বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর একটা হল ডিপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা। বাংলাদেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে অনেকেই এই বিষয়ে অফলাইনে কথা বললেও প্রকাশ্যে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেন না। ছয় দফার দাবীতে রাজপথে থাকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ………… আলম বললেন, দেখ শেখ মুজিব যেহেতু এখন বঙ্গবন্ধু এবং একই সাথে জাতির পিতা সেহেতু তাই শাহেদ আলী হত্যার ঘটনা প্রকাশ্যে বলা বেশ স্পর্শকাতর বিষয় এবং আমাদের জন্য বিব্রতকর।
শাহেদ আলী হত্যার ইতিহাস আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল (দ্বিতীয় খণ্ডে) বইয়ের ১৬৩ নং পৃষ্টায় উল্লেখ আছে
শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রাম চরমে পৌঁছে। প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে সদস্যদের মধ্যে মারামারির ফলে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। পিটার পল গোমেজ নামে একজন কংগ্রেস সাংসদ মাননীয় স্পিকার আবদুল হাকিমকে পাগল ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব আনেন এবং তার প্রস্তাব হাউসে গৃহীত হয়। এই উন্মত্ত প্রস্তাব নিয়ে সংসদে তোলপাড় শুরু হয়। এতে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার শাহেদ আলী গুরুতর আহত হন। তিনি ১৯৫৮ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তৎকালীন মন্ত্রী ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য জনাব হাশিমুদ্দিন আহমদ এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি ২২-৪-৯৮ তারিখে দৈনিক ইনকিলাবে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন “আমি শাহেদ আলী হত্যা দেখেছি, আমি শাহেদ আলীকে পুলিশ রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে দেখেছি।” সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপ: ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আপনার কতটা মনে আছে?
হাশিমউদ্দিন আহমেদঃ আপনি সত্য জানতে চান? কেউ তো এ পর্যন্ত কখনও এসব শুনতে চায়নি। কোন পত্রিকার সাংবাদিক কোন দিন আসেনি এ প্রসঙ্গে জানতে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী ছিলেন শান্ত স্বভাবের লোক। অপরদিকে স্পীকার আবুল হাকিম ছিলেন শক্ত লোক । কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সংসদ চালাতেন না । আবদুল হাকিমকে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগের সদস্যরাই সরিয়ে দেয়। শাহেদ আলী কেএসপি’র লোক হলেও শান্ত স্বভাবের কারণে ক্ষমতাসীনরা তাকেই পছন্দ করে স্পীকারের আসনে বসায়। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এসেম্বলিতে । শাহেদ আলী এসেম্বলিতে ঢোকার সময়ে শেখ মুজিব ও মোহন মিয়া ধস্তাধস্তি করছিল। শাহেদ আলী ঢোকার সাথেই সাথেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন এসেছেন? জবাবে শাহেদ আলী বললেন, আপনাদের দেখতে এসেছি । বিরোধী দলীয় সদস্যদের বিরোধিতায় শাহেদ আলী ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। খুব সম্ভব ভীতির কাররে তিনি আওয়ামী লীগ সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু বলার চেষ্টা করেন । বাজেট নাকি অন্য কি বিষয়ে কিছু বলতে গেলেই আওয়ামী লীগ মেম্বাররা ভীষণ ক্ষেপে যান শাহেদ আলীর উপর । একটা পেপার ওয়েটা সজোরে নিক্ষিপ্ত হয় শাহেদ আলীর কপালে । উনি কপালে হাত চেপে ধরেছিলেন। তবে সেদিন শেখ মুজিব হাউজকে শান্ত করার পরিবর্তে গরম করেছিলেন সবচেয়ে বেশী । প্রথমেই দেখলাম মুজিবের হাতে একটা হান্টার । স্পীকারের দিকে তেড়ে যাওয়ার সময় কে যেন শেখ মুজিবের হাত থেকে হান্টারটি কেড়ে নেয়। পরে মুজিবকে দেখলাম চেয়ার নিয়ে স্পীকারের দিকে তেড়ে যেতে। মুজিবের অন্য সাংগ পাংগরা সাথে ছিল । লাউড স্পীকারও বন্ধ । পরে দেখলাম শাহেদ আলীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশ কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে । তার কয়েকদিন পরেই শাহেদ আলী পাটোয়ারী মারা গেলেন ।
প্রশ্নঃ কেউ কি শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে বাঁচাতে চেষ্টা করেননি?
হাশিমুদ্দিন আহমেদঃ খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আব্দুস সালাম খান, খালেক নেওয়াজ খান ও আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।
প্রশ্নঃ খন্দকার মোশতাক ও শেখ মুজিবর রহমান তো একই দলের মেম্বার ছিলেন ।
হাশিমুদ্দিন আহমেদঃ একই দলের হলেও মুজিবের উগ্রতা কেউ পছন্দ করতেন না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজেও না।
প্রশ্নঃ শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আর কি তথ্য আপনি জানেন ?
হাশিমুদ্দিন আহমদঃ আমার যা চোখে দেখা তাই বললাম । শেখ মুজিব তার জীবনে অনেক অন্যায় করেছে । তার বিরুদ্ধে কেউ গেলেই শেখ মুজিব তাকে ছেড়ে দিত না। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী আমাকে অনেকবার বলেছে, মুজিবের উগ্রতায় অনেকেই অসন্তুষ্ট । শাহেদ আলী হত্যাকান্ডের কোন বিচার এ পর্যন্ত হয়নি। That was first political offence. সেটার বিচার হলে পরবর্তীতে সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার হত । (দৈনিক ইনকিলাব ২২/৪/৯৮)।
ডিপুটি স্পীকার শাহেদ আলী মৃত্যু সম্পর্কে প্রখ্যাত কথাশিল্পী ভাষা সৈনিক তৎকালীন পরিষদ সদস্য অধ্যাপক শাহেদ আলী’র বক্তব্য নিম্নরূপঃ
পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তখন আতাউর রহমান খান প্রধানমন্ত্রী । আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসভা। মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের হলেও স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টির লোক । স্পীকার ছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবীদ ও সাহিত্যিক আবদুল হাকিম । তিনি ছিলেন প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। স্বাধীনভাবে সংসদ পরিগচালনা করতেন আবদুল হাকিম। ক্ষমতাসীন পার্টির ইচ্ছামত কাজ করতেন না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবদুল হাকিমকে নিয়ে অসুবিধায় পড়ে। তারা যেমন ইচ্ছা তেমন পরিষদ চালাতে পারছিল না । ডেপুটি স্পীকার কুমিল্লার জনাব শাহেদ আলী পাটোয়ারীও কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য। কেএসপি’র মন্ত্রিত্বের আমলেই তারা স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। জনাব শাহেদ আলী আইনজীবী ছিলেন। তিনি একটু নরম মেজাজের লোক ছিলেন । অনেকটা আবদুল হাকিমের উল্টো । আওয়ামী লীগ শাহেদ আলীকে স্পীকার বানানোর সুযোগ খুঁজছিল । এ সময় স্পীকার আবদুল হাকিমের জন্য আমেরিকা থেকে দাওয়াত আসে সম্ভবত ২ মাসের জন্য। আবদুল হাকিম সাহেব আমেরিকা চলে গেলেন । ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী স্পীকারের দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা একে এক মহাসুযোগ মনে করলেন। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর স্পীকারকে আর পরিষদে ঢুকতে দেয়া হবে না। পরামর্শমত কাজ হল। আবদুল হাকিম আমেরিকা থেকে ফিরে এলেন। এসে তিনি পরিষদে ঢোকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু Assembly চলছিল । সকল দরজা ছিল বন্ধ। Assembly’র ভিতর খবর এলো স্পীকার সাহেব এসেছেন কিন্তু তাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কিছুদিন আগে পরিষদ ভবনের জন্য সার্জেন্ট এ্যাট আর্মস নামক এক বিশেষ পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করা হয় । তারা এসেম্বলীর চারদিক ঘিরে রাখে। আবদুল হাকিম সাহেব যেন ঢুকতে না পারেন, সে দায়িত্ব তাদের ওপর। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সদস্য ও বিরোধী দলীয় সদস্যদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ তখন স্থির করে, স্পীকার সাহেবকে পদচ্যুত করবে এবং এ জন্য তারা প্রস্তাব আনে ও কণ্ঠভোটে পাস পাস বলে ধ্বনি তোলে। প্রস্তাবটি হল আবদুল হাকিমের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। পরিষদের কাজ-কর্ম চালানোর মানসিক যোগ্যতা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন । কাজেই স্পীকারের কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আবদুল হাকিম অপসারিত হলেন এবং তার স্থলে শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে স্পীকার ঘোষণা করা হল । এ ধরনের একটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মারমুখী হয়ে ওঠে বিরোধী দল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকার হাত জোর করে শাহেদ আলী সাহেবকে অনুরোধ করলেন, এ কাজটি হতে দেবেন না। তাকে বলা হল-আপনি সরে পড়ুন। আবদুল লতিফ বিশ্বাস, নান্না মিয়া, ইউসুফ আলী চৌধুরী-এরা আরো অনেকে সামনের সারিতে ছিলেন। রিপোর্টার এবং স্টেনোগ্রাফাররা সেখানে বসে কাজ করেন, সেখানে ঢুকে তারা হৈ-হুল্লোড় করতে লাগলেন । এসময় গ্যালারি থেকে খাতা-পত্র, ডাস্টার ছোঁড়া শুরু করে ডেপুটি স্পীকারের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল-তিনি যেন ভয় পেয়ে সেখানে থেকে সরে পড়েন। ইউসুফ আলী চৌধুরী রাগের চোটে আছড়িয়ে মাইক ভাঙ্গতে লাগলেন । এদিকে শেখ মুজিব তার মোটা চামড়ার ব্যাগের ভিতর থেকে একটা লম্বা হান্টার বের করেন। হান্টারটির মাথায় চামড়া লাগানো ছিল। হান্টার বের করে তার নিজের আসনে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধভাবে নাড়তে লাগলেন । এই হট্টগোলের মধ্যে একবার শোনা গেল- আবদুল হাকিম এখন আর স্পীকার নেই। শাহেদ আলী এখন স্পীকার। এর মধ্যে শোনা গেল-ডেপুটি স্পীকার এর গায়ে আঘাত লেগেছে। আমি সেদিন এসম্বলী হলে ছিলাম। এসব আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। এমন সময় দেখা গেল, কয়েকজন লোক শাহেদ আলীকে ধরে তার চেয়ারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। হেঁটে হেঁটে গেলেন শাহেদ আলী সাহেব । ততক্ষণে পূর্বদিকের দরজা খুলে পুলিশের আইজি আবুল হাসনাত ইসমাইল অনেক সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়লেন পরিষদ গৃহে। এসেই ঘোষণা করলেন-Now I am the lord of the house. Vacate at once. সঙ্গে সঙ্গে এসেম্বলীর ভিতরে ঢুকে পড়েছে পুলিশ । শীঘ্রই বের হয়ে যাও। এরপর শুরু হল ধস্তাধস্তি । আবদুল লতিফ বিশ্বাস পড়ে গেলেন ফ্লোরে। তাকে পায়ে ধরে টেনে টেনে সার্জেন্ট এ্যাট আর্মস টেনে-হেঁচড়ে বারান্দায় নিয়ে যায়। ইউসুফ আলী চৌধুরীর পিঠ থেকে কামড় দিয়ে মস্ত বড় একদলা গোস্ত তুলে নেয় এক পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসেম্বলী হল খালী হয়ে যায়। ইউসুফ আলী চৌধুরী রিকশায় উঠিয়ে মিছিল বের হয়। সে ঘটনার ৩/৪ দিন পর শোনা গেল শাহেদ আলী ইন্তেকাল করেছেন। (দৈনিক ইনকিলাব ২৬/৪/১৯৯৮)।
ডিপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর হত্যার পর পাগলের রাজনীতির খেলা থেমে গেল বটে; কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর রাত বারোটায় পাকিস্তানের বুকে নেমে আসে সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর। গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটে, দেশে সামরিক শাসকের আওতায় চলে যায়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, পার্লামেন্ট, আইন পরিষদের সদস্যপদ নব রচিত শাসনতন্ত্র সবকিছু বাতিল করে পাকিস্তানে সামরিক শাসন ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ূব খানকে প্রধান সামরিক শাসক নিযুক্ত করেন। মাত্র কুড়ি দিনের মাথায় বিশ্বাসঘাতক ইস্কান্দর মির্জাকে তাঁরই অধীনস্থ প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান রাইফেলের গুলি আর সংগীনের খোঁচার ভয় দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে নির্বাসনে পাঠান। ইস্কান্দর মির্জা পাকিস্তান ছেড়ে সুদূর লন্ডনের এক হোটেলে ম্যানেজারী করে জীবন নির্বাহ করেন। তিনি আর স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসতে পারেননি। বিদেশের মাটিতেই প্রাণ ত্যাগ করেন এবং সেখানেই তার শেষ সমাধি হয়। পরবর্তীতে মোহন মিয়া এ ঘটনা বিভিন্ন ঘরোয়া পরিবেশে বেশ বাহাদুরি করে রসিয়ে রসিয়ে শ্রোতাদের শোনাতো। এ সম্পর্কে পি.এ. নাজির স্মৃতিচারণ করে লিখেছেনঃ সবিস্তারে পূর্ব পাকিস্তান এসেমব্লির ভেতর শাহেদ আলীর খুনের কিচ্ছা শুনালেন। তাঁর ভূমিকা কি ছিল তাও বিস্তারিত ভাবে বললেন। তাঁর গায়ে কত জোর সেটা তাঁর মাসল টিপে দেখতে বললেন। শেখ মুজিবুর রহমান আর তিনি মিলে কিভাবে ডায়াসে চড়াও হয়ে ধস্তাধস্তি করেছেন, তার একটা ডিমনস্টেশন দিয়ে ফেললেন। প্রায় এক ঘন্টা গল্প করলেন। হাসলেন এবং হাসালেন। (স্মৃতির পাতা থেকে, পি.এ. নাজির পৃঃ ৮৮)।
আমাদের দেশে একটি বহুল প্রচলিত প্রবচন রয়েছে- “জান বুঝে ফিরিস্তা” । আমাদের অবস্থাও তদ্রুপ। সভ্যতা-বৈভ্যতা অতিক্রম করে জাতীয় আশা আকাঙ্খার প্রতীক গণ পরিষদ-এর মতো পবিত্র স্থানে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন ডিপুটি স্পীকারকে হত্যা করা হলো। অথচ এ নিয়ে কোন অনুশোচনা হয়নি। উপরন্তু যেখানে-সেখানে বুক ফুলিয়ে নির্লজ্জের মতো হেসে হেসে বাহাদুরী ফলিয়েছেন। এরাই আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের কাছেই আমরা সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা করেছি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে এবং হচ্ছে।
– অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ / পথ চলিতে (১৯.০৪.১৯৬৯) ॥ [ অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ রচনাবলী – ১ । সম্পাদনা : আনু মুহাম্মদ । মীরা প্রকাশন – ফেব্রুয়ারী, ২০০৪ । পৃ: ২৫৩-২৫৫ ]
“… ২৩শে সেপ্টেম্বর (১৯৫৮)। এদেশের ইতিহাসের এক চরম কলঙ্কজনক দিন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত কিন্তু জনগণের স্বার্থ বিরোধী এই নেতারা সেদিন দেশের ইতিহাসকে কল্পনাতীতভাবে মসীলিপ্ত করে। বাইরের ঐতিহাসিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের কথা বাদ দিলাম। আমরা ৩০৯ জন পরিষদ সদস্য ছিলাম। তাদের মধ্যে কিছু কলমবাজ লোক তো ছিলেন। বামপন্থীদের মধ্যেও কেউ আজ পর্যন্ত এই দিনের ঘটনাবলীর একটি পূর্ণ বিবরণ লিখেননি। ঐদিনের কার্যবিবরণী, টেপ রেকর্ডার সব কিছু পরবর্তী সরকার বাজেয়াপ্ত করে। তা কোথায় আছে জানি না। জানলেও তা পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কাজেই অনেক ক্ষেত্রে আমাকে স্মৃতি নির্ভর হতে হচ্ছে। আর সেদিনকার সেই বিয়োগান্ত নাটকীয় ব্যাপারটির নাটকীয় বর্ণনা আমার অদক্ষ হাতে সম্ভব নয়। তবু চাই যে এর একটা রেকর্ড থাকুক। ভবিষ্যৎ বংশধররা উপলব্ধি করবে তাদের পিতৃপুরুষরা শ্রেণী চেতনার অভাবে কাদের নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করত। আর শ্রেণীগত কারণে, শ্রেণীশোষণের স্বার্থে এই নেতারা কী নির্মম, নির্লজ্জ, পাশবিক বিশ্বাসঘাতকতা করত। জনতা কত মহান। আর এই ‘জননেতা’ নামধারীরা কত নিচ, কত হীন। জনতা কত নি:স্বার্থপর। আর এরা কত স্বার্থান্ধ, কত লোভাতুর, কত নির্লজ্জ।
২৩শে সেপ্টেম্বর (১৯৫৮) সম্পূরক (Supplementary) বাজেট পেশের সাথে সাথে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। মোহন মিয়া, নান্না মিয়া, নবী চৌধুরী প্রমুখ আবু হোসেন দলের নেতারা মাইক স্ট্যান্ড, চেয়ারের হাতল ইত্যাদি যা পেলেন তা ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলেন। এ ব্যাপারে ফরিদপুরের মোহন মিয়া (ইউসুফ আলী চৌধুরী) ওস্তাদ ছিলেন। চরের জমি জবর দখলের সময় তিনি তার লাঠিয়াল বাহিনীর সাথে থাকতেন এবং নিজেই দাঙ্গা পরিচালনা করতেন। ওদিকে আওয়ামী লীগের যারা মাসলম্যান, মারামারিতে ওস্তাদ তারা মোহন মিয়াদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করল। আই.জি. ইসমাইল সাহেব স্বয়ং পরিষদ কক্ষের ভেতরে। এসেম্বলী মার্শালরাও ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে (যা আসির কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে) তারা পরিস্থিতির মোকাবেলা করে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন।
শেখ মুজিব আমার পাশে বসা ছিলেন। অপর পক্ষ স্পিকারের ওপর আক্রমণ করার সাথে সাথে সে তার ব্যাগ থেকে শঙ্কর মাছের হাত দেড়েকের একটা লেজ বের করে। শুনেছি শঙ্কর মাছের মাছের লেজের আঘাতে নাকি ঘা হয় এবং সে ঘা পঁচতে থাকে। স্পীকারের চারদিকে আবু হোসেনের দল হল্লা করছিল। সেদিকে লাফ দেবার আগে আমি শেখ মুজিবের হাত ধরে ফেললাম এবং বললাম – গভর্ণমেন্ট তোমাদের, এসেম্বলি মার্শালরা এমন কি পুলিশের আই.জি উপস্থিত আছেন। কিন্তু মুজিব ঝাড়া মেরে আমার হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেল। মারামারি চলছে। সূর্য পূর্ব দিকে না উঠে পশ্চিম দিকে উঠতে পারে কিন্তু যখন মারামারি চলছে তখন শেখ মুজিব আতাউরের মত চুপচাপ বসে থাকবে তা তো হতে পারে না। তাহলে শেখ মুজিব আর শেখ মুজিব থাকে না।
মারামারি শুরু হলে মহিলা সদস্যরা বিকট কান্নার রোল তুললেন। তাদের পরিষদ কক্ষের পশ্চাদভাগে চলে যেতে বলা হয়। সেদিন প্রেস গ্যালারি খালি ছিল। সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। আমরা ন্যাপ দলীয়রা দাঙ্গাতে জড়িত নয় একথার প্রমাণ রাখার জন্য পরিষদ কক্ষের পেছন ভাগে লাইন ধরে দাঁড়াই। দাঙ্গা হচ্ছিল সামনের দিকে, স্পীকারের চারদিকে। শান্তিবাহিনীর ভূমিকা পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কার বাপের সাধ্য এমন পারস্পরিক বেপরোয়া হিংস্র আক্রমণকে প্রতিরোধ করে। আবু হোসেন দলের একজনের নিক্ষিপ্ত জিনিসের আঘাতে শাহেদ আলীর নাক দিয়ে দরদর রক্ত ঝরতে শুরু করল। ২৫শে সেপ্টেম্বর বেলা ১-২০মিনিটের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। পরদিন গিলোটিন করে বাজেট পাশ করার পর অধিবেশন মূলতবী হয়॥”
***************
ঐদিন (২৬শে সেপ্টেম্বর) আওয়ামী লীগ বহু গুন্ডামার্কা লোক পরিষদ ভবনে আমদানী করেছিল। এদের মধ্যে কিছু কিশোরও ছিল। নানা রকম ইয়ার্কি মারছিল। আমার গা ঘিন ঘিন করছিল। পরিষদ ভবনের মর্যাদা চরমভাবে ক্ষুন্ন হল। যাবার সময় তারা পরিষদ ভবনের চারপাশের বাগানের সব ফুল ও কুঁড়ি ছিঁড়ে নিয়ে যায়। এ যেন সুন্দরের ওপর অসুন্দরের এক নিষ্ঠুর আক্রমণ, কলাবনে মত্ত হাতীর প্রবেশ।
***************
আবু হোসেন দলের মুরব্বি প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার কাছে স্পিকার হাকিমের তারবার্তা :
Dacca
20.09.58
STE 160
Mujibur Rahman over Telephone several times threatened me with violence of the worst sort saying I will not be allowed to enter the Assembly. Will be bodily removed adding that no local police will be of help to me. Relation of mine was assaulted last evening. I seek your advice. ( Justice Asir Commission Report. 9th April 1959 )
২৬শে সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট মির্জার নিকট আবু হোসেন সরকারের ফনোগ্রাম :
Mujibur Rahman and other leaders attacked Speaker with spears, rods and microphone stands stop imported armed goondas by Awami Leaguers rushed inside Assembly from outside attacked Speaker and opposition members encircling Speaker to save his life were molested and beaten stop despite frantic appeal police refused help stop some opposition members wrongfully confined in Awami Minister’s house stop others threatened with attack anywhere any time stop. ( Justice Asir Commission Report )