কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেক দিন হল। নিজ আত্মীয় কৌরবদের সাথে সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতি এখনও পাণ্ডবরা ভুলে যায়নি। যুদ্ধে কৌরবদের পরাজয় ঘটেছে আর পাণ্ডবদের জয়। পাণ্ডবরা হস্তিনাপুর শাসন করছে। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ পৃথিবী ত্যাগ করেছেন এই সংবাদ শুনে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পাণ্ডু পুত্র যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্ত নিলেন যে; কুরুবংশীয় পরীক্ষিৎ কে রাজা করে তারা সবাই মহাপ্রস্থানের জন্য যাত্রা করবেন। দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরা তাদের সকল সম্পত্তি, দামী পোশাক সব কিছু ত্যাগ করে মহাপ্রস্থানের পথে রওনা হলেন।যুধিষ্ঠির সেই যাত্রার নেতৃত্ব নিচ্ছিলেন আর পেছনে ছিল তার চার ভাই ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব এবং একদম শেষে ছিলেন দ্রৌপদী। এই যাত্রা পথেই একটি কুকুরের সাথে তাদের দেখা হয়। ছয় জনের সাথে এই কুকুরও তাদের মহাপ্রস্থানের সঙ্গী হলেন।

তারা হিমালয়, মরুভূমি অতিক্রম করে অবশেষে পবিত্র মেরু পর্বতে পৌঁছালেন। এবারের যাত্রার পথে সবার আগে দ্রৌপদীর মৃত্যু ঘটল। ভীম তাঁর মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করলে যুধিষ্ঠির বলেন অর্জুনের প্রতি এঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল। অথচ দ্রৌপদী ছিল সবার পত্নী। কিছুক্ষণ পর সহদেব পড়ে গেলে ভীম তাঁর মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করেন; উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন সহদেব ভাবতেন তাঁর চেয়ে বিজ্ঞ আর কেউ নেই । এরপর নকুল পড়ে গেলে ভীমের প্রশ্নের জবাবে যুধিষ্ঠির বলেন নকুল মনে করতেন তাঁর তুল্য রূপবান আর কেউ নেই । কিছুদূর গিয়ে শোকার্ত অর্জুনও পড়ে গেলেন । অর্জুনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে যুধিষ্ঠির বলেন অর্জুন একদিনেই তার সকল শত্রু নাশ করবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কিন্তু তা তিনি পারেন নি; তাছাড়া তিনি অন্য ধনুর্বেদদের অবজ্ঞা করতেন । সবার শেষে ভীমও পড়ে গেলেন তিনি তাঁর আসন্ন মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করলে যুধিষ্ঠির বলেন ভীম অত্যন্ত ভোজন করতেন এবং অন্যের বল না জেনেই নিজ বলের গর্ব করতেন ।
সবার পতন ঘটলো, বাকি থাকলো যুধিষ্ঠির ও তাঁর অনুগত কুকুর। যুধিষ্ঠির তার যাত্রা চালিয়ে যান এবং অবশেষে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র রথে চেপে যুধিষ্ঠিরকে নেওয়ার জন্যে নেমে আসেন। যুধিষ্ঠির নিজের সাথে কুকুরকে নিতে চাইলে ইন্দ্র বাধা দেন। ইন্দ্র বলেন যাঁর সাথে কুকুর থাকে তিনি স্বর্গে যেতে পারেন না । কিন্তু যুধিষ্ঠির বলেন শরণাগতকে ভয় দেখানো, স্ত্রীবধ, ব্রহ্মস্বহরণ ও মিত্রবধ এই চার কার্যে যে পাপ হয় ভক্তকে ত্যাগ করলেও সেই পাপ হয় তাই তিনি ভক্তকে ত্যাগ করবেন না। কারণ সারা পথে তার ভাইরা, স্ত্রীরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু কুকুরটি তার সাথে সবসময় ছিল। তাই তিনি এই কুকুরটিকে রেখে স্বর্গে যাবেন না। যুধিষ্ঠির কথা শুনে ধর্মদেবতা কুকুরের রূপ পরিত্যাগ করে নিজের রূপ ধারণ করলেন আর বললেন; যুধিষ্ঠির তোমার সমান স্বর্গে আর কেউ নেই।

এখানে পাণ্ডব আর যুধিষ্ঠির নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। যুধিষ্ঠির পাণ্ডবদের সেই ব্যক্তি যিনি জীবিত অবস্থায় স্বর্গে প্রবেশ করেছেন। অন্যদিকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ী অন্য পাণ্ডবরা প্রথমে নরকে পতিত হয়েছিল। যুধিষ্ঠির যখন স্বর্গে প্রবেশ করলেন তখন দ্রৌপদী কিংবা ভাইদের কাউকে তিনি দেখতে পাননি। তখন তাকে নরকে ভাইদের অবস্থা দেখানোর জন্যে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাইদের অবস্থা দেখে তিনি স্বর্গে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তখন ইন্দ্র তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন; কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে দ্রোণাচার্যের সঙ্গে যুধিষ্ঠির যে প্রতারণা করেছিল সেই পাপের শাস্তি স্বরূপ কৌশলে তাকে নরক দর্শন করানো হয়েছে। অর্থাৎ পাপ বা অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। এরপর সবাইকে সাথে নিয়ে যুধিষ্ঠির স্বর্গে প্রবেশ করেন।
সূত্র: রাজশেখর বসুর মহাভারত
কুকুর ও অন্যান্য সকল প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ হোক।
