল ৯০টি।

এবার কিছু তথ্য না দিলেই নয়। এসব বাইন্ডারের লোকজন যেহেতু অস্থায়ী সুতরাং রাতে কাজ শেষ হলে কারখানাতেই তাদের ঘুমাতে হয়। টাকার বিনিময়ে বাইন্ডার এদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। তবে সেই খাবারটিও খুবই নিম্মমানের। বছরের প্রথম শুরুতে শিশুদের হাতে নতুন বই তা অবশ্যই অনেক বড় সাফল্য কিন্তু সেই বইয়ের কারিগর যারা তাদের অনেকেই অর্থের অভাবে স্কুল ছেড়ে বই তৈরিতে হাত লাগাচ্ছে। একদিকে শিশুরা নতুন বইয়ের গন্ধ নিচ্ছে অন্যদিকে আরেক শিশু তার স্কুল জীবন বিসর্জন দিয়ে বই তৈরিতে হাত লাগাচ্ছে। এ যেন আলোর নিচে অন্ধকার!

ওয়েব মেশিন

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.