
যে অঞ্চলে বিদ্যার দেবী সরস্বতী, সে অঞ্চলে প্রথম নারী শিক্ষকের কী হাল হয়েছিলেন জানেন? প্রথম কলকাতা পত্রিকায় তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গুরুত্বপূর্ণ লেখা বিধায় নিজের ব্লগে জমা রাখলাম।
মহারাষ্ট্রের নায়গাঁওতে ১৮৩১ সালে জন্ম নিয়েছিলেন সাবিত্রী পাতিল। মাত্র ন’বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কাটগুন গ্রামের জ্যোতিবা ফুলের সঙ্গে।স্বামীর বইপত্র লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন বালিকা সাবিত্রী বাঈ। সমাজের অনান্য পুরুষের মতো জ্যোতিবা ফুলে তিরস্কার করেননি তাঁর স্ত্রীকে।কারণ জ্যোতিবা তখন সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন দেখছিলেন। সাবিত্রীবাঈকে জ্যোতিবা নিয়ে গিয়েছিলেন মিসেস মিচেলের বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সাবিত্রীবাঈ প্রথাগত শিক্ষা শেষ করে, শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন মিসেস ফারারের ইন্সটিটিউট থেকে।
১৮৪৮ সাল পুনের ভিডেওয়াড়ার রাস্তা দিয়ে রোজ সকালে যখন তিনি হেঁটে যেতেন তাঁর দিকে ছুটে আসতো পচা ডিম, নর্দমার কাদা ও গোবর।
উড়ে আসতো অশ্রাব্য গালাগাল। সেই সীমাহীন লাঞ্ছনা সহ্য করে সাবিত্রীবাঈ পৌঁছে যেতেন একটি বাড়িতে।যেখানে সাবিত্রীবাঈয়ের অপেক্ষায় মাদুরে বসে থাকতো, আটজন বিধবা নাবালিকা, যাদের শিক্ষার অধিকার ছিল যাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেএর পর কয়েকঘন্টা ধরে চলতো নাবালিকা বিধবাদের পড়াশুনা শেখানো। আটজন বালিকাকে নিয়ে শুরু করা বিদ্যালয়টিই ছিল, কোনও ভারতবাসী পরিচালিত প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। সাবিত্রীবাঈ ফুলে হয়ে গিয়েছিলেন, আধুনিক ভারতের প্রথম ভারতীয় মহিলা শিক্ষক।
বাল্যবিধবাদের অধিকার নিয়ে সাবিত্রীবাঈয়ের লড়াই মেনে নেয়নি পুনের রক্ষণশীল সমাজ। একঘরে করে দিয়েছিল ফুলে দম্পতিকে। ছাড়তে হয়েছিল বসতবাড়ি। জ্যোতিবার বন্ধু উসমান শেখ ও তাঁর বোন ফতিমা শেখ, নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন ফুলে দম্পতিকে। সেই বাড়িতেই ছিল সাবিত্রীবাঈয়ের বালিকা বিদ্যালয়টি। মাঙ্গ ও মাহার সম্প্রদায়ের জন্য সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরও দুটি স্কুল। ১৮৫১ সালে, সাবিত্রীবাঈয়ের তিনটি স্কুলে পড়াশুনা করতো প্রায় দেড়শো জন ছাত্রী।বাল্যবিধবাদের বোঝাতেন নারীদের জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব।
নারীশিক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য, ১৮৫২ সালে, ব্রিটিশ সরকার সাবিত্রীবাঈকে দিয়েছিল সেরা শিক্ষিকার পুরষ্কার।অর্থাভাবে সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠিত তিনটি স্কুলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১৮৫৮ সালে। তবুও লড়াই ছাড়েননি সাবিত্রীবাঈ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাল্যবিধবাদের পড়াতেন তিনি।পরবর্তীকালে সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আঠেরোটি বালিকা বিদ্যালয়।১৮৬৩ সালে সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বালহত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ’। গর্ভবতী বাল্যবিধবা ও ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী বালিকাদের আশ্রয়স্থল ছিল এই বাড়িটি।পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের সব দায়িত্ব নিতেন সাবিত্রীবাঈ।
১৮৭৩ সালে,স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সত্য শোধক সমাজ’। মুক্তমনা এই সমাজে যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ- অব্রাহ্মণ হিন্দু, মুসলিম ও সরকারি আধিকারিকেরা। এই সমাজের উদ্দেশ্য ছিল, পিছিয়ে থাকা মানুষদেরকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া। এই সত্য শোধক সমাজকে সাথে নিয়ে সাবিত্রীবাঈ লড়াই শুরু করেছিলেন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে।১৮৭৪ সালে, অব্রাহ্মণ সাবিত্রীবাঈ দত্তক নিয়েছিলেন কাশিবাই নামের একজন ব্রাহ্মণ বিধবার সন্তানকে। দত্তকপুত্র যশবন্ত রাওকে ডাক্তার তৈরি করেছিলেন। বিয়ে দিয়েছিলেন এক বাল্যবিধবার সঙ্গে।
১৮৭৬ সালে, ভারত জুড়ে শুরু হয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।তখন সাবিত্রীবাঈ তাঁর স্বামী ও পুত্রকে নিয়ে, প্রান্তিক মানুষদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার জন্য, মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় খুলেছিলেন প্রায় বাহান্নটি লঙ্গর।১৮৯০ সালের ২৮ নভেম্বর, প্রয়াত হয়েছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ ও সমাজকর্মী মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে। শত শত বছরের প্রথাভেঙে স্বামীর শবযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ। নিজের মাথায় বয়েছিলেন স্বামীর অস্থিকলস।তারপর তিনি নিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রাণঘাতী প্লেগে। মাকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন পুত্র যশবন্ত। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল করে ১৮৯৭ সালের ১০ মার্চ, চলে গিয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে।
(সাবিত্রীর পিতার নাম ছিল খান্ডোজি নাভেশ পাতিল। এই কারণে তাঁর নাম সাবিত্রী পাতিল ও ডাকা হয়)
- এখানে আরেক জনের কথা না বললেই নয় তিনি হলেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার। তাকেও কট্টর হিন্দুদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। গালাগাল, নিন্দে এমনকি পত্রিকায় তার নামে মিথ্যা সংবাদও ছাপা শুরু করে। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় খুব জেদি নারী ছিলেন। এছাড়া তার স্বামী তাকে সবসময় সার্পোট করতেন। এই কারণে তিনি পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং মামলায় জিতে আসেন। এছাড়া যে অঞ্চলে বিদ্যার দেবী সরস্বতী সেই অঞ্চলে হিন্দু পণ্ডিতদের ফতোয়া ছিল নারীরা পড়াশুনা করলে স্তন ছোট হয়ে যায়।
“প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষাও নারীর পক্ষে অমঙ্গলের কারণ। কেননা ইহার দ্বারা নারী পুত্র প্রসবোপযোগিনী শক্তিগুলির হ্রাস হয়। বিদুষী নারীগণের বক্ষদেশ সমতল হইয়া যায়, এবং তাঁহাদের স্তনে প্রায়ই স্তন্যের সঞ্চার হয় না, এতদ্ভিন্ন তাঁহাদের জরায়ু প্রভূতি বিকৃত হইয়া যায়।… বিদ্যা নানারূপে আমাদের অমঙ্গলের কারণ হইলেও নারীগণের পরম শত্রু।”
– প্রায় দেড়’শ বছর আগে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে এমন কথাই লিখেছেন ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের বেদব্যাস পত্রিকা।
সূত্র: অনন্যা কাদম্বিনী- সুবীরকুমার চট্টোপাধ্যায় (কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার)