মৃত্যু শিবিরে যারা উৎসবে মেতেছিল

নাৎসিদের সবচেয়ে ভয়ংকর ক্যাম্পটির ছিল অসভিৎজ, যা পোল্যান্ডে নির্মাণ করা হয়। এই ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি বন্দি নাৎসিদের হাতে খুন হয়। ১১ লক্ষের বেশি মানুষকে এই ক্যাম্পে হত্যা করা হয়। যাদের প্রায় সবাই ছিল ইহুদি। এমন একটি মৃত্যুপুরীতে একমাত্র শয়তানের হৃদয়ের অধিকারী নাৎসি অফিসার ও তাদের বান্ধবীরা আনন্দে উল্লাসে মেতে উঠার ক্ষমতা রাখতো।

আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি’র হলোকাস্ট স্মৃতি জাদুঘর এই ছবিগুলো সংরক্ষণ করে। ছবিগুলোর তোলার সময়কাল ছিল ১৯৪৪ সালের মে-ডিসেম্বর মাস। অর্থাৎ তখন প্রতিটি ক্যাম্পে নির্বিচারে গণহত্যার উৎসব চলছিল। ছবিগুলোতে দেখা যায় তরুণ-তরুণীরা বেশ খোশ মেজাজে ক্যাম্পে কর্মরত অফিসার ও তাদের সহকর্মীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। কেউবা অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছে, কেউবা গান গাইছে, কেউবা সূর্যস্নান করছে, কেউকে আবার ক্যামেরাতে হাসি মুখে ছবি তুলছে। অন্য একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তারা ক্রিসমাস ট্রি জ্বালিয়েও আনন্দে মেতে উঠছে। অর্থাৎ তাদের বিনোদনের ব্যবস্থার কোন ত্রুটি ছিল না।

আপনি যদি ছবিগুলো খুব ভালভাবে লক্ষ্য করেন তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে, এই মানুষগুলো শুধু সাধারণ মানুষ নয় বরং বিংশ শতকের নিষ্ঠুর আদর্শের সমর্থক এবং গণহত্যার সহায়তাকারীও বটে।

ছবিতে যে অফিসারকে দেখা যাচ্ছে তিনি হচ্ছেন কার্ল হক্কার (Karl-Friedrich Höcker), যিনি রির্চাড বিয়ারের ডেপুটি ছিলেন। বিয়ার ছিলেন অসভিৎজ ক্যাম্পের ডিরেক্টর। অসভিৎজ ক্যাম্পে মোট ১.৩ মিলিয়ন মানুষকে আনা হয় এবং যাদের মধ্যে ১.১ মিলিয়নকে হত্যা করা হয়।

ছবিতে স্পষ্ট এসব মৃত্যু-ক্যাম্পে কীভাবে অফিসাররা তাদের অলস সময় ব্যয় করেছিল। কার্ল হক্কার একদিকে তার বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে চমৎকার সময় পার করছেন, অথচ অন্যদিকে ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ বন্দিকে গণহারে হত্যা করা হচ্ছে। এএটি শুধু অসভিৎজ ক্যাম্পের চিত্রই নয় বরং বুখেনবার্ট, ডাকাউ, জ্যাক্সেনহোজেন শিবিরেও একই চিত্র ছিল।

ছবির অ্যালবামে ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলাকেও দেখা যায়। যাকে ক্যাম্পে Angel of Death নামে ডাকা হতো। ম্যাঙ্গেলা ক্যাম্পের বন্দিদের উপর বিভিন্ন নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত। সাধারণ মানুষও কতোটা নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে তা অধ্যয়ন করার জন্যে এই ছবি অ্যালবাম যথেষ্ট।

ক্যাম্পে কর্মরত যারা ছিল তাদের বেশির ভাগই ছিল জার্মান। যারা প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেখেও সঙ্গীত উপভোগ করতো, বন্ধুদের নিয়ে আমদ ফুর্তিতে মেতে থাকতো। হক্কার অ্যালবামের বেশির ভাগ ছবি তোর স্থানটি হল Solahütte। যা অসভিৎজ ক্যাম্প থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানে অফিসারদের আনন্দ উৎযাপনের জন্যে বিশাল কেবিন ও বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছিল।

ছবিতে যাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি তারা কেউ রাক্ষস কিংবা দানব নয়, অথচ এরা সবাই রাক্ষসের মতনই কাজ করেছে। এই ছবিগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- যারা পৃথিবীতে হলোকাস্ট সংগঠিত করেছিল তারাও মানুষ। তারাও নিজেদের পরিবার, সন্তান, পোষা প্রাণী নিয়ে উৎসবে আনন্দেও মেতে উঠত, ছুটিতে বেড়াতে যেত ঠিক অন্য সাধারণ মানুষদের মতনই।  নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াশিংটন ডিসি’র হলোকাস্ট জাদুঘরের আর্কাইভ লেখক রেবেকা আর্বল্ডিং বলেন; এই ছবিগুলো আমাদের বুঝতে শেখায় লোকেরা যখন ইহুদি-বিদ্বেষ, জাতী বিদ্বেষ কিংবা অন্য কোন বর্ণবাদ আদর্শে বন্দি হয়ে যায় তখন কী করতে সক্ষম।

বিভিন্ন ক্যাম্পের গণহত্যার ছবি

১৯৪৫ সালে যখন রাশিয়ান বাহিনী অসভিৎজ ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়। ক্যাম্পে যারা বড় বড় অপরাধে সরাসরি যুক্ত ছিল তাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়। তবে অনেকে আবার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডেথ এঞ্জেল খ্যাত ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা। ম্যাঙ্গেলা দক্ষিণ আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং আজীবন সেখানে লুকিয়েই ছিলেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে ব্রাজিলে মৃত্যুবরণ করেন।

হক্কার যুদ্ধের পর বেসামরিক জীবনে ফিরে গিয়ে একটি ব্যাংকে চাকরি শুরু করেন। বিচারের সময় হক্কার অস্বীকার করেন যে তিনি সরাসরি যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিলেন। তবে বিচারে তাকে ৯ বছরের জেল দেওয়া  হয়। অবশেষে ২০০০ সালে ৮৯ বছর বয়সে কার্ল হক্কার মারা যান।

লেখাটি De skrattande i Auschwitz এর অনুবাদ।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.